লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধ ও অধিকার রক্ষায় ছাত্র সংসদ চান শিক্ষার্থীরা
- জুনায়েদ মাসুদ
- প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:০৩ PM , আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:১০ AM

বিশ্ববিদ্যালয়ে সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চার ও সঠিক রাজনৈতিক বিকাশে ছাত্র সংসদের ভূমিকা অপরিসীম। লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি কর্মকাণ্ড থেকে বেড়িয়ে শিক্ষার্থীদের সঠিক নেতৃত্বে বিকাশে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মতামত তুলে ধরেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক জুনায়েদ মাসুদ।
লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধ ও অধিকার রক্ষায় ছাত্র সংসদ চান শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের কল্যাণ ও নেতৃত্ব বিকাশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের ইসমাঈল হোসেন বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায় ও নেতৃত্ব বিকাশে ছাত্র রাজনীতি এবং ছাত্র সংসদ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ এমনকি নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।
তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও অন্যান্য ছাত্র সংসদগুলো থেকে উঠে এসেছে অনেক জাতীয় নেতা। তবে নব্বইয়ের পর থেকে কোনো সরকারই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দেয়নি। ফলে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। হল দখল, সিট বাণিজ্য এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মতো অপকর্ম প্রায় নিয়মিত ঘটেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এসব অনিয়মের মূলে ছিল অকার্যকর ছাত্র সংসদ। নতুন বাংলাদেশে শিক্ষার্থীবান্ধব রাজনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন পুনরায় চালু করা অত্যন্ত জরুরি। ছাত্র রাজনীতি শিক্ষার্থীদের কল্যাণ ও নেতৃত্ব বিকাশে নিবেদিত হতে হবে। নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনই পারে ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু, কল্যাণমুখী এবং শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে।’
আরো পড়ুন: ডাকসু নির্বাচন জুলাইয়ের পরে করার সুপারিশ প্রভোস্টদের
গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চার জন্য ছাত্র সংসদ দরকার বলে উল্লেখ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নওশীন নাওয়ার জয়া বলেন, ‘ছাত্র সংসদ নির্বাচন গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশে সহায়তা করে এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে।
তিনি বলেন, ‘ইতিহাসের পাতায় ছাত্র সংসদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্র সংসদ নির্বাচন শিক্ষার্থীদের মধ্যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক মানসিকতা ও দায়িত্ববোধের বিকাশ ঘটায়। এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঐক্য ও সহযোগিতার চেতনা জাগ্রত করে এবং তাদের সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগ দেয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেদের নেতৃত্ব নির্বাচন করার সুযোগ পায়, যা তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে। এটি লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির পরিবর্তে সৎ, যোগ্য ও স্বাধীন নেতৃত্বের বিকাশ ঘটায়।’
তিনি আরো বলেন, ‘ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা দলীয় রাজনীতির প্রভাব মুক্ত থেকে তাদের সমস্যা ও দাবি নিয়ে সরাসরি কাজ করতে পারে। সার্বিকভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন কেবল শিক্ষাঙ্গনে গণতন্ত্রের চর্চা নয়, বরং বৃহত্তর সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এটি একটি জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ভিত্তি রচনা করে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার পথ তৈরি করে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী সৈকত ইসলাম বলেন, ‘রাজনৈতিক মনোভাব ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার কারণে ক্যাম্পাস অভ্যন্তরে সবার চাহিদা, প্রত্যাশা এবং সমর্থন ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা, শিক্ষার পরিবেশ, প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক চাওয়া-পাওয়া নিশ্চিতকরণ এবং দেশ ও দশের জন্য আগামীর নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য একটা প্লাটফর্ম দরকার, যেটি হতে পারে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ।’
তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিবেশ নির্মাণে ভূমিকা রাখা ছাড়াও দেশ নির্মাণের ইতিহাসেও লেখা ছাত্র সংসদের ভূমিকার কথা। নানা কারণেই এসব ছাত্র সাংসদ নিষ্ক্রিয় হয়েছে কিংবা পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান উত্তর ক্যাম্পাস সংস্কারের প্রথম দিকের একটি কাজ এই ছাত্র সংসদ সক্রিয় করা। যেসব ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নেই সেখানে ছাত্র সংসদ গড়ে তোলা। এটির সক্রিয় করণের পদ্ধতি হবে নির্বাচন, যা নিয়মিত চলমান থাকবে।
তিনি আরো বলেন, ‘আর এ সময়ে এসেও যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্র সংসদ নির্বাচন না দেয় কিংবা এই দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হয় তাহলে সেটি হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চরম ব্যর্থতা, যা আবার ক্যাম্পাসে ফ্যাসিবাদী পরিবেশ সৃষ্টির প্রধান স্তম্ভ হতে পারে।’
আরো পড়ুন: স্থানীয় নাকি জাতীয় নির্বাচন, কোনটা আগে চান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মেহেদী শাহেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ হওয়ায় এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাস্তবিক অর্থে মুক্তবুদ্ধির চর্চা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজন গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা। আর এই জন্যই দরকার ছাত্রসংসদ ও নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি।’
তিনি বলেন, ‘ছাত্র সংসদ এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার কোনো একক রাজনৈতিক ব্যানার নেই। ফলে নিয়মিত ছাত্রদের ভোটে নির্বাচিত ছাত্রসংসদের প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ সুবিধা আদায়, নেতৃত্বের বিকাশ এবং সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রসংসদ অকার্যকর থাকায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে।’
তিনি আরো বলেন, ‘কারণ ছাত্র সংসদের অকার্যকর সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন যৌক্তিক দাবি ও সংস্কার বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে উত্থাপিত হচ্ছে না। ফলে আবাসন সংকট, হল ও ক্যাফেটেরিয়ায় খাবারের নিম্নমান, পরিবহন সংকট , লাইব্রেরিতে অপর্যাপ্ত বই সহ হাজারো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তাই শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে যোগ্য ছাত্র প্রতিনিধি গড়ে তুলতে অকার্যকর ছাত্রসংসদ গুলো দ্রুত কার্যকর করা জরুরি।’
লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সাস্ট) অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মহিম উদ্দিন মুবাশ্বির। তিনি বলেন, ‘নব্বইয়ের পর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নির্বাচন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীবান্ধব রাজনীতি ক্রমে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এর ফলে ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব, হল দখল, সিট বাণিজ্য, এবং শিক্ষার্থীদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মতো অপকর্ম বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এই ধরনের অনিয়মের মূল কারণ হলো অকার্যকর ছাত্রসংসদ, যা শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। আজকের প্রেক্ষাপটে নতুন বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষার্থীদের জন্য সুষ্ঠু, গণতান্ত্রিক, এবং কল্যাণমুখী পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। একটি কার্যকর ছাত্রসংসদ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে, তাদের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখে এবং নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে।’
তিনি আরো বলেন, ‘নিয়মিত ছাত্রসংসদ নির্বাচন হলে শিক্ষার্থীরা লেজুড়বৃত্তি থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের স্বার্থে সংগঠিত হতে পারবে। এতে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীবান্ধব রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি হবে, যা শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ও জাতীয় নেতৃত্বে ভূমিকা রাখার সুযোগ বাড়াবে। অতএব, কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ পুনরুজ্জীবিত করা শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, বরং দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্যও অপরিহার্য। এটি গণতন্ত্রের ভিতকে শক্তিশালী করবে এবং শিক্ষার্থীদের উন্নয়ন ও কল্যাণ নিশ্চিত করবে।’
আরো পড়ুন: ডাকসু নির্বাচন করতে চাই, এতে কোনো সন্দেহ নেই: ঢাবি ভিসি
জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী শায়লা ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করতে এবং শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশে ‘ছাত্র সংসদ’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ছাত্রসংসদ শুধু রাজনৈতিক সংগঠন নয়, এটি শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার একটি শক্তিশালী মাধ্যম।’
তিনি বলেন, ‘জেনারেশন জেড (Gen Z) আরও বেশি তথ্যপ্রবাহে অভ্যস্ত, স্বাধীনচেতা ও নেতৃত্বগুণসম্পন্ন। তারা বিশ্বাস করে, কার্যকর ছাত্র সংসদ থাকলে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে, নেতৃত্ব গঠনের সুযোগ মিলবে এবং ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়বে। আমরা শিক্ষার্থীরা মনে করি, ছাত্র সংসদ থাকলে প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি হবে, যা নীতি-নির্ধারণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তবে এটি দলীয় প্রভাবমুক্ত হোক।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্বচ্ছ ও শিক্ষার্থীবান্ধব কার্যক্রম পরিচালনা করুক। প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে এবং উদ্ভাবনী ভাবনার এই প্রজন্ম মনে করে, ছাত্র সংসদ হতে পারে তাদের মতপ্রকাশের শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম, যেখানে ন্যায়বিচার ও প্রগতিশীলতার জায়গা তৈরি হবে। শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় প্রতিটি শিক্ষার্থী হয়ে উঠবে সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারক ও বাহক।’