গবেষণায় বরাদ্দ নামমাত্র, ‘রিসার্চ বেজড’ খ্যাতি কী খুইয়ে ফেলছে খুবি!
- খুবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৫, ০৪:২৯ PM , আপডেট: ২৮ আগস্ট ২০২৫, ০৩:১৪ PM
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (বিজিই) ডিসিপ্লিনের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী হৃদয়। গবেষণার স্বপ্ন নিয়ে পড়াশোনা করলেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো ফান্ড না পাওয়ায় থিসিস করতে নিজের পকেট থেকে ১৩ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। দেশের অন্যতম গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও ব্যক্তিগত অর্থে গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার এই বাস্তবতা শুধু হৃদয়ের নয়, বরং তার মতো অসংখ্য শিক্ষার্থীর নীরব সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ‘রিসার্চ বেজড বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ বছরের বাজেটের হিসাবে গবেষণার জন্য বরাদ্দ পাঁচ শতাংশেও কম। রিসার্চ বেজড বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার জন্য যে পরিমাণ অর্থ গবেষণায় বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন তার নাম মাত্র বরাদ্দ পেয়ে থাকে খুবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ এন্ড ইনোভেশন সেন্টারের (আরআইসি) তথ্য মতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বরাদ্দ হয়েছে ১৭৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে বেতন-ভাতা বাবদ খরচ হচ্ছে ১১০ কোটি ৭৩ লক্ষ টাকা যা মোট বাজেটের ৬২.৬৭ শতাংশ, পেনশনে বরাদ্দ ১৫ কোটি ৫৯ লক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ এন্ড ইনোভেশন সেন্টারের (আরআইসি) তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরে গবেষণা খাতে বরাদ্দ ছিল ৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। কিন্তু প্রশাসনিক খরচ, স্কলারশিপ, ফেলোশিপ, পিয়ার রিভিউ ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক কনফারেন্স বাবদ ব্যয় বাদ দিলে গবেষণার প্রকৃত অর্থ দাঁড়ায় মাত্র ৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এই অল্প অর্থ দিয়েই ৯৪টি গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করতে হচ্ছে রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন সেন্টারকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ এন্ড ইনোভেশন সেন্টারের (আরআইসি) পরিচালক ড. মোহাম্মদ দিদারুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বরাদ্দের সার্বিক পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে বলেন " এটা সত্যি রিসার্চ বেজড বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার জন্য যে পরিমাণ বরাদ্দ থাকা দরকার তার তুলনায় আমরা অনেক কম বরাদ্দ পেয়ে থাকি। কিন্তু আমরা যদি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সামগ্রিক বাজেট দেখি তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বাজেট ২১ কোটি টাকা যা মোট বরাদ্দের ২ শতাংশ। এই হিসাবে আমাদের গবেষণা বাজেট প্রায় ৮ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ৪ শতাংশের একটু বেশি। ছাত্র শিক্ষক অনুপাতে দেখলে আমরা খুব ভালো অবস্থানে আছি। আমি যখন দায়িত্ব নিয়েছিলাম তখন বরাদ্দ ছিল মাত্র ১ শতাংশ, এখন বরাদ্দ ৪ শতাংশ। আমাদের লক্ষ্য অতি দ্রুত গবেষণা বরাদ্দ ১০ শতাংশে উন্নীত করা। প্রশাসন যদি উন্নয়ন বরাদ্দ থেকে গবেষণায় কিছু অর্থ দেয় তাহলে গবেষণা বরাদ্দ বৃদ্ধি করা সম্ভব।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের রির্সাচ এন্ড ইনোভেশন সেন্টারের ( আরআইসি ) তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে মোট ৩৫৬টি প্রকল্প থেকে প্রকাশিত হয়েছে মাত্র ২৫৭টি গবেষণা নিবন্ধ। এছাড়া গবেষণার কাজে ৫৪৬ জন শিক্ষার্থীকে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করছেন, পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও মানসম্পন্ন গবেষণা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণা প্রকাশ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের শিক্ষক ড.মো: মাতিউল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের গবেষণা বরাদ্দের অপর্যাপ্ততা ও সমস্যার বিষয়ে বলেন, "গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় তা একেবারেই নগণ্য। প্রতিবছর গবেষণা বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানানো হলেও রেডিকেল কোন পরিবর্তন আসেনি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণার জন্য যে অর্থ দেয় তা দিয়ে গবেষণা সম্পন্ন করা সম্ভব, কিন্তু ভালো মানের গবেষণা সম্ভব নয়। স্বভাবতই গবেষণার গুণগতমান ভালো না হওয়ায় Q1 ( সর্বোত্তম ) জার্নালে পাবলিশ করা সম্ভব হয় না। আবার ভালো জার্নালে পেপার পাবলিশ করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাতেগোনা কয়েকজনকেই ভালো জার্নালে পাবলিশ করার জন্য অর্থ দেওয়া হয়। তাই কখনো কখনো ভালো গবেষণা করার পরেও গবেষকরা ভালো জার্নালে পেপারগুলা পাবলিশ করতে পারেনা। এটা গবেষকদের জন্য খুবই হতাশা জনক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত গবেষণা বরাদ্দ বৃদ্ধিতে একটু দৃষ্টিপাত করা।"
উল্লেখ্য ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে প্রকৃত গবেষণা বরাদ্দ ছিল ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকা, প্রকল্প ছিল ৮৪টি। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় ২২ লক্ষ ৭৮ হাজার টাকা বাজেট কমলেও গবেষণা প্রকল্প বেড়েছে ১০ টি। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে প্রকৃত গবেষণা বরাদ্দ ছিল ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, প্রকল্প ছিল ৬২টি। ২০২১-২২ অর্থ বছরে প্রকৃত গবেষণা বরাদ্দ ছিল ২ কোটি ১ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা, প্রকল্প ছিল ৬২ টি। আর ২০২০-২১ সালে প্রকৃত বরাদ্দ ছিল মাত্র ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা, প্রকল্প সংখ্যা ৫৪। হিসাব বলছে, গত পাঁচ বছরে গবেষণার বরাদ্দ বেড়েছে আড়াই গুণ, কিন্তু প্রকল্পের সংখ্যাও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. মো হারুনুর রশিদ খান বাজেট বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বলেন, "আমরা প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার জন্য যে বরাদ্দ দিয়ে থাকি তা কোনভাবেই সাফিশিয়েন্ট না। আমরা গবেষণা বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য প্রতি অর্থ বছরেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে অধিক ব্যায়ের খাত দেখিয়ে আবেদন করি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সরকার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ পাই না। তাই আমাদের ইচ্ছা থাকলেও চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন খাতে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে পারি না। উন্নয়ন বরাদ্দ থেকে গবেষণার জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধির বিষয় টি বিবেচনা করা হচ্ছে। পরবর্তী বছর গুলোতে গবেষণা বরাদ্দ বৃদ্ধি ও মান উন্নয়নে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে।"