জাল সনদে কলেজের প্রভাষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার!

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিকৃবি) নীতিমালা শিথীল করে রেজিস্ট্রার পদে বদরুল ইসলাম শোয়েবকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি আবেদনে যে অভিজ্ঞতা সনদ দাখিল করেছিলেন তাও ভুয়া বলে জানা গেছে।  

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ঘনিষ্ঠ শোয়েব এমপিওভুক্ত কলেজে থেকে ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দিয়ে প্রথমে ডেপুটি রেজিস্ট্রার হন। এর সাড়ে ৩ বছরের মাথায় নিয়োগ নীতিমালা শিথিল করে তিনি রেজিস্ট্রার হন। জানা গেছে, শোয়েবের অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা না থাকায় তাকে রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নীতিমালা সংশোধন করা হয়।

নীতিমালা শিথিল করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়ায় নিয়োগ বোর্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য অনুপস্থিত থাকেন। ছয় সদস্যের মধ্যে ভিসিসহ মাত্র দুই সদস্য উপস্থিত হন। কিন্তু তৎকালীন ভিসি ড. শহীদুল্লাহ তালুকদার একাই দুই সদস্যের স্বাক্ষর করেন। এ ব্যাপারে ড. শহীদুল্লাহ বলেন, এভাবে শোয়েবকে রেজিস্ট্রার বানানো ঠিক হয়নি। কিন্তু যারা তাকে কলেজ থেকে ধরে এনে ডেপুটি রেজিস্ট্রার বানিয়েছেন তারা মস্ত বড় অন্যায় করেছেন।

শোয়েবের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে নুরুল ইসলাম নাহিদ যখন শিক্ষামন্ত্রী হন তখন বদরুল ইসলাম শোয়েব এমপিওভুক্ত ইছরাব আলী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক ছিলেন। ২০১০ সালের আগস্টে তিনি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পদে আবেদন করেন। এসময় তার যোগ্যতা না থাকায় নিয়োগ বোর্ড তাকে নিয়োগ দেয়নি। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির চাপে ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে তাকে অস্থায়ী নিয়োগ দেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে তা স্থায়ী করা হয়।

এ সময় তিনি শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার যে সনদ দিয়েছিলেন তা ছিল জাল বলে জানা গেছে। সূত্রমতে, ইছরাব আলী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে ১৯৯৭ সালের ২০ জুলাই থেকে ২০০৯ সালের ৫ অক্টোবর পর্যন্ত প্রভাষক এবং ২০০৯ সালের ৬ অক্টোবর থেকে ২০১০ সালের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত সহকারী অধ্যাপক হিসেবে তিনি কর্মরত ছিলেন বলে সনদে উল্লেখ করেন। কিন্তু ইছরাব আলী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহাব উদ্দিন সেই অভিজ্ঞতার সনদ পর্যবেক্ষণ করে জানান, কখনও তিনি এ সনদ দেননি। সনদে যে স্বাক্ষরটি রয়েছে তা তার নয়। তিনি আরও বলেন, এ কলেজে শেষদিন পর্যন্ত শোয়েব প্রভাষক ছিলেন এবং কখনও সহকারী অধ্যাপক হননি। এ সময় অধ্যক্ষ শেষ কর্মদিবস পর্যন্ত যে পদের বিপরীতে স্বাক্ষর করে শোয়েব বেতন তুলেছেন তা দেখান।

ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে তেমন কোনো সুবিধা করতে না পেরে শোয়েব দ্রুত রেজিস্ট্রার হওয়ার পথ বের করেন। তার ডেপুটি রেজিস্ট্রার হওয়ার ৩ বছরের মাথায় রেজিস্ট্রার নিয়োগে ২০১৩ সালের ১৮ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিজ্ঞপ্তি দেয়। তাকে নিয়োগ দিতেই নিয়োগ নীতিমালা সংশোধন করেন তৎকালীন ভিসি প্রফেসর ড. শহিদুল্লাহ তালুকদার। নীতিমালা অনুযায়ী ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকার কথা থাকলেও নতুন নীতিমালায় ৪ বছরের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করা হয়। এতে শোয়েবের অভিজ্ঞতার ঘাটতি দেখা দেয়। কারণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দিন থেকে শোয়েবের ডিপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে অভিজ্ঞতা দুই বছর ১১ মাস ২৪ দিন হয়। তাই অভ্যন্তরীণ প্রার্থী হলে অভিজ্ঞতা শিথিল যোগ্য বলে শর্তজুড়ে দেয়া হয়।

