গণ-অভ্যুত্থানে শহীদের কথা

মাকে বলে চুল কাটাতে বেরিয়ে যান শিহাব, ফেরেন লাশ হয়ে

ওয়াকিল আহমেদ শিহাব
ওয়াকিল আহমেদ শিহাব  © সংগৃহীত

ফেনীর মহিপালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের গুলিতে নিহত হন ওয়াকিল আহমেদ শিহাব (২০)। গুলি লেগে ঝাঁঝরা হয় শিহাবের শরীর। সেদিন অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরে ফেনী সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে পড়ে থাকা লাশগুলোর মধ্যে তার লাশ শনাক্ত করেন ছোট ভাই ওয়ামিদ আহমেদ সায়েম।

সেদিন প্রথম লাশটির মুখের কাপড় সরিয়ে দ্বিতীয়টির কাপড় সরাতেই ভাইয়ের লাশ দেখে আঁতকে ওঠেন সায়েম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সেদিন হত্যার ভয়াবহ স্মৃতি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের কাছে তুলে ধরেন শহীদ শিহাবের ছোট ভাই আহমেদ সয়েম।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সায়েম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ভাইয়া গত ৪ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে ফেনীর মহিপাল প্লাজায় দোকান খুলতে যান। পরে দুপুর ১২টার দিকে ভাইয়া আবার বাড়িতে এসে আম্মুর সাথে দেখা করে। আম্মু তাকে চুল কাটতে টাকা দিয়ে সেলুনে যেতে বলেন। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ আম্মুর সাথে কথা বলে বিদায় নেয় ভাইয়া। সেটিই ছিল আম্মুর সাথে তার শেষ দেখা। আম্মুর সাথে কথা বলে ভাইয়া সেলুনের দিকে যায়। এরপর ভাইয়ার এক বন্ধু কল করে জানতে চায় আন্দোলনে যাবে কি না। বন্ধুর ফোন পেয়ে সেলুন থেকে বের হয়ে আন্দোলনে চলে যায়।’

সায়েম আরও বলেন, ‘সেখানে গিয়ে বন্ধুদের সাথে আন্দোলনে শামিল হয়, কিন্তু এটি আমরা জানতাম না। আমরা জানতাম ভাইয়া সেলুনে চুল কাটতে গিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সেদিন দুপুরে আমি ভাত খাচ্ছিলাম। তখন আম্মু বলল, শিহাব এত দেরি করছে কেন? তার খোঁজ নে। ভাইয়াকে অনেকবার ফোন দিলেও ধরেনি। ভাইয়া যেখানে কাজ করে সেখানেও খোঁজ নিই। ততক্ষণে তারা জানলেও আমাদের তখন কিছুই বলেনি। বিকেলে সবাই এসব বিষয়ে যখন কথা হচ্ছিল, তখন একজন জানায় তিনি সদর হাসপাতালে আছেন। আমরা ভেবেছি, ভাইয়া কাউকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে, তাই দেরি হচ্ছে। তখনি আমার এক আত্মীয় কল করে জানায় ভাইয়া গুলিবিদ্ধ। এরপর আমি এবং আমার চাচ্চু মিলে হাসপাতালে যাই। পথে কোনো গাড়ি ছিল না। অনেক কষ্ট হয়েছে যেতে। ভাইয়াকে যখন খুঁজছিলাম, তখন জরুরি বিভাগের সামনে তিনটি লাশ পড়ে ছিল। লাশ বুঝে নেওয়ার পর সবাই বলাবলি করছিল, দেরি করলে লাশ গুম করে ফেলবে। তাই তাড়াতাড়ি করে একটা সিএনজি করে লাশ বাড়িতে নিয়ে আসি। সেদিন আম্মু অজ্ঞান ছিল সারা দিন। নিজেকে দোষ দিচ্ছিল কেন চুল কাটাতে বলেছি।‘

ছেলে হারানো শোকে এখনো কাঁদছেন মা মাহফুজা আক্তার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ছেলে সব সময় আমার কাছাকাছি থাকত। সেদিনও আমার সাথে দেখা করে গেছে। কিন্তু কে জানত, সেটিই ছিল শেষ দেখা। দেশের জন্য আন্দোলনে গিয়েছিল আমার ছেলে। খুনিরা তাকে মেরে ফেলল। আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই।’

শহীদ শিহাবের বন্ধু মাসুম আল সামীর দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, “৪ আগস্ট মহিপালে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে আমি শিহাবকে কল করেছিলাম পরিস্থিতি জানতে। শিহাব তখন মহিপালের একটি মোবাইল দোকানে সার্ভিসিংয়ের কাজ শিখছিল। ফোনে শিহাব বলল, ‘আয়, আমিও আছি। কোনো সমস্যা নেই।’ আমরা দুজন মিলে একসঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেব।’

সামীর বলেন, ‘মহিপালে পৌঁছানোর পর শিহাবকে আবার ফোন দিই। তখন সে জানায়, দোকান বন্ধ করে বাড়ি গিয়েছে আন্টির (শিহাবের মা) সঙ্গে দেখা করার জন্য। বাড়ি থেকে কোনো একটা বাহানা দিয়ে মহিপালে ফিরবে বলে জানায়। তখন আমি তাকে আসতে নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু সে শোনেনি।’

সামীর আরও বলেন, ‘সেদিন নামাজের পর গোলাগুলি শুরু হয়। আমার বড় ভাই মাসুদও আন্দোলনে ছিল। গোলাগুলির পর শিহাবকে সঙ্গে নিয়ে আমি আমার বড় ভাইয়াকে খুঁজছিলাম, কিন্তু খুঁজে পাইনি। গোলাগুলির এক পর্যায়ে শিহাব আমার হাত ছেড়ে দেয় এবং আমরা দুজন আলাদা হয়ে যাই। আমি মহিপালে উড়ালসেতুর ওপর উঠি। ভাইকে খুঁজতে খুঁজতে আমি শিহাবের লাশ পড়ে থাকতে দেখি। তার মাথায় গুলি লেগেছিল, মুখ রক্তে ঢেকে গিয়েছিল। তখন আমি তাকে চিনতেই পারিনি। সেদিন আমি আমার ভাই মাসুদ ও বন্ধু শিহাবকে হারিয়ে ফেলি।’

শিহাবের এলাকাবাসী জানান, শিহাব সব সময়ই মানুষের উপকারে কাজ করতেন। রক্তদান কর্মসূচি, সামাজিক কার্যক্রম ও খেলাধুলার সঙ্গে লেগে থাকত তিনি।

আরও পড়ুন: সারজিসের পর এবার সেই পেজের বিরুদ্ধে ঢাবি ছাত্রদল নেত্রীর জিডি

উল্লেখ্য, ওয়াকিল আহমেদ শিহাব ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ কাশিমপুর গ্রামের আফতাব ভূঞা বাড়ির সন্তান। তার বাবা মো. সিরাজুল ইসলাম সৌদি আরবপ্রবাসী। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করা শিহাব ২০২৩ সালে জায়লস্কর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর তিনি ফেনীর মহিপাল প্লাজায় মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ শেখা শুরু করেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে শিহাব বড়।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence