প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক: ১৭৮ শিক্ষার্থীর ভাগ্যে কি পদক জুটবে না?
- আলামিন ইভান
- প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৩৭ PM , আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৯ AM
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় মনোযোগ বৃদ্ধি ও ভালো ফলাফল অর্জনে উৎসাহিত করতে ২০০৫ সালে ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক’ পুরস্কারের চালু করা হয়। অনার্স স্তরে বিভিন্ন অনুষদে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করা শিক্ষার্থীদের এ পদক দিতে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক-২০১৮’ প্রদান করেন। এছাড়া ২০১৯ সালের জন্য মনোনীত শিক্ষার্থীদেরও এখন পর্যন্ত এ পুরস্কার প্রদান করা হয়নি। মনোনয়েনের দীর্ঘদিন পরেও পদক না পাওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
ইউজিসি সূত্রে জানা যায়, শুধু পাবলিকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২০০৫ সালে ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক’ পুরস্কারের চালু করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক’ নীতিমালা সংশোধন করা হয়। এর মাধ্যমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও (স্থায়ী সনদপ্রাপ্ত) এ পুরস্কারের আওতায় আসে। প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক ২০১৯, ২০২০, ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩-এর কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
এর মধ্যে ২০২৩ সালের ৩০ এপ্রিল ইউজিসি ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক-২০১৯’ প্রাপ্তদের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করে। ওই তালিকায় দেশের ৩৭টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৭৮ জন শিক্ষার্থী মনোনীত হন। এর মধ্যে ৩২টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭৩ জন শিক্ষার্থী স্থান পান। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন করে মোট তিনজন শিক্ষার্থী এই স্বর্ণপদকের জন্য প্রাথমিকভাবে মনোনীত হন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুজন শিক্ষার্থীও প্রাথমিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন। পদক প্রদান অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য তারিখ ২১ মে নির্ধারণ করা হলেও বিভিন্ন জটিলতায় অনুষ্ঠানটি আটকে যায়।
‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বোচ্চ প্রাপ্তির একটি স্বীকৃতি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যারা অসামান্য কৃতিত্ব অর্জন করে, তারা এ পুরস্কারের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে মর্যাদা লাভ করে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এ স্বর্ণপদক প্রদান বন্ধ রয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরি হচ্ছে’- অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিলাল, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন: ২০ বছরে নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়েছেন এক কোটি ১৭ লাখ, চাকরি পেয়েছেন ১.৫ শতাংশ
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক প্রদানের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময়ের এই জটিলতা শিক্ষার্থীদের মনোবল ও উৎসাহের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে ভালো ফলাফল অর্জন করে প্রথম স্থান লাভ করা শিক্ষার্থীদের জন্য এটি একটি বড় উৎসাহ হিসেবে কাজ করে। তবে পুরস্কারের বিলম্বিত প্রদান তাদের প্রতি অবমূল্যায়ন এবং এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি করছে। তাই এই ধরনের অনুষ্ঠানের সময়মতো আয়োজন করা শিক্ষাব্যবস্থার স্বার্থে অত্যন্ত জরুরি।
