‘জয় বাংলা ব্লাড স্কিমের’ আড়ালে সিট দখলের কৌশল রাবি ছাত্রলীগের
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:২৪ PM , আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৩০ PM
গত ২১ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ২৬তম শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠন করা হয়। এতে মোস্তাফিজুর রহমান বাবুকে সভাপতি ও আসাদুল্লা-হিল-গালিবকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। নেতৃত্ব হাতে পেয়ে ক্যাম্পাস প্রবেশ করেই হলগুলোতে চলমান সিট বাণিজ্য ও অবৈধভাবে ‘রুম দখল’ করার কবর রচনা ঘোষণা করেছিলেন নতুন কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
এদিকে কমিটির কয়েক মাস না যেতেই নানা অভিযোগে জড়িয়ে পড়ছেন বর্তমান কমিটির নেতারা। রাবি ছাত্রলীগ আবারও পুরানো রূপে ফিরছেন বলে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ। সিট বাণিজ্য না হলেও হলগুলো থেকে আবাসিক শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠছে। নতুন কমিটি দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে সিট দখলের অভিনব কৌশল হিসেবে ‘জয়বাংলা ব্লাড স্কিমের আড়ালে’ নিয়মিত চলছে ছাত্রলীগের ‘রুম ওয়ার্ক’।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে হলগুলোতে নতুন নেতৃত্ব দিতে শুরু করছেন বর্তমান কমিটি। হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা রক্তের গ্রুপ সংগ্রহের নাম করে শিক্ষার্থীদের খোঁজ খবর নিতে প্রতিদিন তাদের রুমে অবস্থান করছেন। অভিনব কৌশলে হিসেবে ছাত্রলীগ যার নাম দিয়েছেন ‘জয়বাংলা ব্লাড স্কিম’। প্রথমে সালাম দিয়ে শিক্ষার্থীদের রুমে প্রবেশ করেন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। রুমে প্রবেশ করেই ‘জয়বাংলা ব্লাড স্কিম থেকে রক্তের গ্রুপ ও খোঁজ খবর নিতে এসেছি’ আমরা ছাত্রলীগ এমন পরিচয় দিয়ে থাকেন তারা। প্রথমে জানতে চাওয়া হয় কক্ষে অবস্থান করা শিক্ষার্থীর রক্তের গ্রুপ। পরে নাম, সেশন, বিভাগ ও তাদের নাম্বার নিয়ে চলে যান তারা। পরে যদি হলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীর সেশন অনুযায়ী তার সময়সীমা শেষ হয়ে আসলে, তার নাম্বারে যোগাযোগ করে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
আরো জানা যায়, কিছুদিন আগেই শিক্ষার্থীদের রুমে রুমে গিয়ে ব্লাড গ্রুপসহ শিক্ষার্থীদের তথ্য নিয়ে আসেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এদিকে বিসিএস পরীক্ষা শেষ না হতেই আবারও ব্লাডগ্রুপ জানতে শিক্ষার্থীদের কক্ষে প্রবেশ করছেন ছাত্রলীগের নেতারা। রুম ওয়ার্কের জন্য মধ্যরাতেও শিক্ষার্থীদের দরজায় কড়া নাড়েন তারা। এ নিয়ে অনেক সময় শিক্ষার্থীদের সাথে বাকবিতন্ডায় জড়াতেও দেখা যায়। তথ্য সংগ্রহ নিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে অশোভন আচরণের অভিযোগ উঠেছে হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের নামে। এতে অতিষ্ঠ ১১টি আবাসিক হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কাউকে সিট থেকে নামিয়ে দেওয়া ও ওঠানোর পুরো বিষয়ে তদারকি করছেন ছাত্রলীগ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবাসিক হলের ইমরান নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ব্লাডগ্রুপ সংগ্রহের আড়ালে ছাত্রলীগের ‘রুম ওয়ার্কের’ ফলে প্রতিনিয়ত ভয়ে থাকতে হয়। পড়াশোনা শেষ না হলেও, হল সমাপনী হয়ে যাওয়ায় হল ছাড়ার নির্দেশ দেন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। প্রথমদিন আমার তথ্য নিয়েছে। এর পর থেকে টানা তিনদিন আমার রুমে লোক পাঠিয়েছে কবে রুম ছাড়বো। এ নিয়ে আমি মানসিক টেনশনে আছি।
