‘আমি তো সব হারিয়েছি, আর কিছুই দেওয়ার নেই’

আন্দোলনে আহত ও সহায়হীন দ্বীন মোহাম্মদের দিশাহীন দিন কাটছে।
আন্দোলনে আহত ও সহায়হীন দ্বীন মোহাম্মদের দিশাহীন দিন কাটছে।  © টিডিসি

নিজের অর্থসম্পদ বলতে দুটি ছাগল, একটা ব্যাটারিচালিত অটো রিকশা এবং কিছু নগদ টাকা ছিল। এখন কিছুই নেই। দুই সন্তানের একজন গুরুতর অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য সন্তানকে ডাক্তার কিংবা হাসপাতালে নেওয়ার সামর্থ্যও নেই। ঝড়ের কবলে পড়ে মাথা গোঁজার ঘরটা ভেঙ্গে গেছে। চালগুলো বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। এখন আর থাকার জায়গাটুকু নেই দ্বীন মোহাম্মদের। 

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত হওয়া কক্সবাজার জেলার সদর থানার এই ব্যক্তি জানান, ইতোমধ্যে চিকিৎসা এবং আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে ধার করেছেন প্রায় এক লাখ টাকা। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে একটা এনজিও থেকে কিস্তিতে নিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা। প্রতি সপ্তাহে সেই কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পারায় সেখানেও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন বলে তিনি জানান। 

‘আমি অনুরোধ করছি আপনাদের কাছে, দয়া করে কিছু করুন। আমরা দেশের জন্য লড়েছিলাম। একটু সুস্থ হয়ে নিজের জন্যও লড়তে পারব। কিন্তু অবহেলা, অসম্মান সহ্য করা কঠিন। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের মরে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই —দ্বীন মোহাম্মদ, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ভুক্তভোগী

গত ১৮ জুলাই আন্দোলনে গিয়ে পুলিশের গুলির মুখে পড়েন দ্বীন মোহাম্মদ। চোখের ভেতর বুলেট থাকায় কক্সবাজার থেকে চিকিৎসকেরা তাকে চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকায় যাওয়ার পরামর্শ দেন। তবে টাকা না থাকায় তিনি প্রথমে চট্টগ্রামে আসতে পারেননি। পরে বাড়ি গিয়ে নিজের পালিত দুটি ছাগল বিক্রি করে প্রথমে চট্টগ্রামে আসেন। নিজের আহত হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, ‘আহত হওয়ার পর থেকে জীবনটা বিষণ্ন হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে সবকিছু হারিয়েছি। আমার আর দেওয়ার কিছু নেই। নতুন করে উপার্জনের চেষ্টা করব, সেই সামর্থ্য নেই। এখন পর্যন্ত কারও থেকে এক পয়সাও পাইনি।’

দ্বীন মোহাম্মদ জানান, ছাগল বিক্রির পর চট্টগ্রামে ১০ দিন চিকিৎসা নিলে আবারও টাকা শেষ হয়ে যায়। এদিকে দুটি ছাগলের যে বাজার মূল্য ছিল সেটাও তিনি পাননি। বরং নিজের চিকিৎসা ভার বহন করতে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, ‘আমার একেকটি ছাগলের বাজার মূল্য অন্তত ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা ছিল। কিন্তু বাধ্য হয়ে দুটি ছাগল ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেই।’

২২ জুলাই চট্টগ্রাম মেডিকেলে এসে ভর্তি হন, সেখানে ১০ দিন চিকিৎসা শেষে আবার বাড়ি ফিরে যান দিন মোহাম্মদ। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, চট্টগ্রামে এক পয়সাও ছাড় দেননি ডাক্তররা। বরং শেখ হাসিনার সরকারের পতনের আগে সেই সময়ে ১০ দিন চিকিৎসা নিতে গিয়ে পুলিশি হেনস্তা এবং নানা রকম বঞ্চনার মুখে পড়তে হয় তাকে। 

‘কিন্তু এ পর্যন্ত আমার কাছে কেউ সাহায্য নিয়ে আসেনি। আমার খোঁজও কেউ নেয়নি। সবাই আসে, তালিকা করে। কিন্তু আমার এই মুহূর্তে যেই সাপোর্টটা দরকার, পরিবার চালানোর মতো সহযোগিতা কেউ দেয়নি। অনেকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোন সাড়া পাইনি —দ্বীন মোহাম্মদ, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ভুক্তভোগী

কক্সবাজার থেকে চিকিৎসার জন্য ২২ জুলাই চট্টগ্রামে আসার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন দ্বীন মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘অসুস্থ শরীর নিয়ে সেদিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসতে আমাকে ৬টি গাড়ি পরিবর্তন করতে হয়। একটা অ্যাম্বুলেন্স নিতে চাইলে সেটাও পাইনি। তখন কারফিউ থাকায় কোন গাড়ি চলাচল করছিল না। একটা অ্যাম্বুলেন্স নিতে চাইলে ৮ হাজার টাকা দাবি করে। পরে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন গাড়ি পরিবর্তন করে আসি।’ 

চিকিৎসকের বরাত দিয়ে তিনি জানান, এখনও তার চোখের ভেতর ছররা বুলেট রয়েছে ৩টি, মাথায় ১টি, কানের গোড়ায় ১টি, পেটে ৪টি, বাম হাতে ৩টি এবং কাধে ১টি। বুলেটের যন্ত্রণার কথা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘মনে হয় মাথার মগজটা লাফাতে থাকে। এখানে ডাক্তাররা যেটুকু পেরেছেন চিকিৎসা করেছেন। কিন্তু বুলেটগুলো বের হয়নি। হাঁটতে গেলে মাথার উপর হাত দিয়ে চেপে ধরে হাঁটতে হয়। এটা অসহ্য যন্ত্রণার, আপনাকে মুখে বলে বুঝাতে পারব না।’ 

আরও পড়ুন: ‘আমাকে এখন পর্যন্ত কেউ দেখতে আসেনি, কারণ আমার পরিবারে কেউ নেই’

আন্দোলনে আহত হয়ে আংশিক চিকিৎসাশেষে গত জুলাইয়ের শেষে যখন দ্বীন মোহাম্মদ বাসায় ফেরেন তখন কিস্তিতে নেয়া ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার কিস্তি পরিশোধ করতে পারছিলেন না। তখন সেই অটো রিকশাটাও ফেরত নিয়ে যান মালিক। জীবিকা নির্বাহের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে এখন পথে বসেছেন তিনি। আহত ও ব্যথিত এ যোদ্ধা জানান, ‘শুনেছি অনেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। বিভিন্ন এনজিও কিংবা সমন্বয়করা অনেককে সহযোগিতা করেছেন বলে জেনেছি। কিন্তু এ পর্যন্ত আমার কাছে কেউ সাহায্য নিয়ে আসেনি। আমার খোঁজও কেউ নেয়নি। সবাই আসে, তালিকা করে। কিন্তু আমার এই মুহূর্তে যেই সাপোর্টটা দরকার, পরিবার চালানোর মতো সহযোগিতা কেউ দেয়নি। অনেকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোন সাড়া পাইনি।’

দ্বীন মোহাম্মদ জানান, গত ৪ অক্টোবর থেকে তিনি রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তার চোখের অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। এখানে চিকিৎসা পেলেও শরীরের বুলেটগুলো বের না হওয়ায় যন্ত্রণা নিয়ে দিন পার করছেন তিনি। এখন সবচেয়ে বড় বাঁধা দেনা পরিশোধ করা এবং পারিবারিক ভরনপোষণের ব্যবস্থা করা। 

আরও পড়ুন: শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের করণীয়

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি জানান, ‘আমার প্রতি সপ্তাহে কিস্তির দেড় হাজার টাকা দিতে হয়। এর বাইরে ঝড়ে ঘর ভেঙ্গে যাওয়ায় থাকার জায়গা নেই। পরিবার চলার কোন ব্যবস্থা নেই। আমি অনুরোধ করছি আপনাদের কাছে, দয়া করে কিছু করুন। আমরা দেশের জন্য লড়েছিলাম। একটু সুস্থ হয়ে নিজের জন্যও লড়তে পারব। কিন্তু অবহেলা, অসম্মান সহ্য করা কঠিন। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের মরে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমার যা কিছু ছিল তাই দিয়ে সংসার চলে যেতো, মাসিক ৩০ হাজার টাকা উপার্জন ছিল। তিন মাসে আমার এক লাখ টাকা আয় হতো। অথচ আহত হয়ে হাসপাতালে থাকায় এ সময়ে উল্টো লাখ টাকার ঋণের বোঝা মাথায় চেপেছে। সাথে দিনের পর দিন অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণা সয়ে যাচ্ছি। উপদেষ্টারা আমাদের জীবনের বিনিময়ে চেয়ার পেয়েছেন, কিন্তু আমরা কি শুধু যন্ত্রণাই সয়ে যাব? সবই তো হারিয়েছি, এখন শুধু সুস্থভাবে বেঁচে থাকার আকুতি করছি।’


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence