‘ড্যাম কেয়ার’ দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যরা

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান উপাচার্যবৃন্দ
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান উপাচার্যবৃন্দ  © ফাইল ছবি

দ্বিতীয় মেয়াদে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য হিসেবে চার বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। এর আগে ২০২১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি উপাচার্য হিসেবে প্রথম মেয়াদে চার বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি। প্রথম মেয়াদ শেষে গত বছরের মাঝামাঝে দ্বিতীয় মেয়াদেও পুনঃনিয়োগ পান অধ্যাপক ফরিদ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অসদাচরণসহ বিভিন্ন অভিযোগে গত ১৩ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হলে পরবর্তীতে তা উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রূপ নেয় আন্দোলন। এই দাবিতে আন্দোলন এখনও প্রত্যাহার করেননি আন্দোলনকারীরা।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদ নিজের মত করে বিশ্ববিদ্যালয় চালাতেন; কারও মতামত নিতেন না। শিক্ষার্থীদের কথা বলার অধিকারও তিনি কেড়ে নিয়েছিলেন। দ্বিতীয় মেয়াদে পুনঃনিয়োগ পেয়ে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদ হোসেন অপূর্ব বলেন, আমরা কোনো দাবি নিয়ে গেলে উপাচার্য গুরুত্বই দিতেন না। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের কোনো কর্মসূচিই পালন করতে দিতেন না। এমনকি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনেও তিনি বাধা দেন।

আরও পড়ুন: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার সিঁড়ি ঢাবি শিক্ষক সমিতি

শুধু শাবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ নয়, দেশের বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যারাই দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্যের পুনঃনিয়োগ পেয়েছেন তাদের অনেকের মধ্যেই এক ধরনের ‘ড্যাম কেয়ার ভাব’ লক্ষ্য করা গেছে।

এরমধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সাবেক উপাচার্য আব্দুস সোবহান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মো. ফায়েক উজ্জামান ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম এ মান্নান উল্লেখযোগ্য।

২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বে পালন করেন অধ্যাপক আবদুস সোবহান। দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৭ সালে এসে সরকার আবার তাকে উপাচার্য পদে নিয়োগ দেয়। তারপর স্বজনপ্রীতিসহ মেয়াদের শেষের দিকে ১৩৭ জনকে গণনিয়োগ দিয়ে হৈ চৈ ফেলে দেন। তার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতিসহ নানা অনিয়ম তদন্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)।

আরও পড়ুন: শাবিপ্রবি উপাচার্যকে সরানো হচ্ছে

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রপ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক মু. আলী আসগর দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে অধ্যাপক আবদুস সোবহান ব্যাপক স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি করেন। উনার মধ্যে ‘ড্যাম কেয়ার’ ভাব চলে এসেছিল। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয়বার নিয়োগ পেয়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মধ্যে এই বেপরোয়া ও স্বৈরচারী মনোভাব দেখা গেছে। সর্বশেষ শাবিপ্রবি উপাচার্যের বিষয়টিতো সবার জানা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন। আগামী মার্চে তার মেয়াদ শেষ হবে। প্রথম মেয়াদের শেষের দিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অভিযোগ সত্বেও দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পান তিনি। ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর একনেকের বৈঠকে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন পায়। পরে এ প্রকল্প ঘিরে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠে। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও উপাচার্যপন্থী শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাছাড়া পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের বিরূদ্ধে।

আরও পড়ুন: দ্বিতীয় মেয়াদে কাউকে ভিসি নিয়োগ না দেওয়ার সুপারিশ

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এটা আসলে উপাচার্যের মেয়াদের সাথে সম্পর্কিত না বরং সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন উপাচার্য চায় এবং উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে। সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকেই উপাচার্য বানান যিনি সরকারের তোষামুদে একটি শ্রেণি তৈরি করতে পারে তিনি শিক্ষাবান্ধব কিনা তা ব্যাপার না। আর যিনি সরকারের ইচ্ছা পূরণ করতে পারেন তিনিই দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য হন।

“জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত করার কথা বলেছিল সরকার, কিন্ত তা তো হয় নি বরং অভিযোগকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কাছ থেকে সরকারের প্রত্যাশা কি এখান থেকেই স্পষ্ট হয়।”

গত বছরের ২৩ মার্চ বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম এ মান্নান তার দ্বিতীয় মেয়াদ পূর্ণ করেন। তার ছেলে জাহেদ মান্নান ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে আবেদন করলে নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকায় আবেদন বাতিল হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে সহযোগী অধ্যাপক পদে চাকরি হয় তার। দ্বিতীয় মেয়াদের পুরো সময়ই নিয়োগ, কেনাকাটা নিয়ে ছিলেন বেপরোয়া উপাচার্য অধ্যাপক মান্নান।

গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মো. ফায়েক উজ্জামান। ওই মাসেই তিনি ১২৬ জনকে নিয়োগ দিয়ে গেছেন। তার দ্বিতীয় মেয়াদজুড়েই নিয়োগে আত্মীয়করণের অভিযোগ ছিল। শেষ সময়ে এসে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে ক্যাম্পাস থেকে বিদায় নেন অধ্যাপক ফায়েক উজ্জামান।

ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, দুই মেয়াদে উপাচার্য থাকলে সাধারণত তার বিরুদ্ধে এক ধরনের জনমত তৈরি হয়। এ জন্যই অনেক সময় নানা ধরনের ঘটনা ঘটে। তবে অনিয়ম হলে প্রথম মেয়াদেও হতে পারে, আবার দ্বিতীয় মেয়াদেও হতে পারে।


সর্বশেষ সংবাদ