ইউনিভার্সিটি টিচার্স লিংকের (ইউটিএল) সদস্য সচিব ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিলাল দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বোচ্চ প্রাপ্তির একটি স্বীকৃতি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যারা অসামান্য কৃতিত্ব অর্জন করে, তারা এ পুরস্কারের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে মর্যাদা লাভ করে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এ স্বর্ণপদক প্রদান বন্ধ রয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘শিক্ষা কেবল সনদ বা ডিগ্রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; শিক্ষার্থীর মেধা, শ্রম ও নিষ্ঠার সঠিক স্বীকৃতি প্রদান করলে তারা ভবিষ্যতে আরও বড় সাফল্যের পথে অগ্রসর হয়। প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক সেই স্বীকৃতি প্রদানের অন্যতম একটি মাধ্যম। এটি গত কয়েক বছর না দেওয়ায় শিক্ষার্থীরা নিজেদের সর্বোচ্চ দেওয়ার প্রতি উৎসাহ হারাচ্ছে বলে মনে করি। পুরস্কার প্রদানের প্রক্রিয়া পুনরায় চালু করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন মেধাবী শিক্ষার্থীরা যথাযথ সম্মান পাবে, অন্যদিকে নতুন প্রজন্মও শিক্ষা, গবেষণা ও দেশগঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে অনুপ্রাণিত হবে।’
প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক ২০১৯ প্রাপ্ত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জান্নাতারা মুন। তিনি বর্তমানে একটি সরকারি ব্যাংকে চাকরি করছেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘২০১৯ সাল ভিত্তিক প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদকের জন্য মনোনীত হওয়ার পরে যতটা আবেগ কাজ করেছিলো সেই আবেগটা আর আজ কাজ করছে না। ২০২৩ সালেই পদকটা পাওয়ার কথা ছিল। যদি সেসময়ে পদকটা পেয়ে যেতাম তাহলে হয়তো আমি আমার ৪টা সরকারী চাকুরির ভাইভাতে সেটা দেখাতে পারতাম। তাতে করে কোন লাভ না হলেও অন্তত মনের একটা শান্তি কাজ করতো যে এই পদকের সার্টিফিকেটটা অন্তত কোথাও না কোথাও কাজে লাগলো।
‘বর্তমানে আমরা পদক অনুষ্ঠান আয়োজনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যদি প্রধান উপদেষ্টা সময় দিতে সম্মত হন, তবে এটি অনুষ্ঠিত হবে। সেই লক্ষ্যেই আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোন পজিটিভ ফলাফল পাওয়া যায়নি।’- ড. শামসুল আরেফিন, পরিচালক, রিসার্চ সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিকেশন ডিভিশন, ইউজিসি
আরও পড়ুন: সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান কি চলতি মাসে ভারত সফরে যাচ্ছেন?
তিনি বলেন, ‘এখন তো সিভিতে কোথাও দেখাতেও পারিনা যে আমি স্বর্ণপদক প্রাপ্ত। কারণ আমার কাছে তো সার্টিফিকেট নেই। এখনো যদি পদকটা পেয়ে যাই তাহলে মানসিক একটা শান্তি কাজ করবে। ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতাম সরকার প্রধানের হাত থেকে স্বর্ণপদক পড়তে পারব। সেই ভালো লাগাটা এখনও কেনো জানি না খুব কাজ করে। পদকটা পেলে ছোটবেলার সেই স্বপ্নটাও পূরণ হবে। আমার বাবা-মা এর মুখে একটু হাসি এনে দিতে পারব। নতুন সরকার যদি ২০১৯ সাল ভিত্তিক প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক প্রাপ্তদেরকে তাদের প্রাপ্যটা দেয়ার ব্যবস্থা করেন তাহলে সেটা অবশ্যই প্রসংশনীয় হবে।’
২০১৯-এর প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক প্রাপ্ত চুয়েট শিক্ষার্থী রাধেশ্যাম নাথ যিশু। তিনি বর্তমানে চুয়েটের মেকানিক্যাল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালের প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক ২০১৫ এর শেষেও এসে দিতে না পারা একপ্রকার হতাশার। এ নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) রিসার্চ সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিকেশন ডিভিশনের পরিচালক হলেন ড. শামসুল আরেফিন বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, এবং আমরা আমাদের কাজগুলো অব্যাহত রেখেছি। অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, সেসময় আমরা শিডিউল পাইনি, ফলে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা সম্ভব হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমরা পদক অনুষ্ঠান আয়োজনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যদি প্রধান উপদেষ্টা সময় দিতে সম্মত হন, তবে এটি অনুষ্ঠিত হবে। সেই লক্ষ্যেই আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোন পজিটিভ ফলাফল পাওয়া যায়নি।’