ছাত্ররাজনীতির সংস্কার ও ছাত্র সংসদ চায় জবি শিক্ষার্থীরা

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ফটো

ক্যাম্পাসকে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতিমুক্ত করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জকসু) সচল করা জুলাই অভ্যুত্থানোত্তর সকল দাবির অন্যতম দাবি ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে তোপের মুখে ১৩ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবির মৌখিক ঘোষণার মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করলেও কাগজে-কলমে তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র সংসদ বিধি থাকলেও নেই কোনো আইন কিংবা নির্বাচনী রোডম্যাপ।  

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির চিত্র দিন দিন আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। সরেজমিনে দেখা যায়, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নিয়মিত শোডাউনের মাধ্যমে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করছে, পোস্টার লাগিয়েছে, দলের নামযুক্ত ডাস্টবিন বসিয়েছে, গ্রাফিতি করেছে। ছাত্রশিবির প্রকাশনা উৎসবসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ছাত্র অধিকার পরিষদসহ অন্যান্য বামধারার রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করছে।  

প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও মিছিল, সমাবেশ কিংবা বিক্ষোভ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ছাত্র সংগঠনগুলো দাবি আদায়ের জন্য বিক্ষোভ মিছিল করছে, রাজনৈতিক নেতাদের সংবর্ধনা দিচ্ছে, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আন্দোলনে নামছে। পাশাপাশি, তারা পোস্টারিং, লিফলেট বিতরণ, দেয়াল লিখন ও আলোচনা সভার মাধ্যমে নিজেদের মতাদর্শ প্রচার করছে।  

ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য সংগঠনগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা স্পষ্ট। দীর্ঘদিনের দমন-পীড়নের পর এই নতুন উত্থান ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথের ইঙ্গিত দিচ্ছে।  

এমন অবস্থায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। অনেকে বলছেন ছাত্ররাজনীতি চান, অনেকে বলেছেন চান না। তবে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ছাত্ররাজনীতির সংস্কারের ব্যাপারে মত দিয়েছেন। অনেকে ছাত্র সংসদ সচল করার কথা বলেছেন। শিক্ষার্থীরা চান, যারা ক্যাম্পাসে রাজনীতি করবে, তারা শিক্ষার্থীদের চাওয়া-পাওয়াকে সার্ভ করবে, কোনো মাদার সংগঠনের এজেন্ডা নয়।  

বিশ্ববিদ্যালয়টির দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাহিমা বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি চাইনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে আসে। এখানে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, গবেষণা করতে আসে। আর ছাত্ররাজনীতি এই সুযোগগুলোতে বাধা তৈরি করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি আমার জন্য আতংক সৃষ্টি করে।’ 

এ বিষয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী জাকির হোসেন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি থাকতে পারে, তবে এর সংস্কার অপরিহার্য। ফ্যাসিবাদী শাসনে ছাত্রলীগের দখলদারিত্ব, সন্ত্রাস ও ট্যাগিং-এর নামে হত্যাযজ্ঞ চলেছে। বিশ্বজিৎ ও আবরার হত্যার মতো ঘটনা আর দেখতে চাই না। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের পতনের পর, আমরা চাই ছাত্ররাজনীতি হোক কল্যাণমুখী। পারস্পরিক সহাবস্থানে সম্প্রীতির রাজনীতি গড়ে তুলতে হবে। আগামীর বাংলাদেশ গঠনে ছাত্ররাই নেতৃত্ব দেবে। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’

বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদ ইসলাম শাওন বলেন, ‘আমি লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির পক্ষে না। কারণ সেখানে তারা তাদের মাদার পার্টির সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবে। ছাত্ররাজনীতি সংস্কার হওয়ার পর ক্যাম্পাসে থাকতে পারে। তারা সেমিনার করবে, সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করবে, শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া নিয়ে কথা বলবে। কিন্তু যদি প্রথাগত রাজনীতি চলমান থাকে, তাহলে তা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকার প্রয়োজন নেই।’

লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী আলী আহমেদ আরাফ বলেন, ‘ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির থাকা প্রয়োজন। তবে ছাত্ররাজনীতি ছাত্রদের দ্বারা হতে হবে, অছাত্রদের মাধ্যমে নয়। ছাত্ররাজনীতি এমন হবে যে যারা এখানে কাজ করবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য, কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করবে না।’

প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নওশীন নাওয়ার জয়া বলেন, ‘এই মুহূর্তে ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ সচল করা অনেক বেশি জরুরি। ক্যাম্পাসে যে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি চলমান, তা ৫ আগস্টের আগের রূপেই আছে। এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।’

এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মেসবাহ উল আলম সওদাগর বলেন, ছাত্ররাজনীতির দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধ্বংস হয়েছে। ছাত্ররাজনীতি ছাত্রদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করে না, ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। তারা চায় না আগের স্টাইলে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতি চলুক। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজন আছে, কিন্তু অবশ্যই সেটা ছাত্রদের স্বার্থে হতে হবে—লেজুড়বৃত্তি নয়। এজন্য এ জায়গায় ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। সকল ছাত্রসংগঠনের পক্ষসম্মতিতে একটি সংস্কার করে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতি চালু থাকলে, সে ক্ষেত্রে সাধারণ ছাত্রদের আগ্রহ থাকবে।  

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক বলেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতির নতুন গতিপথের সূচনা করেছে তরুণ শিক্ষার্থীরা। এই পথ ধরেই ছাত্ররাজনীতির সংস্কার হওয়া উচিত বলে মনে করি।


সর্বশেষ সংবাদ