তৎকালীন নিয়োগ বোর্ডের সদস্যরা ছিলেন- ভিসি প্রফেসর ড. শহীদুল্লাহ তালুকদার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার (শূন্য পদ), একাডেমিক কাউন্সিলের মনোনীত সদস্য শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ শামছুল আলম, সিন্ডিকেটের মনোনীত সদস্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি এবং গ্রামীণ শিল্প বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামছুদ্দিন, বিশেষজ্ঞ হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী মো. রহমত উল্লাহ, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হিসেবে বোর্ডের সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. গিয়াস উদ্দিন মিয়া। তাদের মধ্যে তৎকালীন ভিসি প্রফেসর ড. শহীদুল্লাহ তালুকদার ও অধ্যাপক ড. সৈয়দ শামছুল আলম উপস্থিত ছিলেন।

আইন অনুযায়ী দুই সদস্যের বোর্ড কোনো নিয়োগ চূড়ান্ত করতে পারে না। কিন্তু শোয়েবের নিয়োগ তারা দু’জন চূড়ান্ত করেন। বোর্ড সদস্যদের উপস্থিতির কপিতে দেখা যায়, সিকৃবি ভিসি ড. শহীদুল্লাহ দু’জন সদস্যের বিপরীতে স্বাক্ষর করেছেন। ট্রেজারের পদ শূন্য থাকায় তিনি সেই পদে স্বাক্ষর করেছেন। যদিও রেজিস্ট্রার পদে তিনি লিখিতভাবে কোনো দায়িত্ব পাননি। কোরাম না হওয়ার পরও কিভাবে শোয়েবের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হল এমন প্রশ্নে অধ্যাপক ড. সামছুল আলম বলেন, তখন তিনি ভিসিকে বলেছিলেন দুই সদস্যের কোরাম হয় না। কিন্তু ভিসি বলেন কোরাম হবে। ট্রেজারার হিসেবেও তিনিই স্বাক্ষর করবেন। তিনি বলেন, ভিসি সম্মতি দেয়ায় এক্সপার্ট হিসেবে তার কিছুই করার ছিল না।

এ ব্যাপারে বর্তমানে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক ড. শহীদুল্লাহ তালুকদার বলেন, রেজিস্ট্রার হিসেবে শোয়েবের নিয়োগে কোনো অনিয়ম হয়নি। নিয়োগ বোর্ডের কোরাম না হওয়ার কথা তুললে তিনি বলেন, না দু’জন নয়; আরেকজন ছিলেন। ট্রেজারার হিসেবে আপনি (ড. শহীদুল্লাহ) স্বাক্ষর করেছেন কিনা তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনুপস্থিত কারও পক্ষে স্বাক্ষর করা অবৈধ। কিন্তু তিনিই সেই অবৈধ কাজটিই করেছেন জানানো হলে তিনি তা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, শোয়েবকে নিয়োগ দিতে তার ওপর অদৃশ্য শক্তির চাপ ছিল। তবে কোথা থেকে তা তিনি বলতে চাননি। তিনি বলেন, এ নিয়োগে কোনো অনিয়ম হয়নি। মিথ্যা অভিজ্ঞতা সনদ দিয়ে থাকলে এটা তার দায় না। তিনি প্রশ্ন রাখেন ডেপুটি রেজিস্ট্রার করার সময় যারা ছিলেন তারা যাচাই করেননি কেন?

অবৈধভাবে রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পেয়ে শোয়েব ক্যাম্পাসে গডফাদার বনে যান। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মার্চ রাতে শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে তৎকালীন প্রক্টর সিনিয়র শিক্ষক আবদুল বাসিতের গায়ে হাত তোলেন শোয়েব। এ ঘটনায় ৭৫ শিক্ষকের মধ্যে তৎকালীন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মৃত্যুঞ্জয় কুণ্ডুর নেতৃত্বে ৫৫ শিক্ষক শোয়েবের অব্যাহতির দাবিতে ভিসির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। শিক্ষকদের চাপে ভিসি তাকে চাকরিচ্যুতের সিদ্ধান্ত নিলেও এক আওয়ামী লীগ নেতার হস্তক্ষেপে পার পেয়ে যান শোয়েব।

এসব অভিযোগের বিষয়ে বদরুল ইসলাম শোয়েব বলেন, প্রথমত তার নিয়োগে কোনো অনিয়ম হয়নি। এডহকসহ সব নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা ভিসির হাতে। তাই তার বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence