‘চাকরি অথবা সংসার, যে কোনো একটি বেছে নিতে হবে’—বদলি হতে না পারা শিক্ষক

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক  © এ আই দিয়ে তৈরিকৃত ছবি

পটুয়াখালীর একটি বেসরকারি স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত মো. সবু মিয়া। তাঁর গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধায়। তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হন। চাকরির পর থেকে পরিবার ছেড়ে একা থাকছেন পটুয়াখালীতে। পরিবার থেকে দূরে থাকতে হওয়ায় মানসিক কষ্টে ভুগছেন এই শিক্ষক। তাঁর ভাষায়, ‘এখন পরিস্থিতি এমন হয়েছে—চাকরি বা সংসার, একটিকে বেছে নিতে হবে।’

মো. সবু মিয়া দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমি গাইবান্ধার বাসিন্দা। তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পটুয়াখালীতে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি করছি। আমার বাড়ি থেকে কর্মস্থলের দূরত্ব ৫০০ কিলোমিটারেরও বেশি। বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী ও সন্তানকে একা রেখে থাকতে হচ্ছে। পরিবারের বিপদে পাশে থাকতে পারি না। এটা এক অসহনীয় কষ্ট। ইদানীং স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কও খারাপ হয়ে গেছে। দ্রুত বদলি কার্যকর না হলে চাকরি কিংবা সংসার—একটিকে ছাড়তে হবে। সরকারের কাছে আবেদন, দয়া করে বদলির সুযোগ দিয়ে আমাদের বাঁচার পথ করে দিন।’

মো. সোহেল রানা নামে আরেক শিক্ষক বলেন, ‘আমি দিনাজপুরের বিরল উপজেলা থেকে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলায় চাকরি করছি—দূরত্ব প্রায় ৮০০–৮৫০ কিলোমিটার। প্রচণ্ড কষ্টে আছি। বদলি অত্যন্ত জরুরি। এখানের ভাষা, খাবার, চালচলন—কিছুই আমাদের এলাকার সঙ্গে মেলে না। ভাষাগত পার্থক্যের কারণে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই বুঝে নিতে হয়। পরিবার থেকে দূরে থাকায় মানসিক কষ্টও বাড়ছে। সব মিলিয়ে বদলি কার্যকর করা এখন সময়ের দাবি।’

সবু মিয়া বা সোহেল রানার মতো আরও বহু শিক্ষক একই সংকটে ভুগছেন। এনটিআরসিএর (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) সুপারিশে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা ছাড়াও কমিটির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্তরাও বদলি না হওয়ায় ভোগান্তিতে রয়েছেন।

বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বদলির কোনো নিয়ম নেই। আগে এনটিআরসিএর গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ ছিল। কিন্তু ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের জন্য সেই সুযোগ সরকার বন্ধ করে দেয়। ফলে যেসব শিক্ষক শত শত কিলোমিটার দূরে চাকরি করছেন, তারা এখন বিপাকে পড়েছেন। বিশেষ করে নারী শিক্ষকদের ভোগান্তি বেড়েছে কয়েকগুণ।

গণবিজ্ঞপ্তিতে ইনডেক্সধারীদের আবেদন বন্ধ হওয়ার পর শিক্ষক সংগঠনগুলো বদলি চালুর দাবিতে আন্দোলনে নামে। দীর্ঘ আন্দোলনের পর সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বদলি ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেন।

প্রাথমিকভাবে এনটিআরসিএর সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য কিছু শর্তসাপেক্ষে বদলি নীতিমালা তৈরি করা হয়। এ সংক্রান্ত পরিপত্র জারির পর মাউশির এক পরিচালকের তত্ত্বাবধানে একটি সফটওয়্যারও তৈরি হয়। কিন্তু এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেওয়ায় নতুন করে সফটওয়্যার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে কবে নাগাদ তা সম্পন্ন হবে এবং শিক্ষকরা কবে বদলির সুযোগ পাবেন, তা এখনো অনিশ্চিত।

মোছা. আফরোজা খাতুন বলেন, ‘আমি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলা থেকে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চাকরি করছি—দূরত্ব প্রায় ৫৭০ কিলোমিটার। নিয়োগ পেয়েছি তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। তখন আমার একমাত্র ছেলের বয়স ছিল আট বছর। এলাকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভালো না হওয়ায় তাকে আমার স্বামীর কাছেই রেখে এসেছি। স্বামীও ইনডেক্সধারী শিক্ষক এবং তার হৃদরোগের সমস্যা আছে। গত চার বছর ধরে তিনি একাই রান্না করে ছেলেকে দেখাশোনা করছেন। আমি ছেলেকে খুব মিস করি, কিন্তু সময়ের অভাবে যাওয়া-আসা সম্ভব হয় না। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো কেঁদেই কেটে যায়। শিক্ষকদের এই কষ্ট কেউ বোঝে না।’

সঞ্জয় দাস বলেন, ‘আমার বাড়ি সাতক্ষীরা, চাকরি করছি সুনামগঞ্জের ছাতক থানায়। সাত বছর ধরে বাবা-মাকে একা রেখে আছি। তারা বৃদ্ধ, তাদের দেখার কেউ নেই। আমি একমাত্র ছেলে হয়েও পাশে থাকতে পারছি না। কোনো অসুস্থ হলে ওষুধ কিনে দেওয়ার মতোও কেউ নেই। সংসারও এখন টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ বছর বদলি কার্যকর না হলে হয়তো সংসারটাই ভেঙে যাবে।’

বদলি কার্যক্রমের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-২) মো. মিজানুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, “বদলির সফটওয়্যার তৈরির কাজ দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছি। টেলিটকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। তবে সফটওয়্যার তৈরি না হওয়া পর্যন্ত বদলি কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না।”


সর্বশেষ সংবাদ