গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে আশা-নিরাশার দোলাচলে কম নম্বরপ্রাপ্তরা
- আরিফুল ইসলাম তামিম
- প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২১, ০৩:১৪ PM , আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২১, ০৪:২১ PM
প্রথমবারের মতো সরকারি ২০টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তি কমাতে এই উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটি এখন বিষাদে পরিণত হয়েছে। কারণ, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা এবং পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে তাদের ব্যয়, ভোগান্তি, অনিশ্চয়তা সবই বেড়েছে।
এবার গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা পরবর্তী ভর্তি প্রক্রিয়া পদ্ধতি নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। এই পরীক্ষায় মেধাতালিকা না দিয়ে ফলাফলে শুধু প্রাপ্ত নম্বর প্রকাশ করায় ভর্তি প্রক্রিয়ায় এসে চরম ভোগান্তি পড়েছে শিক্ষার্থীরা।
গুচ্ছ অধিভুক্ত ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পরীক্ষা পরবর্তী ফের ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত ভর্তি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট ‘ফি’ প্রদানের মাধ্যমে আবেদন করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। একসঙ্গে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে মোটা অংকের অর্থের প্রয়োজন ভুগিয়ে তুলছে দেশের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের। তাই স্বস্তির গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি যেন এখন অস্বস্তিতে রূপ নিয়েছে।
এমন ভর্তি প্রক্রিয়া ও আবেদন ফি নিয়ে ভর্তিচ্ছুরা সরব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সবচেয়ে বেশি হতাশায় রয়েছে কম নম্বরপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা। একদিকে অর্থাভাবে আবেদন করতে না পারার চিন্তা অন্যদিকে আবেদন করার পরেও কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সুযোগ হবে কিনা তা নিয়ে আশা-নিরাশার দোলাচালে এসব শিক্ষার্থীরা। এছাড়া গুচ্ছের ভর্তি প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ, জটিল ও ব্যতিক্রম হওয়ার দুশ্চিন্তায় আছে অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
তবে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে থেকেই বলা ছিল যে, ভর্তি পরীক্ষার পর শুধু ফল জানিয়ে দেওয়া হবে। সেখানে কেউ ফেল করবে না, আবার পাসও করবে না কেউ। তারপর সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের নিজস্ব শর্ত অনুযায়ী ভর্তি করাবে।
আরও পড়ুন: গুচ্ছের ‘এ’ ইউনিটে সর্বোচ্চ নম্বর ৯৫, ‘বি’ ইউনিটে ৯৩.৭৫
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে অনিশ্চয়তা প্রসঙ্গে ফেনীর থেকে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী মো. জাহেদুল হক বলেন, গুচ্ছে সর্বপ্রথম সিট প্ল্যানিং নিয়ে চরমভাবে ভোগান্তির শিকার শিক্ষার্থীরা। ফেনী থেকে আমার অনেক সহপাঠীরা পটুয়াখালীতে পরীক্ষা দিতে গিয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। এছাড়া ফলাফলের গরমিলসহ সর্বশেষ গুচ্ছের ভর্তি প্রক্রিয়ায় স্বস্তির চেয়ে অস্বস্তিই সবচেয়ে বেশি।গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া এখন অনেকটা টাকার উপর নির্ভরশীল। যারা মাঝারি মানের নম্বর পেয়েছে তারা ভর্তির সুযোগ পেতে বেশিসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে হবে। ফলস্বরূপ অনেক অর্থের প্রয়োজন, সেইসঙ্গে অনিশ্চয়তা থাকছেই। অথচ গুচ্ছ আয়োজনের মূল উদ্দেশ্যই ছিলো শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ লাঘব।
আরও পড়ুন: গুচ্ছের ফল প্রকাশ: সর্বোচ্চ নম্বর ৯৫, অধিকাংশ পেয়েছে ৫০ এর নিচে
চট্টগ্রাম থেকে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী শেখ মাইনুর রহমান বলেন, গুচ্ছ পরীক্ষা হওয়ার কথা শুনে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলাম, কারণ ভোগান্তির মুক্তি মিলবে। কিন্তু পরীক্ষা শুরু হওয়া থেকে এখন ভর্তি প্রক্রিয়ায় এসে বুঝতে পারছি আমাদের ভোগান্তি উল্টো বেড়েছে। ১২০০ টাকা আবেদন ফি দিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার পর ভর্তি প্রক্রিয়ায় ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক বিভাগে আলাদা করে ফি নিয়ে আবেদন করার বিষয়টি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এছাড়া আমার এবং আমার মতো যাদের বিষয়ভিত্তিক নম্বরসহ প্রাপ্ত নম্বর কম তারা কোথায় আবেদন করলে ভর্তি হতে পারবে সেটা নিয়ে সংশয় চরমে।কর্তৃপক্ষ চাইলে মেডিকেলের ভর্তি প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করে পরীক্ষার্থীদের পছন্দমতো বিষয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক একটা মেধাতালিকা দেওয়া উচিত ছিলো, যাতে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে পরীক্ষার্থীরা তাদের পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়তে পারবে।
আরেক পরীক্ষার্থী শ্রাবণী নাথ বলেন, গুচ্ছ ভুক্ত ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া এখন পদার্থ বিজ্ঞানের মতো জটিল সমীকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরীক্ষায় ৪০-৪৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরাও এখন অনুমান করতে পারছে না ঠিক কোথায় আবেদন করলে ভর্তির সুযোগ হবে?শঙ্কা এড়াতে ইচ্ছে হয় একাধারে সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি আবেদন করি। এতো আশা, এতো স্বপ্ন, এতো পরিশ্রম সব তো আর এভাবে মাটিতে মিশতে দেওয়া যায় না। কিন্তু অর্থের কাছে যেন এখন স্বপ্ন বন্দি। ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি আবেদন করতে মোটা অংকের অর্থ প্রয়োজন যা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য কঠিন সমীকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা যেন কষ্ট লাঘবের আশা জাগিয়ে সবাইকে কাঙাল করে দেওয়ার সর্বোত্তম উপায়।
আরও পড়ুন: গুচ্ছের ‘সি’ ইউনিটে সর্বোচ্চ নম্বর ৯১.২৫
ফেনী থেকে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী আলিফুল ইসলাম প্রান্ত বলেন, আমরা সবাই ভেবেছিলাম প্রতি বছর আলাদা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে আলাদা আবেদন ফি, যাতায়াত খরচসহ নানাধরণের ভোগান্তিতে পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের৷ তাই গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা হলে দুর্ভোগ ও খরচ অনেকটা সাশ্রয় হবে। কিন্তু পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ভর্তি প্রক্রিয়ায় এসে দেখা যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের উল্টো আরও বেশি খরচ বহন করতে হচ্ছে। এত বেশি টাকা খরচ করে আবেদন করার পরও পছন্দসই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হবে কিনা এ ব্যাপারেও কোনো সঠিক নিশ্চয়তা নেই। সব মিলিয়ে বলা যায়, গুচ্ছতে শিক্ষার্থীদের সুবিধা একটাই হয়েছে, সেটি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের একটি মাত্র পরীক্ষা দিতে হয়েছে। কিন্তু খরচের পরিমাণ, ভোগান্তি, ভর্তির অনিশ্চয়তা এসব অসুবিধা কিংবা ভোগান্তির পরিমান এত বেশি যে ওই একটি সুবিধা এই অসুবিধাগুলোর কাছে কিছুইনা।
আরও পড়ুন: গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে সর্বোচ্চ নম্বর ৯৩.৭৫
চট্টগ্রাম থেকে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পদ্ধতি একটি অপরিকল্পিত বাস্তবায়ন। একজন পরীক্ষার্থীকে কেবল মোট নম্বর ও বিষয়ভিত্তিক নম্বর জানানো হলেও দেয়া হয়নি কোন ধরণের মেরিট পজিশন। যার ফলে কম বা বেশি যে ধরণের ফলাফল অর্জন করুক না কেন, একজন পরীক্ষার্থী জানতেই পারছে না সে কত নম্বর পজিশনে এসেছে? সে কি অদৌ তার পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে পারবে? বিশেষ করে মাঝারি মানের নম্বর প্রাপ্ত হাজার হাজার শিক্ষার্থীই এখন বুঝতে পারছে না তারা কি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের যোগ্যতা অর্জন করেছে কিনা?
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের জন্য বেধে দেওয়া হলো অনেকগুলো টাকার পরিমাণ। যার ফলে অগত্যা পরীক্ষার্থীদেরকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে আবেদন করতে হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এরপরও সে নিশ্চিত না সে কি তার পছন্দসই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে নাকি। বলা যায়, গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা একটি ভুলে ভরা পদ্ধতি, যেটি শিক্ষার্থীদের জন্য মোটেই শিক্ষার্থীবান্ধব নয়।
এদিকে গুচ্ছভুক্ত ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি আবেদন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে অন্তত ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকা। সেক্ষেত্রে একটি হিসেবে দেখা যায়, একজন শিক্ষার্থী যদি ২০টি ভর্তি আবেদন করতে চায় (গড়ে ৬০০ টাকা) সেক্ষেত্রে তার শুধু আবেদন করতেই খরচ হবে ১২ হাজার টাকা।
অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের ভর্তি আবেদনেই একটি মোটা অংকের অর্থ প্রয়োজন হচ্ছে এছাড়া আবেদন পরবর্তী নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রেও বিপুল পরিমাণ টাকার প্রয়োজন হবে। ফলে এ প্রক্রিয়ায় অর্থের কাছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন ঝরে যাওয়ার উপক্রম তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করা শর্তে গুচ্ছভুক্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সব শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত স্কোর (১০০ এর মধ্যে) প্রকাশ করেছি। সমন্বিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের মতো আলাদা করে ভর্তি নির্দেশিকা প্রকাশ করে, সে অনুযায়ী স্কোরের ভিত্তিতে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করবেন। তাছাড়া এ বিষয়টি ভর্তি কার্যক্রম শুরু আগেও বলা হয়েছে বলে তিনি জানান।
গুচ্ছ ভর্তি কমিটির সদস্য ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ছাদেকুল আরেফিন বলেন, সিদ্ধান্ত ছিল তিনটি ইউনিটের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবার পর প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা আলাদাভাবে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি ও ফিসহ যাবতীয় বিষয় নির্ধারণ করবে। এরপর প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজস্ব নিয়ম ও আইন অনুযায়ী একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে ভর্তি ফি নির্ধারণ করছে। তাই ফি কমানো বা এ সংক্রান্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ গুচ্ছ কমিটির নেই।