শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিবৃতি
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০১৮, ০৬:০১ PM , আপডেট: ১৬ আগস্ট ২০১৮, ০৭:৪০ PM
কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত যে সকল শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালেয়ের ৩৭জন শিক্ষক এই বিবৃতি দেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, গত কয়েক মাস যাবত রাষ্ট্র কর্তৃক সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর বিভিন্ন ইস্যুতে বেশ কিছু নিপীড়নের ঘটনা সম্বন্ধে আপনারা সবাই অবগত আছেন। গত ২৯শে জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর সামনে সংবাদ সম্মেলনকে উপলক্ষ্য করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছাত্র নেতৃবৃন্দের উপর নির্মম আক্রমণ চালানোর মধ্যে দিয়ে এই নিপীড়নের সূত্রপাত হয়। শুধু আক্রমণ নয়, এই আক্রমণে আহত ছাত্রদের গ্রেফতার করার চেষ্টা করা হয়। এদেরকে গোপনে চিকিৎসা নিতে হয়েছে, সরকারি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যেতে হয়েছে, এমনকি রাষ্ট্রীয় রোষানল থেকে বাঁচতে কিছু প্রাইভেট হাসপাতাল পর্যন্ত এদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে। শিক্ষার্থীদের ওপর এই ধরনের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বাংলাদেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব।
এরপর বিভিন্ন পর্যায়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে যুক্ত ১১ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে সাতজন এখনও কারাগারে। বাকীরা এক রকম পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হলো কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন সময় ভিসির বাড়ি ভাংচুর, আইসিটি আইন লঙ্ঘন ইত্যাদি। কিন্তু এসব অপরাধের সাথে এই গ্রেফতারকৃত ছাত্ররা কিভাবে সম্পৃক্ত সেটি একেবারেই অস্পষ্ট রয়ে গেছে। শুধু তাই নয় যেই প্রক্রিয়ায় তাদের কাউকে কাউকে গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নেয়া হয়েছে সেগুলো আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মীদের মতে সুস্পষ্ট মানবধিকার লঙ্ঘন। এদের মধ্যে আহতরা এখনও পুরোপুরি সুস্থ হয়নি এবং কেউ কেউ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও অনেক কম।
কোটা আন্দোলনের এই নির্মম অধ্যায়ের রেশ কাটতে না কাটতেই নিরাপদ সড়ক আন্দোলন শুরু হয় দুই স্কুল শিক্ষার্থীর সড়ক দুর্ঘটনায় করুণ মৃত্যুর কারণে। স্কুল শিক্ষার্থীদের এই সুশৃঙ্খল আন্দোলন বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে ব্যাপকভাবে আন্দোলিত করে। কিন্তু কিছুদিন পরেই আমরা দেখতে পাই স্কুল-কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের উপরে কোটা আন্দোলনের নির্মমতার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এই নিপীড়নের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা মাঠে নামলে তাদের ওপরেও অত্যাচারের খড়গ নেমে আসে। শুধু তাই নয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ জন এবং বুয়েটের একজন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে হাজতে পাঠানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল কিন্তু ছাত্র ছাত্রীরা থানা ঘেরাও করে তাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে। সংবাদপত্র থেকে বুধবার আমরা জানতে পারছি, ‘আন্দোলনে উস্কানি’র অভিযোগে ৫১ মামলায় ৯৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা সংবাদপত্রের চিত্রে দেখেছি গ্রেফতারকৃত ছাত্র ছাত্রীদের কোমড়ে দড়ি বেঁধে দাগী আসামীদের মতো আদালতে নিয়ে আসা হচ্ছে। এইসব অত্যন্ত গর্হিত মানবাধিকার লংঘন এবং একটি ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করার প্রয়াস। এই ছাত্রদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো এরা লাঠিসোঁটা, ইটপাটকেল দিয়ে রাস্তার গাড়ি ভাঙচুর করে এবং পুলিশ বাধা দিলে পুলিশের ওপর আক্রমণ করে। কিন্তু এই গ্রেফতারকৃত ছাত্ররা কিভাবে এই গুরুতর অপরাধগুলোর সাথে জড়িত তার প্রমাণ এখনও পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনী গণমাধ্যমকে সরবরাহ করেনি। অথচ অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি নিরাপত্তা বাহিনীকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে অপরাধী এবং অপরাধের প্রমাণ গণমাধ্যমে সম্প্রচার করে। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনের গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মতোও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে সময় গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের বিরুদ্ধে ঐ ধরনের কোনো প্রমাণ সাধারণ জনগণের কাছে প্রকাশিত হয় নি।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় কিছু সংবাদকর্মী, বিশেষ করে ফটো সাংবাদিকরাও নির্মমভাবে আক্রমণের শিকার হন। এই আক্রমনকারীদের ছবি ও পরিচয়, জাতীয় দৈনিকগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হলেও এখনও পর্যন্ত কাউকেই আইনি প্রক্রিয়ায় আনা হয় নাই। শুধু তাই নয়, কোটা সংস্কার এবং নিরাপদ সড়ক এই দুই আন্দোলনেই আমরা দেখছি যে যেইসব ছাত্ররা পুলিশ এবং সরকারি ছাত্র সংগঠন দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছে, আহত হয়েছে, নিগৃহীত হয়েছে তাদেরকেই আবার সম্পূর্ণ বেআইনি প্রক্রিয়ায় গ্রেফতার করে নাজেহাল করা হয়েছে এবং হচ্ছে। পক্ষান্তরে যেই সরকারি ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা এই ভয়ংকর নিপীড়ন সংঘটিত করেছে, তাদের বিস্তারিত পরিচয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরেও এখনও পর্যন্ত একজনের বিরুদ্ধেও কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এই ধরনের নির্লজ্জ্ব পক্ষপাতমূলক আচরণ অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং গর্হিত অপরাধ। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে এবং শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের ওপর ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত এহেন হামলা ও নিপীড়নে আমরা ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত।
আর কয়েক দিনের মধ্যে বাংলাদেশের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যাবে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, এই উৎসব মুখর পরিবেশে নির্যাতিত এবং গ্রেফতারকৃত ছাত্ররা এবং তাদের পরিবার নিশ্চিতভাবে খুবই উৎকন্ঠা, অনিশ্চয়তা এবং ভীতির মধ্যে দিয়ে যাবেন। এইরকম ভীতিকর এবং উৎকন্ঠাপূর্ণ পরিবেশ এই পরিবারগুলোর উপরে চাপিয়ে দেয়া অত্যন্ত অন্যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ঈদের ছুটিকে ধরপাকড়ের মওকা ধরে নেয়া হয়েছে, কারণ ছুটির মধ্যে সংগঠিত প্রতিবাদ হবার সম্ভাবনা কম। দেখা যাচ্ছে ছুটির রেশ শুরু হতে না হতেই কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত থাকার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে হলের সামনে থেকে (পরে মুক্ত) ও ইডেন কলেজের এক ছাত্রীকে সিরাজগঞ্জের বাড়ি থেকে গোয়েন্দা পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। কিছু ধরপাকড়ের খবর সংবাদমাধ্যমে আসছে না বলে আমরা জেনেছি। আমরা আমাদের সন্তানতুল্য এইসব শিক্ষার্থীদের প্রতি আইনের সঠিক প্রয়োগ চাই এবং অন্তত পক্ষে ঈদের আগে জামিনে তাদের মুক্তি চাই। এসব শিক্ষার্থীদের বাবা-মা আত্মীয়-স্বজনের হাহাকার আমরা প্রতিদিনই সংবাদ মাধ্যমে জানছি, পড়ছি এবং এগুলো আমাদের তীব্রভাবে ব্যথিত করছে। তাই আমরা অবিলম্বে আমাদের ছাত্রদের উপর এই অমানবিক নিপীড়নের সমাপ্তির জন্য সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে আহবান জানাচ্ছি।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর প্রদানকারী শিক্ষকবৃন্দের তালিকা
১। আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক, অর্থনীতি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
২। রুশাদ ফরিদী, সহকারি অধ্যাপক, অর্থনীতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৩। সামিনা লুৎফা, সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৪। ফাহমিদুল হক, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৫। মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৬। রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৭। আব্দুর রাজ্জাক খান, সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৮। মোশাহিদা সুলতানা, সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৯। আশিক মোহাম্মদ শিমুল, সহকারি অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১০। মোঃ সেলিম হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১১। সায়মা আলম, সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১২। আর রাজী, সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১৩। সাঈদ ফেরদৌস, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
১৪। সাদাফ নূর, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১৫। মাহমুদুল সুমন, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
১৬। গৌতম রায়, সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
১৭। গোলাম হোসেন হাবীব (জি এইচ হাবীব), সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১৮। নাসরীন খোন্দকার, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
১৯। স্বাধীন সেন, অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
২০। মো.মাইদুল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
২১। সুবর্ণা মজুমদার, সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
২২। অভিনু কিবরিয়া ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক, অণুজীববিজ্ঞান, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
২৩। মাহবুবুল হক ভূঁইয়া, প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
২৪। তাহমিনা খানম, সহকারি অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২৫। কাজী মামুন হায়দার, সহকারি অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
২৬। গীতি আরা নাসরীন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২৭। সেলিম রেজা নিউটন, সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
২৮। মির্জা তাসলিমা সুলতানা, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
২৯। আইনুন নাহার, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
৩০। সুদীপ্ত শর্মা, সহকারি অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
৩১। আ-আল মামুন, সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
৩২। খাদিজা মিতু, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
৩৩। বখতিয়ার আহমেদ, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
৩৪। কাজী মারুফ, অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৩৫। নাসির আহমেদ, অধ্যাপক, ইংরেজি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
৩৬। মো. আব্দুল মান্নান, সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৩৭। হাসিবুর রহমান, অধ্যাপক, ইলেক্ট্রিকাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট।