সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে ‘আমাদের পাঠশালা’
- জুনাইদ সিদ্দিকী, বিএম কলেজ
- প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৩, ১১:৪৬ AM , আপডেট: ১৯ আগস্ট ২০২৫, ১১:২২ AM
ধান, নদী, খাল এই তিনে বরিশাল। সেই বরিশাল নগরীর পাশ দিয়ে অবিরাম বয়ে চলা কীর্তনখোলা নদীর তীরে গড়ে উঠেছে মুক্তিযোদ্ধা পার্ক। এই পার্কের সবুজ শ্যামল গাছের ছায়া আর মুক্ত বাতাসে প্রতিদিন ঘুরতে আসেন বহু মানুষ। তবে প্রতি শুক্রবার সকালে এখানে ঘুরতে আসা মানুষের চোখ আটকে যায় পার্কের ডান প্রান্তের রাস্তায়। যেখানে দেখা যায়- পার্কের মধ্যে পুরনো ব্যানার, পলিথিন কিংবা চট বিছিয়ে সুবিধা বঞ্চিত এবং স্কুল থেকে ঝড়ে পড়া শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়ানোর প্রাণন্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে একদল তরুণ-তরুণী। নিজেদের মানবিক দায়বোধ থেকে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বিনামূল্যে প্রায় ৬ বছর যাবত এই কাজ করছে ‘সোস্যাল নেটওয়ার্ক ফর ডিসএ্যাডভান্টেজড চিলড্রেন’ যা এসএনডিসি নামে সমধিক পরিচিত। এসএনডিসির অনেকগুলো সামাজিক কাজের মধ্যে ‘আমাদের পাঠশালা’ এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল আলোচিত। বরিশালের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একঝাঁক তরুণ-তরুণীর স্বেচ্ছাশ্রমে পরিচালিত অসহায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সুন্দর আগামী গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করছে।
এসএনডিসি এবং আমাদের পাঠশালা'র প্রতিষ্ঠাতা তানজীল ইসলাম শুভ জানান, আমাদের অধিকাংশ তরুণ সমাজ যেখানে সারাদিন মোবাইল, ফেইসবুক, গেইমসহ নানা ধরণের আড্ডায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করছে, ঠিক সেই সময়ে আমরা নীরবে -নিভৃতে সুবিধা বঞ্চিত শিশু এবং নিরক্ষর মানুষদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। নিজেদের মানবিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এসএনডিসি’র সদস্যরা সম্মিলিতভাবে মহৎ এই কাজ করে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: অদম্য ৩০ নারীর মিনি গার্মেন্টস
শুক্রবার বরিশাল নগরীর মুক্তিযোদ্ধা পার্ক ঘুরে দেখা যায়, প্রায় শতাধিক সুবিধা বঞ্চিত শিশুকে পাঠদান করাচ্ছেন এসএনডিসি’র সদস্যরা। শিশুরাও মনের আনন্দে গ্রহণ করছে জ্ঞানের আলো। অনুভব করা গেল- ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে এখানকার প্রতিটি শিশু, যেন কোন জড়তাই নেই তাদের মনে।
নগরীর বরফকল এলাকার শিশু আসমা ও সালমা। সম্পর্কে ওরা আপন বোন। ওদের সাথে কথা বলে জানা গেল, প্রতি শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত এই পার্কে পড়তে আসে তারা। তাদের বাবা দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। সরকারি কোনো স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি তাদের। এসএনডিসির সদস্যরা তাদের বাসায় গিয়ে বিনা খরচে পাঠদানের আহবান জানালে সাড়া দেন আসমা ও সালমার বাবা-মা। সেই থেকে গত কয়েকমাস যাবৎ ‘আমাদের পাঠশালা’য় পড়তে আসে তারা। তারা জানায়, এখানে পড়তে আমাদের খুবই ভালো লাগে। এখানকার স্যার ও ম্যাডামরা আমাদের খুবই আদর করেন।
আরও পড়ুন: এক-দুই পিস মাছ-মাংস বিক্রি করেন রাবি ছাত্র, দিচ্ছেন হোম ডেলিভারি
বরফকল এলাকার ৭ বছরের শিশু সুবর্ণা জানায়, এখানে লেখাপড়া করে সে বাংলা অক্ষর- স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ, ইংরেজি অক্ষর ও গণিতের সংখ্যা এক থেকে একশ পর্যন্ত গুনতে শিখেছি। এখানকার স্যার ও ম্যাডামরা তাদের নিয়মিত পাঠদানের পাশাপাশি ছড়া এবং গান শেখান বলে কোনো ক্লাসই বাদ দেই না।
শুক্রবার আসলেই সুবর্ণার মতো লঞ্চঘাট, ভাটারখাল এবং বরফকল এলাকার অনেক শিশুরাই পড়তে আসে তাদের সবার প্রিয় ‘আমাদের পাঠশালা’য়।
বরিশাল মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ও আমাদের পাঠশালা'র পরিচালক নন্দিনী তিথি জানান, আমাদের বর্তমান সমাজের অধিকাংশ কাজই যখন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা বরিশালের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিঃস্বার্থভাবে জ্ঞানের আলো ছড়ানোর এই কাজটি করে যাচ্ছি। প্রতিবছর আমাদের এই স্কুল থেকে ১০ জন করে শিশুকে আমরা পূণরায় স্কুলে ভর্তি করে দিচ্ছি । যাতে করে তারা আবারও স্কুলের সাধ পায়।
আরও পড়ুন: রিকশা চালিয়ে পড়ালেখা করা মমিন এখন প্রভাষক
এসএনডিসি'র সভাপতি শফিকুল ইসলাম (ডালিম) বলেন, আমরা সবাই নিজেদের সাধ্যমত চাঁদা দিয়ে এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি পরিচালনা করছি । নিজেরা স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়ে যাচ্ছি। সমাজের বিত্তবান ও সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমাদের এই সামাজিক কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে বলে আমি আশি করি।
তরুণ শিক্ষার্থীদের এই মহতি উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন স্থানীয়রা। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এসএনডিসি’র অন্যতম শাখা ‘আমাদের পাঠশালা’র কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮ সালের ৫ই এপ্রিল। এখন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানে প্রায় কয়েক হাজার সুবিধা বঞ্চিত আর নিরক্ষর মানুষ শিক্ষা নিয়েছে এবং নিচ্ছে। এছাড়াও এসএনডিসির আরো ২টি শাখা রয়েছে। তা হলো এসএনডিসি ফুড ব্যাংক ও ব্লাড ব্যাংক। এই শাখাগুলোর মাধ্যমেও তারা সমাজের নিম্নশ্রেণীর লোকদের মাঝে স্বাস্থ্য সেবার কাজ করে যাচ্ছে।
এছাড়াও সংগঠনটি প্রতিটি ঈদ, কুরবানী এবং জাতীয় দিবস সমূহে পথশিশুদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। ঈদে পথশিশুদের নতুন জামা প্রদান, রমজানে সবার জন্য ইফতার, জলবায়ু অবরোধ, কিশোর কিশোরীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা, শীতে কম্বল বিতরণসহ আরও নানা রকম সামাজিক কাজ করে আসছে।