জাল নথিপত্র ও মিথ্যা ফটোকার্ড তৈরি: শরিয়া ও নৈতিকতা 

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি   © সংগৃহীত

বর্তমান সমাজে এক গভীর নৈতিক বিপর্যয়ের নাম হলো জাল নথি তৈরি এবং মিথ্যা তথ্য প্রচার করা। কেউ যখন নিজের পরিচয় বা বাস্তব তথ্য গোপন করে কারো নামে মিথ্যা ফটোকার্ড, জাল সনদ বা নকল দলিল প্রচার করে—ইসলামী শরীয়া এটিকে “তাজউইর" (تزوير) বলে। এই তাজউইর কেবল নথি তৈরির পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়; বরং মিথ্যা তথ্য প্রচার, শেয়ার করা বা প্রচারণার মাধ্যমে ছড়ানো—এসবও তাজউইরের অন্তর্ভুক্ত। কারণ ইসলামে মিথ্যা বলা যেমন হারাম, তেমনি মিথ্যা প্রচার করাও সমান গুনাহ।

তাজউইর: শব্দিক অর্থ ও পরিচিতি
আরবি শব্দ تزوير এসেছে ক্রিয়া زوّرَ – يُزَوِّرُ – تزويرًا থেকে, যার ভাষাগত অর্থ “تحريف الحقيقة وتزيين الباطل”, অর্থাৎ সত্য বিকৃত করা ও মিথ্যাকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে উপস্থাপন করা। কেউ যখন কোনো বাস্তব তথ্য গোপন করে বা ভুল তথ্যকে সত্যের রূপ দেয়, তখন সে তাজউইরকারী (مُزَوِّر) হিসেবে পরিচিত হয়। মিথ্যা ফটোকার্ড তৈরি, প্রচার বা তা শেয়ার করাও তাজউইর। এসবের মাধ্যমে সত্য বিকৃত হয় এবং মানুষ প্রতারিত হয়।

কুরআন-হাদিস: সত্য বিকৃতি নিষিদ্ধ 
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلَا تَلْبِسُوا الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُوا الْحَقَّ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ
“তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশিও না এবং জেনে-বুঝে সত্য গোপন করো না।” [আল-কুরআন, ২:৪২]
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আলেমগণ বলেন, যে কেউ সত্য বিকৃত করে, তথ্য গোপন করে, অথবা মিথ্যা প্রচার করে—সে এ নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত। অতএব, জাল ফটোকার্ড তৈরি করা যেমন হারাম, তেমনি সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যা ফটোকার্ড প্রচার বা শেয়ার করাও সমানভাবে হারাম ও তাজউইরের অন্তর্ভুক্ত।

আরও পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাড়ছে যৌন হয়রানি, কাগজে-কলমে প্রতিরোধে সেল থাকলেও নেই কার্যক্রম

রাসূলুল্লাহ (সা.) সততার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন:
مَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا 
অর্থাৎ “যে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” [মুসলিম, আস-সহিহ, ১০১]

এই হাদীসটি কেবল ব্যবসায়িক প্রতারণা নয়, বরং সকল প্রকার তথ্য ও নথিগত প্রতারণাকেও অন্তর্ভুক্ত করে। যে ব্যক্তি মিথ্যা ফটোকার্ড তৈরি বা প্রচার করে, সে সমাজকে প্রতারিত করছে। আরও একটি হাদীসে তিনি বলেন:
أَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ؟ قَالُوا: بَلَى. قَالَ: الإِشْرَاكُ بِاللَّهِ، وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ، وَقَوْلُ الزُّورِ وَشَهَادَةُ الزُّورِ.
“আমি কি তোমাদের জানাবো মহাপাপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়গুলো কী? ... তিনি বললেন— আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা, এবং মিথ্যা কথা (قول الزور) ও মিথ্যা সাক্ষ্য (شهادة الزور) প্রদান করা।” [বুখারি, আস-সহিহ, ৫৫৫১]
সুতরাং, মিথ্যা তথ্য প্রচার করা, ভুয়া ছবি বা ফটোকার্ড ছড়ানো—এসবই قول الزور (মিথ্যা কথা) এবং شهادة الزور (মিথ্যা সাক্ষ্য)-এরই বাস্তব রূপ।

ফিকহি ও নৈতিক বিশ্লেষণ
শরিয়া যে তাজউইর প্রতারণা বা ক্ষতির কারণ হয়, তা হারাম করেছে। ইমাম নববী (রহ.) বলেন— “যে ব্যক্তি জাল দলিল, মিথ্যা প্রমাণ বা ভুল তথ্যের মাধ্যমে সুবিধা নেয়, সে গুনাহগার এবং তার সে সুবিধা বাতিল।” [আল-মাজমূ‘, ২০/১৪২] এ থেকে স্পষ্ট হয়— যিনি মিথ্যা নথি তৈরি করেন এবং যিনি তা প্রচার করেন, উভয়েই গুনাহগার। কারণ প্রচারক না থাকলে মিথ্যা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।

সামাজিক ক্ষতি ও নৈতিক অবক্ষয়
তাজউইর সমাজে বিশ্বাস ও ন্যায়বোধকে ধ্বংস করে দেয়। জাল নথি বা মিথ্যা তথ্য প্রচার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা, ও প্রশাসনে আস্থার সংকট সৃষ্টি করে। ফলস্বরূপ, সত্যবাদী মানুষ অবমূল্যায়িত হয়, আর মিথ্যাচারীরা সুযোগ পায়। ইসলামী সমাজব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে সত্যবাদিতা (صدق) ও আমানতদারি (أمانة)। সুতরাং মিথ্যা ফটোকার্ড তৈরি বা প্রচার উভয়ই ইসলামের মৌলিক নৈতিকতার পরিপন্থী অপরাধ।

পরিত্রাণ: তাওবা ও আত্মসংশোধন
যদি কেউ কখনো জেনে বা না জেনে মিথ্যা নথি তৈরি করে বা শেয়ার করে থাকে, তার উচিত অবিলম্বে তাওবা করা এবং ভবিষ্যতে সততা বজায় রাখা। আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِلَّا مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَأُولَٰئِكَ يُبَدِّلُ اللَّهُ سَيِّئَاتِهِمْ حَسَنَاتٍ
“যে তাওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকাজ করে — আল্লাহ তার মন্দ কাজগুলোকে ভালো কাজে পরিণত করে দেন।” [আল-কুরআন, ২৫:৭০]

ইসলামে কাওলুয জুর বা মিথ্যা বলা, শাহাদাতুয জুর বা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, তাজউইর বা বানোয়াট তৈরি করা ভয়াবহ গুনাহ। মিথ্যা তথ্য প্রচার, জাল ফটোকার্ড তৈরি বা তা প্রচার—এসবই সমাজ ধ্বংসকারী কাজ এবং ইসলামে হারাম। ইসলাম চায় মানুষ সত্যবাদী হোক, আমানত রক্ষা করুক এবং ন্যায়ের পথে অটল থাকুক। অতএব, সত্য কথা বলা যেমন ঈমানের দাবি, তেমনি মিথ্যা তথ্য বা ফটোকার্ড প্রচার থেকে বিরত থাকাও ঈমানেরই অংশ। একজন প্রকৃত মুসলমান কখনোই এমন কাজে যুক্ত হতে পারে না, যা সত্য, ন্যায় ও ইসলামী মূল্যবোধের পরিপন্থী।

লেখক: ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