ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও হাল ছাড়েননি রিমা, প্রথম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার

রিমা ইসলাম
রিমা ইসলাম  © টিডিসি ফটো

৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রিমা ইসলাম। তার নিজ এলাকায় তিনি প্রথম বিসিএস ক্যাডার। রিমার শৈশব কেটেছে গ্রামের নির্মল আনন্দে, গাছে চড়ে, পুকুর-নদীতে ডুব দিয়ে। বেড়ে উঠেছেন গ্রামের সবুজ প্রকৃতিতে। দুরন্ত কৈশোরের খেলার সাথীদের অনেকের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু থেমে যাননি রিমা। বিশ্ববিদ্যালয় এসে ক্যাম্পাসেও ছিলেন প্রাণবন্ত। উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাহিরে পিএইচডির স্বপ্ন দেখা রিমা পরিবারকে সময় দেওয়ার জন্য একসময় বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। প্রথম বিসিএসে পেয়ে যান তার স্বপ্নের ক্যাডার। কেমন ছিল রিমার জীবন? তার জীবনের গল্প জানিয়েছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে। স্মরণ করেছেন এতদূর আসতে যাদের সহযোগিতা পেয়েছেন, জানিয়েছেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া জীবনের গল্প।            

রিমা ইসলামের গ্রামের বাড়ি বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নে। তার বাবা পেশায় একজন ব্যবসায়ী। রিমা জয়পুরহাট গার্লস ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫-১৬ সেশনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। সেখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

আরও পড়ুন: প্রশাসন ক্যাডার মজিবুর কোনো রুটিন মানেননি, করেননি কোচিংও

নিজের সাফল্য নিয়ে অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি জানান, এক বড় ভাই ফলাফলের আগের রাতে আমার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার নেন। কথা ছিল পছন্দের ক্যাডার আসলে আমাকে ফোন দেবেন। বিসিএস ফলাফল প্রকাশের দিন বিকেলে আমি ফেসবুকেই ছিলাম। বার বার চাকরির গ্রুপগুলোতে চেক করছিলাম রেজাল্ট দিয়েছি কিনা। তখন নজরুল ভাইয়ের কল আসে আমি কেটে দেই। ভাইয়া শুধুমাত্র একটা শব্দ লেখেন এডমিন। পিডিএফ চেক করে নিজের রোল পেলাম শুরুর দিকেই। কেমন যে অনুভূতি হলো জানি না, শুধু মনে হলো প্রচণ্ড গরমের দুপুরে যেন আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি। প্রথমেই দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে ফোন দিলাম মা-বাবা, ভাইয়াকে। সেদিন কেঁদেছিলাম। এখনো মনে পড়লে চোখ ভিজে যায় আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায়।

ef01eccc-361c-47fa-8117-117f1385af11

অংশগ্রহণের দিক থেকে রিমার এটা ছিল প্রথম বিসিএস। অনেক আগে থেকেই তার ইচ্ছে ছিল পিএইচডি করার। কিন্তু বাড়ির একমাত্র মেয়ে হওয়াতে দেশের বাইরে যাওয়াতে মত দেননি পরিবার। 

কোভিড মহামারি চলাকালীন সময়ে সব থেকে প্রিয় মানুষ নানাজান মারা যান। রিমা জানান,আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেল, পড়াশোনা থেকে সম্পূর্ণ গ্যাপ নিলাম। সেই সাথে মনে হলো বাবা-মায়ের বয়স বাড়ছে। তাদের রেখে দেশের বাইরে যাওয়া পসিবল হবে না। বইয়ের ধুলো ঝেড়ে শুরু করলাম এক নতুন অধ্যায়। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ নিরাশ করেননি।

আরও পড়ুন: বিসিএস ক্যাডার হয়ে মাকে ফোন— ‘আমি ম্যাজিস্ট্রেট ইমন বলছি’

রিমা ও তার ভাই বড় হয়েছেন নানা-নানির কাছে। তবে দাদা বাড়িও ছিল কাছেই। তাই বাবা মায়ের শাসন থেকে রক্ষা ছিল না তার। রিমা জানান, যে গ্রাম থেকে এসেছি সেখানে শিক্ষা ব্যবস্থা ভালো না, মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় এসএসসির আগেই। শুধুমাত্র মায়ের দূরদর্শী স্বপ্নেই প্রথমে ক্যাডেট কলেজ তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফাইনালি বিসিএস জয়।

রিমার অনুপ্রেরণা ছিলেন তার মা। তিনি প্রিলিমিনারির জন্য কোন কোচিং করেননি। তবে লিখিত প্রস্তুতি তার জন্য অনেক কঠিন ছিল। একটা কোচিং এ ভর্তির একমাস পড়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। টেবিলে বসে পড়াশোনা ও লেখালেখি করতে না করলেন ডাক্তার। গ্রামের বাড়ি চলে যান। তিনি বলেন, মা-বাবা বললেন আপাতত ৪৩তম পড়াশোনা বন্ধ রাখতে তখন ৪৪তম প্রিলিতেও টিকেছিলাম। অনেক কান্নাকাটি করেছি আল্লাহর কাছে, মনে হতো আমার সাথেই এমন কেন হলো। মা বলতেন ধৈর্য ধরো রিজিকের মালিক আল্লাহ। তবে আমি প্রস্তুতি বন্ধ রাখিনি। 

