গুচ্ছ ভর্তি: মেধা যাচাইয়ের আগেই উচ্চশিক্ষায় বাদ পড়ছেন শিক্ষার্থীরা

দেশের ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হবে গুচ্ছ ভর্তি
দেশের ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হবে গুচ্ছ ভর্তি  © ফাইল ফটো

রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পাস করা নুর নেহাদ এসএসসির জিপিএ ছিল ৪.০৬। এইচএসসিতে ভালো ফলাফলের জন্য পুরোদমে প্রস্তুতিও ছিল। কিন্তু করোনায় গত বছরে এইচএসসি পরীক্ষা না হওয়ায় এসএসসির ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে এইচএসসির ফল দেওয়া হয়। তা নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেন। যে ফলাফল চাওয়া হয়েছে তা পূরণ করে প্রাথমিকভাবে আবেদন করেন প্রথমবারের মতো গুচ্ছ ভিত্তিতে অনুষ্ঠেয় ২০টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় মানবিক এবং বাণিজ্য বিভাগের প্রাথমিক আবেদনকারী সকলকে চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য মনোনীত করা হয়।

কিন্তু বিজ্ঞান বিভাগের ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৪১ জনের মধ্যে চূড়ান্ত আবেদন করতে পারবেন ১ লাখ ৩১ হাজার ৯০৫ শিক্ষার্থী। যার কারণে নুর নেহানসহ বাদ পড়েছেন ৬২ হাজার ৯৩৬ জন শিক্ষার্থী। অথচ গুচ্ছ ব্যতীত আলাদা ভর্তি পরীক্ষা হলে বাদ পড়া এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেকেই এ ফলাফল দিয়ে কোথাও না কোথাও পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেতেন।

মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) বিজ্ঞানে প্রাথমিক ফলাফলে বাদ পড়া শিক্ষার্থীরা চূড়ান্ত আবেদনে সুযোগ পেতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও গুচ্ছ ভর্তি কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. ইমদাদুল হকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন। এছাড়া দুপুরে একই দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন তারা।

নুর নেহাদ বলেন, শিক্ষামন্ত্রী অটোপাস উচ্চশিক্ষায় প্রভাব ফেলবে না বললেও এখন আমাদের এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আমরা গুচ্ছে সিলেকশন বাতিল চাই। ২৮টি কেন্দ্রে সকল আবেদনকারীদের পরীক্ষা নিলে প্রতি কেন্দ্রে পড়বে মাত্র সাত হাজার। যা ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সহজেই সম্ভব। ভাবছিলাম সমন্বিত পরীক্ষায় শারীরিক ও মানসিক অনেক কষ্ট লাঘব হবে কিন্ত এখন সেটা যন্ত্রণা বাড়িয়ে আমাদের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।

ময়মনসিংহের নটর ডেম কলেজ থেকে পাস করা শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, চলতি বছরে এইচএসসি পাস করেছে ১৫ লাখ শিক্ষার্থী। ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০ হাজার করে শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিলেও ১০ লাখ শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে পারবে। তাহলে বিজ্ঞান থেকে এত কম শিক্ষার্থী কেন পরীক্ষা দেবে? যেখানে বিজ্ঞানে এবার অটোপাশে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ২৩ হাজার। ভোগান্তি দূর করার নাম করে যে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে তা এখন আমাদের মানসিক যন্ত্রণার প্রধান কারণ হয়ে উঠছে।

নরসিংদীর হাজী আবেদ আলী কলেজের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আশরাফল ইসলাম বলেন, এইচএসএসি ও গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার জন্য অনেক ভালো প্রস্ততি নিয়েছি। কিন্তু এসএসসিতে ফলাফল খারাপ ও অটোপাসের কারণে গুচ্ছ পদ্ধতিতে চূড়ান্ত আবেদন করতে পারছি না। কিন্তু অটোপাসের সময় শিক্ষামন্ত্রী দীপু মণি বলেন, অটো পাস উচ্চতর শিক্ষা জীবনে কোন প্রভাব ফেলবে না। সবাই ভর্তি পরীক্ষায় মেধা যাচাইয়ের সুযোগ পাবে। কিন্তু এখন আমরা পরীক্ষার আবেদনই করতে পারছি না। বিজ্ঞপ্তিতে দেড় লক্ষ শিক্ষার্থী পরীক্ষার সুযোগ পাবে জানানো হলেও এখন ১ লক্ষ ৩১ হাজার শিক্ষার্থী সুযোগ পাচ্ছে। আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। আমাদের দাবি আমাদের বাদকৃত ৬২ হাজার শিক্ষার্থী সবাইকে যেন পরীক্ষায় বসার সুযোগ দেয়া হয়।

সাইফ আহমেদ বলেন, আমি ২০২০ সালে এইচএসসিতে মান উন্নয়ন পরীক্ষা দেই। কিন্তু অটোপাসের কারণে মানোন্নয়ন হয়নি। এখন ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পাচ্ছি না।

শুধু সিলেকশন পদ্ধতি নয়, পাশাপাশি যারা চূড়ান্ত ভর্তি পরীক্ষার জন্য মনোনীত হয়েছেন তারা আবেদন ফি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আগে চূড়ান্ত আবেদন ফি ৬০০ টাকা নির্ধারিত থাকলেও এখন তা বাড়িয়ে ১২০০ টাকা করা হয়েছে।

মানবিক থেকে মনোনীত শিরিণ আফরোজ বলেন, সংকটের এ সময়ে আর্থিক টানাপোড়েন ও অনিশ্চয়তায় অনেকেই পড়াশোনার হাল ছেড়ে দিচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকাংশ ভর্তিইচ্ছুক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। একটা পরীক্ষাই যেহেতু হবে সেখানে এত টাকা লাগবে কোনো? অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি দ্বিগুণ আবেদন ফি নির্ধারণ করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

এ বিষয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজক কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা আশা করেছিলাম সাড়ে চার লাখের পরীক্ষা নিব। এখন আমাদের পরীক্ষার্থী দেড় থেকে দুই লাখের বেশি হবে না। যত পরীক্ষার্থীদের সংখ্যা কম হবে তত খরচ বেড়ে যাবে। এ ফি ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাগ করলে প্রতিটায় ৬০ টাকা করে পরবে এবং বড়ির পাশে বসে পরীক্ষা দেওয়া যাবে। আমাদের পরীক্ষার কেন্দ্রগুলো সারা দেশে। সেখানে শিক্ষকরা যাবে, প্রশ্ন পাঠাবে, কর্মচারীদের এখানে যুক্ত করতে হবে ইত্যাদি কারণে অনেক খরচ হবে। এ টাকা দিয়েও পারব কিনা সন্দেহ আছে। পাশাপাশি নিজস্ব ফান্ড, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আর্থিক সহায়তা দেওয়ার সুযোগ না থাকায় ফি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

তবে সহজে ও কম খরচে পরীক্ষা নেওয়ার জন্য ইউজিসির উদ্যোগ মহৎ হলেও পরীক্ষার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা রয়েছেন তাদের সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে গুচ্ছ পরীক্ষা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।

বিজ্ঞান বিভাগের বাদকৃত শিক্ষার্থীদের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের ১ লক্ষ ৩১ হাজার শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেয়ার জায়গা আছে। আমরা ধারণা করছি প্রথম ধাপে অনেকেই আবেদন করবে না। পরবর্তীতে আবেদন না করার সংখ্যার ভিত্তিতে ধাপে ধাপে সবাইকে সুযোগ দেয়া হবে। আশা করছি কেউ বাদ পরবে না। আর প্রথম ধাপে আবেদনকারীদের সংখ্যা বেশি হলে সবাইকে সুযোগ দেয়ার জন্য আমাদের বিকল্প ব্যবস্থা ভাবতে হবে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময় ভর্তি পরীক্ষা কমিটির নেতৃত্বে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জাকারিয়া মিয়া। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ইউজিসির উদ্যোগটা বিশেষ অর্থে মহৎ ছিল। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায়, ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের থেকে যেভাবে পরামর্শ পেয়েছে, সেই মোতাবেক করেছে। বড় সংখ্যায় ছাত্রদের ক্ষতির মূলে রয়েছে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কতিপয় অতি উৎসাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের পরীক্ষামূলক মানসিকতা ও অতি পাণ্ডিত্য। তাদের মধ্যে শিক্ষার্থীবান্ধব উদার মানসিকতা একেবারেই নাই। একই রকম তুলনায়, বিসিএস পরীক্ষার জন্য পিএসসির পদ্ধতি অনেক উদার ও নৈতিকভাবে উন্নত, যেখানে যত বেশি সম্ভব পরীক্ষার্থীকে সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে।


সর্বশেষ সংবাদ