ছাত্রলীগের জয় বাংলা ব্লাড স্কিমের আড়ালে রুমে দখলের অভিনব কৌশল নিয়ে ব্যঙ্গাত্মকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করতে দেখা যায় আদনান মাহিম নামের এক শিক্ষার্থীকে। তিনি তার পোস্টে লিখেন, ‘সরকার খুলেছে সার্বজনীন পেনশন স্কিম আর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংগঠন খুলেছে জয় বাংলা ব্লাড স্কিম। গত একমাস আগেই তারা হলের রুমে এসে সবার তথ্য এবং ব্লাড গ্রুপ লিখে নিয়ে যায় এবং যথারীতি তার পরের দিন আসে মাস্টার্সের কেউ থাকলে তার কতদূর জানার জন্য। আজ আবার সেই পুরানো ঘটনার পুনরাবৃত্তি, বিসিএস পরীক্ষা শেষ মানে আবার রক্তের গ্রুপ দরকার তাই তারা আবার হাজির সবার ব্লাড গ্রুপ জানার জন্য (হা হা রিয়েক্ট)।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জিয়াউর হলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, কিছুদিন আগে মধ্যরাতে আমার রুমে কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী এসে না বলেই ঢুকে পড়েছে। এসেই জয়বাংলা ব্লাড স্কিম থেকে এসেছি বলেই আমার সব তথ্য নিয়ে গেলেন। একজন শিক্ষার্থীর রুমে অনুমতি ছাড়া কোনো ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী প্রবেশের অনুমতি আছে কি না হল প্রশাসনের কাছে এমন প্রশ্ন তার?
জয় বাংলা ব্লাড স্কিমের আড়ালে শিক্ষার্থীদের বিভাগ ও সেশনের তালিকা করে সেই অনুযায়ী তাদের হল থেকে নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবু বলেন, ‘যদি এরকমটা হয় সেটা আমি দেখব তবে আমরা চাই জয় বাংলা ব্লাড স্কিমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সেবা দিতে, সেই অনুযায়ী আমি ছাত্রলীগের কর্মীদেরকে নির্দেশনাও প্রদান করেছি।’
শুধু মাত্র আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদেরই কেন তালিকা করা হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিভাগ কেন্দ্রিক করারও আমাদের প্লান আছে। বিভাগ থেকে শুরু করে হলে যত শিক্ষার্থী থাকে সবার তালিকা আমরা করব। এইটা একটি লম্বা প্রক্রিয়া তবে আমরা শুরু করেছি।’
এ বিষয়ে হল প্রশাসনের পদক্ষেপ কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে হল প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহবায়ক ড. ইকরামুল হক বলেন, ‘কোনো শিক্ষার্থী বা ছাত্র সংগঠন অধিকার নেই হলে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করা। এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো শিক্ষার্থী বা হল প্রাধ্যক্ষ অভিযোগ দেয়নি। যেহেতু বিষয়টি আমি শুনেছি এ নিয়ে প্রাধ্যক্ষ পরিষদে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিব বলে জানান তিনি।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম সাউদ বলেন, ‘হলকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সার্বিক দায়িত্ব হল প্রশাসনের হাতে। জয় বাংলা ব্লাড স্কিমের আড়ালে ছাত্রলীগের ‘রুম ওয়ার্কের’ বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আমি এ বিষয়ে হল প্রশাসনের সাথে কথা বলব এবং পরবর্তী মিটিংয়ে আলোচনা তুলব। কোনো শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য জানার অধিকার আমাদের কারোর নেই, তবে যদি কারো তথ্য জানার থাকে, তাহলে হল প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে সে জানতে পারে।’