প্রস্তুতির বিশেষ কোনো টেকনিক ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, বিশেষ টেকনিক বলতে আমার স্টাডি পার্টনার ছিল আমার এক কাছের বন্ধু ও ভাই সজীব। আমরা রুটিন করে দিনে পড়তাম, রাতে ত্রিশ মিনিট করে পড়া ধরতাম। কম্পিটিটিভ তবে হিংসা নেই এমন স্টাডি পার্টনার পাওয়া টা ভাগ্যের ব্যাপার। আমার সেই বন্ধু ও ভাই কিন্তু প্রশাসনেই সুপারিশকৃত।

আরও পড়ুন: ৭ সরকারি চাকরি ও ৩ বিসিএস জয় করা ইমন থিতু পররাষ্ট্র ক্যাডারে

কঠিন বিষয়গুলো কিভাবে আত্মস্থ করতেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কঠিন বিষয়গুলোকে দুই ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছিলাম- যেগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন সেগুলোতে জেদ উঠে যেত, যতক্ষন না শেষ হত ততক্ষণ পড়তাম ও উইকলি রিভাইজ করতাম।

আর অল্প গুরুত্বপূর্ণ+কঠিন গুলো বাদ দিয়ে দিতাম। কত নাম্বারের প্রশ্নের জন্য কতটুকু সময় ব্যয় করব এইটা সিলেবাস দেখে ডিসাইড করতাম

আমার বাবা ব্যবসায়ী, মা গৃহিণী। একমাত্র বড় ভাই বগুড়া জজকোর্টের অ্যাডভোকেট। আমি পরিবারের সব থেকে ছোট সদস্য। আমার পরিবারের তিন সদস্য বিভিন্নভাবে আমার বিসিএস প্রস্তুতির সাপোর্ট দিয়েছেন। বাবা বলতেন, প্রথম চান্সেই বিসিএস পাশ করতে হবে। মা বলতেন চেষ্টা করতে থাকো একসময় ফল পাবে। আর ভাইয়া বলতেন, বিসিএস না হলে পিএইচডি করতে পাঠাবেন (ঠিক আমি যেমনটা চাইতাম)। সব মিলিয়ে এই জার্নিতে নিজেকে কখনো একলা ফিল হয়নি।

ca6b64d4-9fa2-442c-ba1c-6dcdb2cf3204


সিনিয়রদের থেকে জেনেছিলাম পররাষ্ট্র ফার্স্ট চয়েজ হলে, ভাইভা হয় ইংলিশে। আমার ইংলিশে ভালো হওয়াতে ভেবেছিলাম ভাইভাতে সুবিধা পাব, কিন্তু আমার ৩২-৩৩ মিনিটের দীর্ঘ ভাইভা হয়েছে বাংলাতে। আরো কয়েকজনের ভাইভা এনালাইসিসে বুঝতে পেরেছি, ভাইভা ইংরেজি/বাংলায় হওয়া আর ক্যাডার চয়েসের উপর ডিপেন্ডেবল নয়। এখন প্রার্থীকে দুটো ভাষাতেই সুন্দর করে কথা বলা জানতে হবে।

চয়েস সেটাই দেয়া উচিত যে ক্যাডারটা আপনি আসলেই হতে চান। অনেকেই না বুঝে ক্যাডার চয়েস দেয়াতে পরে ভোগান্তিতে পড়েন। মনে রাখবেন চাকরিটা আপনি সারাজীবন করবেন, তাই বুঝে শুনে ক্যাডার চয়েস দেয়া টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন: পুলিশ ক্যাডার সজীব বললেন— ‘মায়ের মুখটাই আমার শক্তি’

চাকরিপ্রার্থীদের বিসিএসকে একমাত্র লক্ষ্য বানানো কি ঠিক কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে রিমা জানান, আমার নিজের জীবনের ভুল থেকে বলছি। প্রথম দুই বছর আমি বিসিএস প্রিলিমিনারি, রিটেন ছাড়া অন্য পরীক্ষাগুলো দেইনি। এদিকে প্রথম বিসিএসের রেজাল্ট হতে সময় লাগল তিন বছরের বেশি। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি এসে যখন আমি কয়েকটা ব্যাংকের এক্সাম দেয়া শুরু করি তখন আমার অনেক বন্ধু ব্যাংকসহ বিভিন্ন জবে ঢুকে গেছে। যদি আমার ৪৩ বিসিএসে ক্যাডার না আসতো তাহলে আমাকে অপেক্ষা করতে হত আরো ১ বছর। তাই প্রার্থীদের উচিত সব রকম পরীক্ষা দেওয়া। এতে অভিজ্ঞতা ও চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা দুটোই বাড়ে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে রিমা জানান, পারিবারিক অবস্থা সচ্ছল হওয়াতে চাকরিটা আমার কাছে নিছক জীবন চালানোর একটা রাস্তা হিসাবে ছিল না। এটা আমার স্বপ্নের থেকেও সুন্দর প্রাপ্তি। তাই এর থেকে প্রাপ্য সম্মানী আমি শেয়ার করতে চাই অনেকের সাথে। অনেক ছোট থেকেই ইচ্ছা করত কিছু অনাথ বাচ্চার পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে। সন্তান পরিত্যক্ত একান্ত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে। জানি না কতটা পারব। তবে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে গেলে এসবই আসে আমার ভাবনায়। প্রশাসনের চাকরির শুরুর বছরগুলো থাকতে হবে মাঠ পর্যায়ে। অবশ্যই নিজের সর্বোচ্চ দেয়ার চেষ্টা করবো। আর চাকরি জীবনের পদ নিয়ে এখনো ভাবিনি। জীবন যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই যাব ইনশাল্লাহ।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence