অন্যরা নির্যাতনের শিকার হলে চিৎকার করত, কিন্তু শিবির কর্মীদের সেই সুযোগ ছিল না

মো. মাজহারুল ইসলাম
মো. মাজহারুল ইসলাম  © টিডিসি সম্পাদিত

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যোলয়ে শিবির সন্দেহে শিক্ষার্থীকে রাতভর নির্যাতনের পরে পুলিশে দিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা’—এমন ঘটনা বিগত আওয়ামী সরকারের শাসনামলে প্রায়ই দেখা যেত। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না দেশের প্রতিটি ক্যাম্পাসেই সাধারণ শিক্ষার্থীসহ ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অন্যান্যদেরও দমনে নির্যাতন করত নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগ। এমনিভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক মো. মাজহারুল ইসলাম। সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া পোস্টে তিনি তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দেন।

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য মাজহারুল ইসলামের পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো—

‘আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। কোন এক বিশেষ কারণে সেদিন খুব আনন্দিত ছিলাম। জসীম উদদীন হলের নিচতলায়, মসজিদসংলগ্ন একটা রুমে থাকতাম। বিকেলের দিকে বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে বাড়িতে কল কথা বলছি। সিঁড়ির কাছাকাছি আসার পর হল ছাত্রলীগের সভাপতি কুখ্যাত অলিউল সুমনের সাথে দেখা। স্বাভাবিকভাবেই ফোনে কথা বলতে থাকায় তাকে সালাম দেইনি। বিষয়টা সে স্বাভাবিকভাবে নেয় নি। হঠাৎ থেমে গিয়ে চার্জ করা শুরু করলো- ‘কোথায় থাকি, কোন রুম, কি করি’ ইত্যাদি নানা প্রশ্নে হেনস্তা করলো। আশেপাশে কয়েকজন জুনিয়রও দাঁড়িয়ে ছিল। সবার সামনে সে বলল, ‘তোর মধ্যে সমস্যা আছে। তুই রাতে রুমে আসবি, তোর সাথে হিসেব আছে।’

‘আমাদের কষ্ট হলো অন্যরা নির্যাতনের শিকার হলে চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে পারত। কিন্তু শিবির নির্যাতিত হলে সেটুকুরও সুযোগ থাকত না। কারণ এই পরিচয় পেলে পাশে দাঁড়ানো থাকলো দূরের কথা সহানুভূতিটুকুও কপালে জুটত না। ট্যাগিং, ব্লেমিং, কিলেবল, আদারিং, কর্নারিং করে জীবনটা বিষিয়ে তুলত। আমার জানের দোস্তকে আমি পাশে পেতাম না, অভিভাবক তুল্য শিক্ষক আমার পাশে দাঁড়াত না, হলের প্রোভোস্ট মামলা দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিতো, প্রক্টর বলত তোমাদের শিবির করতে বলেছে কে? এখন বোঝো কেমন লাগে?’

বাহির থেকে রাতে হলে ফিরি আনুমানিক ১০ টার দিকে। রুমে আগেই জানাই ঘটনার কথা। তখনও এশার নামাজ পড়া হয়নি। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে অজু করে মসজিদের ঢুকবো। মসজিদের গেটের সামনে দেখলাম আমার দুজন রুমমেট ফ্রেন্ডকে নিয়ে আমার ব্যাচেরই মোস্ট পলিটিক্যাল শুভ দাঁড়িয়ে আছে। বলল—

—ওপরে চল ভাই ডেকেছে। (শুভ
—নামাজটা পড়ি আসি? (মাজহার)
—এখন না, এসে নামাজ পড়িস, চল তাড়াতাড়ি। (শুভ)]

রুমে ঢোকার পর দেখলাম উত্তরবঙ্গের সাদ্দামের অনুসারী ইমিডিয়েট সিনিয়র হেদায়েত আর বরিশালের নাইম সেখানে উপস্থিত। শুরু হলো অভিযোগ আর প্রশ্নের বন্যা। বিশেষ করে আমার উপর শিবির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে টর্চার শুরু হলো। আমাদের ফোনগুলোকে আবার আনানো হলো নিচ থেকে। মোবাইল ফোন দীর্ঘক্ষণ সার্চিং করে কোনোকিছু খুঁজে না পেয়ে ওদের ক্রোধ আরো বেড়ে যায়। একপর্যায়ে রুম পরিষ্কার করা ঝাড়ু দিয়ে আমাদের মুখের উপর মারতে শুরু করে। এটাই আমার জীবনে চেহারার উপরে কারো প্রথম আঘাত।

ওই নির্যাতনের পর আমার সেই রুমমেট মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েছিল। রাতের এই ঘটনা আমি আর কাউকেই জানাইনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি থেকে শুরু করে কোন দায়িত্বশীলকেই না। কারণ আমি জানি উনাদের কিছু করার নেই। বরং এই ঘটনা তাদের আরো কষ্ট ও ভীতি ছড়াবে। সাংবাদিকদের দ্বারস্থ হইনি। এতে হলে থাকা এবং ক্লাসে আসা বন্ধ হয়ে যাবে। আল্লাহর নিকট সাহায্য চেয়ে সবর করেছি।

লাইব্রেরি থেকে রাত ১০ টায় হলে এসে বিছানা রেডি করে সবে শুয়ে পড়েছি। মাথার কাছে ফোনটা বেজে উঠলো। রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে উসমান ভাই বললেন, ‘যেভাবে আছো ঠিক সেভাবেই হল থেকে দ্রুত বের হও।’ কোন কথা না বলেই পাঞ্জাবিটা টান দিয়ে বের হয়ে গেলাম।

প্রথম বর্ষের কর্মী যোবায়ের। খুব সহজ সরল একটা ছেলে। মাত্র কয়েকমাস হলো হলে উঠেছে। হলের সিকিউরিটির বিষয়গুলো ওকে কয়েকবার ধরে ধরে বোঝানো হয়েছে। প্রায় বছর খানেক আগে কোন এক ভিডিওতে একটা ছোট্ট কমেন্ট সামনে আসে। ডাকা হয় সিঙ্গেল গেস্ট রুমে। ফোন সার্চ করে প্রোফাইলে পাওয়া যায় দেলওয়ার হোসাইন সাইদির ছবি। ভয়ভীতি দেখালে সে স্বীকার করে শিবির সংশ্লিষ্টতার কথা। এরপর হল সংসদে শুরু হয় এক নির্মম নির্যাতন। কবি জসীম উদদীন হল ছাত্রলীগের সকল গ্রুপের সকল স্তরের নেতাকর্মীরা তাকে একে একে মারতে থাকে। যোবায়েরের ভাষ্যমতে ওই রাতে তাকে ৩০-৩৫ জন মেরেছে।

যোবায়েরকে যখন মারা হচ্ছিলো আমরা কয়েকজন তখন সূর্যসেন হলে বসে চরম উৎকণ্ঠার সাথে সময় পার করছি। কাকে বলব? এই সময় কে সাহায্য করতে পারবে? শিক্ষক, প্রোভোস্ট, হাউজ টিউটর, সাংবাদিক সবাইকে কল করি। কেউ কোনো সহযোগিতা করতে পারেনি। 

যোবায়েরকে বলা হচ্ছিল বাকিদের নাম বলতে কিন্তু সে অস্বীকার করে। ফলে নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। হলে থাকা অন্যান্য জনশক্তিদের হল থেকে বের করে আনা, যোবায়েরকে এই টর্চার শেল থেকে বের করতে আমরা পাগল প্রায় হয়ে যাই। তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি সহ সকল দায়িত্বশীল একযোগে চেষ্টা করে যান কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। অবশেষে প্রোভোস্ট আব্দুর রশিদ স্যার এসে তার থেকে মুচলেকা নিয়ে হল থেকে বের করে দেন। 

আনুমানিক রাত সাড়ে ১০ থেকে সাড়ে ৩ টা পর্যন্ত এই সময়টা জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অধ্যায়। জনশক্তিদের নির্মম নির্যাতনে কিছু করতে না পারার অসহায়ত্ব সেদিন উপলব্ধি করেছি। উল্লেখ্য, এর পরদিনই ছিলো আমার সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। রাতের এই ঘটনায় এতটায় ট্রমাটাইজ হয়ে যাই যে পরীক্ষার হলে ৩ ঘণ্টা কীভাবে পার করেছি তা কেবল আল্লাহ জানেন। একইরকম ৫ বছরে শুধুমাত্র আমার হলেই অসংখ্য শিবির নির্যাতনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি। ইসলামি ড্রেস কোট আর স্যাোশাল মিডিয়া ও বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেওয়ায় বহুবার হুমকি ধমকি আর নির্যাতনের স্বীকার হয়েছি। ফ্যাসিবাদী আমলে শুধুমাত্র আমার একটা পোস্ট শেয়ার দেওয়ায় জহু হলের মুজাহিদকে সিঙ্গেল গেস্টরুম নেয় ছাত্রলীগ। 

আমাদের কষ্ট হলো অন্যরা নির্যাতনের শিকার হলে চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে পারত। কিন্তু শিবির নির্যাতিত হলে সেটুকুরও সুযোগ থাকত না। কারণ এই পরিচয় পেলে পাশে দাঁড়ানো থাকলো দূরের কথা সহানুভূতিটুকুও কপালে জুটত না। ট্যাগিং, ব্লেমিং, কিলেবল, আদারিং, কর্নারিং করে জীবনটা বিষিয়ে তুলত। 

আমার জানের দোস্তকে আমি পাশে পেতাম না, অভিভাবক তুল্য শিক্ষক আমার পাশে দাঁড়াত না, হলের প্রোভোস্ট মামলা দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিতো, প্রক্টর বলত তোমাদের শিবির করতে বলেছে কে?এখন বোঝো কেমন লাগে?, সাংবাদিক নিউজ করত আওয়ামী ভাষায়, আমাকে হত্যা করলে সুশীল সমাজ তার বৈধতা দিতো, দুনিয়ায় সকল অসহায়ত্ব চেপে বসত।

আজকে কাদের গং আমাদের উপর লীগের হামলা লঘুকরণে প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। নির্যাতিতদের উপরেই নির্যাতনের দায় চাপানোর ঘৃণ্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিছু কিছু হলে শিবিরের দায়িত্বশীল এত বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে যে যার একরাতের বোঝা কাদেরেদের কান্দের উপরে দিলে সারাজীবন কোমর সোজা করে হাঁটতে পারবে না। ১৯৭৭ সাল থেকে আজ অবধি ক্যাম্পাসে অবস্থানরত শিবিরের উপর নির্যাতনের রেকর্ড তৈরি করলে সেটা কয়েকশ ভলিউম হবে।’


সর্বশেষ সংবাদ