ছাত্র-জনতার আন্দোলন
এক বুলেটই কেড়ে নিল শাহজাহানের প্রাণ, ভূমিষ্ঠ হয়ে দেখবে না প্রিয় বাবার মুখ
- বাসস
- প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৫ PM , আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০০ PM
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ঘাতকের একটি বুলেটই কেড়ে নিয়েছে কতশত স্বপ্ন আর আশা। ভেঙ্গে গেছে সাজানো-গোছানো কত সুখের সংসার। তেমনি একটি ঘটনা ভোলার দৌলতখান উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের ছোটধলী গ্রামের। যেখানে স্বামীহারা ফাতেহা দুঃখ-দুর্দশা আর অসহায়ত্বের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। ফাতেহার স্বামী শাহজাহান আলী (২৪)। আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। সে থেকে ফাতেহার দিন কাটছে চরম অনিশ্চয়তায়।
জানা গেছে, জীর্ণ-শীর্ণ একটি ঘরে মায়ের সাথে আছেন ফাতেহা বেগম(২০)। বাড়িতে কেউ আসলেই ছুটে যান। ভাবেন, হয়ত সরকারের পক্ষ থেকে কেউ তার জন্য সাহায্য নিয়ে এসেছেন।
গত ১৬ জুলাই আন্দোলনের উত্তাল সময়ে ঢাকা কলেজের গেইটের সামনে একটি বুলেট এসে লাগে শাহজাহানের নাকের ডান পাশে। এতে গুরুতর আহত হন তিনি। ছাত্ররা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু হাসপাতালে নেয়ার আগেই তিনি ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।
এতে ছেলেহারা হন মা আয়শা বেগম (৪৫)। স্বামীহারা হয়ে পড়েন বিশ বছর বয়সী ভোলার দৌলতখানের হতভাগ্য গৃহিণী ফাতেহা বেগম। গর্ভে তার ছয় মাসের সন্তান। যে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়ে কখনই দেখবে না তার প্রিয় বাবার মুখ। হয়ত কষ্ট,যন্ত্রণা,অবহেলা আর অনাদরে বড় হতে হবে শিশুটিকে। পরিচর্যা আর অভাবের যাঁতাকলে দুধ কিংবা পুষ্টিকর খাবারও জুটবে না এই শিশুটির। তাছাড়া ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের কষাঘাতে পিষ্ট বাবাহারা এতিম সহায়সম্বলহীন ফাতেহার দায়িত্বই বা কে নেবেন?
অসহায় ফাতেহা জানান, চার বছর আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিল তাদের। ঢাকার কামরাঙ্গির চরে বাসাভাড়া নিয়ে স্বামী-স্ত্রী বসবাস করতেন। স্বামী শাহজাহান ফুটপাথে ‘পাপস’ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তার উপার্জনেই চলছিলো ছোট্র পরিপাটি সংসারটি।
কিন্তু কে জানতো, এমন নির্মমভাবে মর্মান্তিক মৃত্যু হবে শাহজাহানের? লন্ডভন্ড হয়ে যাবে ফাতেহার সাজানো সুখের সংসার!
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শহিদ শাহজাহানের গ্রামের বাড়ি ছিল ভোলার দৌলতখান উপজেলার মেঘনা নদীর মধ্যবর্তী দ্বীপ ইউনিয়ন হাজীপুরে। প্রমত্তা নদীর ভাঙ্গনে তাদের বসতভিটা বিলীন হয়ে গেলে পরিবারটি এলাকা ছেড়ে কাজের সন্ধানে ঢাকায় চলে আসে।
শাহজাহানের মা আয়শা বেগম বাসস’কে জানান, অসুস্থ স্বামী মহসিন মিয়া ও তিন ছেলে শাওন, শাউমিন এবং শাহজাহানকে নিয়ে প্রায় ২৫ বছর আগে ঢাকায় এসে কামরাঙ্গীর চরে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে থাকেন তারা। সেখানকার ৫৬ নং ওয়ার্ড চাঁদ মসজিদ সংলগ্ন ৩ নং গলির ‘ঠাকঠুক ওয়ালা’ নামক এলাকার বাসিন্দা সিরাজ মিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকেন তারা। কিছুদিন যেতে না যেতেই স্বামী মহসিন মিয়া মারা যান।
ফলে অসহায় আয়শা বেগম তার ছোট্ট তিন ছেলেকেই কাজে দিয়ে দেন। নাবালক ছেলেদের রোজগারের টাকায় জীবন সংগ্রামের আরেক অধ্যায় শুরু করেন আয়শা বেগম। ভবিষ্যৎ অবলম্বনের তাগিদে বিয়ে করেন-মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার বিক্রমপুর গ্রামের বাসিন্দা ঈমান আলী(৫৪) নামের একজনকে।
এ বিষয়ে কথা হয় আয়শা বেগমের দ্বিতীয় স্বামী ঈমান আলীর সাথে। তিনি জানান,আয়শা বেগমকে বিয়ের পর থেকে তার আগের স্বামীর তিন ছেলেকে লালন-পালনের দায়িত্বভার তিনিই বহন করেন। আয়শার ঘরে তার একমাত্র কন্যা সন্তান হাফসা বেগম রয়েছেন।
তিনি জানান, ঢাকার নিউমার্কেটের কাছে ঢাকা কলেজের সামনে ফুটপাথে ‘পাপস’ বিক্রি করতেন শাহজাহান। কিন্তু ১৬ জুলাইয়ের উত্তাল সেই দিনটিই যে শাহজাহানের জীবনের শেষদিন হবে তা কে-ই বা জানতো ?
এদিকে ছেলে শাহজাহানকে হারিয়ে মা আয়শা এখন পাগলপ্রায়। তিন ছেলের মধ্যে শাজাহান ছিল মেজো। ছেলের ছবি বুকে নিয়ে এখনো দিন রাত আর্ত বিলাপ আর চোখের নোনাজলে আঁচল ভিজে তার।
তিনি জানান, মৃত্যুর পর সরকারি খরচেই শাহজাহানকে ঢাকার আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে। সরকারি সহায়তা এখনো পাননি। তবে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন।
আয়শা বেগম জানান, ছেলে শাহজাহানের হত্যাকাণ্ডে তিনি ১৭ জুলাই /২০২৪ ইং ঢাকার নিউমার্কেট থানায় মামলা করেছেন। যার নম্বর-৮/৭৬।
এদিকে নিহত শাহজাহানের স্ত্রী ফাতেহা বেগম অভিযোগ করেন, স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুর বাড়িতে আশ্রয় হয়নি তার। বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামির পক্ষ থেকে অর্থ সহায়তা দেয়া হলেও সেই টাকার কানা-কড়িও পাননি তিনি। তার অজান্তেই শ্বশুর-শাশুড়ি সেই টাকা নিয়ে গেছেন। তাদের কাছ থেকে ন্যূনতম সহানুভূতি না মেলায় দুঃখ আর দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে নিরুপায় ফাতেহা এখন স্তম্ভিত।
ফাতেহা জানান, কোন উপায়ান্তর না পেয়ে অসহায় অবস্থায় এখন তিনি বাবার বাড়ি ভোলার দৌলতখানের সৈয়দপুর ইউনিয়নের ছোটধলী গ্রামে মায়ের সাথেই আছেন। গর্ভে তার সন্তান। চিকিৎসা করানোর কোন টাকা নেই তার। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। শারীরিক অসুস্থতায় ডাক্তার দেখাতে পারছেন না।
অসহায়ত্বের ইঙ্গিত দিয়ে ফাতেহা বলেন, ‘এখন বেঁচে থাকার জন্য সহযোগিতা দরকার। সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবো। এছাড়া আমার অন্য কোনো উপায় নেই।’
এদিকে স্বামীহারা ফাতেহার মা কবিতা বলেন, তার মেয়ে শিশু থাকা অবস্থায় স্বামী সাইফুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেন। তাই অসহায় কবিতা বেগম তার মেয়ে ও মেয়ের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। মেয়ে এবং মেয়ের অনাগত সন্তানের ভরণ পোষণ নিয়ে চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন তিনি।
তিনি বলেন,সরকারের সহযোগিতা না পেলে কীভাবে দিন কাটবে আমার মেয়েটির?
এ ব্যাপারে দৌলতখান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়তি রানী কৈড়ি বলেন, শাহজাহানের পরিবারটি খুবই অসহায়। সরকারিভাবে কোনো সহযোগিতা পেলে অবশ্যই তাদের পৌঁছে দেওয়া হবে।
ভোলার জেলা প্রশাসক আজাদ জাহান বলেন, পরিবারটি অনেক কষ্টে আছে। আমি নিজে গিয়ে তার হাতে ২০ হাজার টাকা দিয়ে এসেছি। প্রয়োজনে আরও সহায়তা করা হবে।