৪৬ বছরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
- ওয়াসিফ আল আবরার, ইবি
- প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩৮ AM , আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৩ AM
দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবির যৌক্তিকতা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের ১ ডিসেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ১৯৭৭ সালের ২৭ জানুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম. এ. বারীকে সভাপতি করে সাত সদস্যবিশিষ্ট ‘ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পরিকল্পনা কমিটি’ গঠন করা হয়। একই বছর ৩১ মার্চ থেকে ৮ এপ্রিল মক্কায় ওআইসি’র উদ্যোগে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী শিক্ষা সম্মেলনে এশিয়ার তিনটি মুসলমান রাষ্ট্রে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হয়।
১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান সরকার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ড. এ.এন.এম মমতাজ উদ্দীন চৌধুরীকে প্রকল্প পরিচালক নিযুক্ত করেন। ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহের শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুরে দেশের প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
ইসলামী শিক্ষার সাথে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে উচ্চশিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে ১৯৮০ সালের ২৭ ডিসেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ১৯৮০(৩৭) জাতীয় সংসদে পাস হয়। ১৯৮১ সালের ১ জানুয়ারি প্রকল্প পরিচালক ড. এ.এন.এম মমতাজ উদ্দীন চৌধুরীকে ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ দেয়া হয়। এভাবে প্রতিষ্ঠার পর ৪৬ বছর পার করে ফেলেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়টি।
বিশ্ববিদ্যালয়টির আটটি অনুষদের ৩৬টি বিভাগে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৪ হাজার ৬৭৮ জন। এর মধ্যে ছাত্র ৯ হাজার ২২৬ এবং ছাত্রী ৫ হাজার ৪৫২ জন। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে নতুন ভর্তিকৃত শিক্ষার্থী সংখ্যা ২ হাজার ৬০০। বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ জন। বর্তমানে ৪০৬ জন শিক্ষক শিক্ষাদানে নিয়োজিত রয়েছেন। এছাড়াও ৪৮৮ জন কর্মকর্তা, ১০২ জন সহায়ক কর্মচারী এবং ১৪৯ জন সাধারণ কর্মচারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রেখে চলেছেন।
১৯৮২ সালের ১৬ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আবাসিক ছাত্রহলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ১৯৮৩ সালের ১৮ জুলাইয়ের এক আদেশে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে গাজীপুরের বোর্ডবাজারে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৮৫ সালের মে মাসে ১৯৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষে দুটি অনুষদে চারটি বিভাগে মোট তিনশত ছাত্র ভর্তি করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাস অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৬ সালের ২৮ জুন। তখন শিক্ষক সংখ্যা ছিলো আট জন।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জানা গেছে, ১৯৯০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারির এক আদেশে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে গাজীপুর থেকে কুষ্টিয়ায় স্থানান্তর করা হয়েছিল। ১৯৯২ সালের ১ নভেম্বর মূল ক্যাম্পাসে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজের উদ্বোধন করা হয়।
চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়টির আটটি অনুষদের ৩৬টি বিভাগে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৪ হাজার ৬৭৮ জন। এর মধ্যে ছাত্র ৯ হাজার ২২৬ এবং ছাত্রী ৫ হাজার ৪৫২ জন। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে নতুন ভর্তিকৃত শিক্ষার্থী সংখ্যা ২ হাজার ৬০০। বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ জন। বর্তমানে ৪০৬ জন শিক্ষক শিক্ষাদানে নিয়োজিত রয়েছেন।
এ ছাড়া ৪৮৮ জন কর্মকর্তা, ১০২ জন সহায়ক কর্মচারী এবং ১৪৯ জন সাধারণ কর্মচারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রেখে চলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টি এ পর্যন্ত ৬২৪ জনকে পিএইচডি এবং ৭৮৮ জনকে এমফিল ডিগ্রি প্রদান করেছে। বর্তমানে ১৬৪ জন পিএইচডি এবং ৪৭ জন এমফিল গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন।
শিক্ষা ও গবেষণাক্ষেত্রে সহযোগিতা বিনিময়ের লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। সম্প্রতি চীনের সাউথইস্ট ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, যেখানে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ এবং চীনের সাউথইস্ট ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট ড. ওয়াং ওয়াইবিন স্বাক্ষর করেন।
এ ছাড়াও গত ২৪ অক্টোবর বিআইআইটি অডিটোরিয়ামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ইসলামিক থট (আইআইআইটি)-এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। তবে গবেষণা খাতে বাজেটের ঘাটতি শিক্ষক শিক্ষার্থীদের গবেষণা ইচ্ছা কমিয়ে আনছে। নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করে অনেককেই গবেষণা করতে হচ্ছে, ফলে গবেষকের উন্নতি হলেও বিভিন্ন সায়েন্টিফিক র্যাংকে পিছিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও নানাবিধ সমস্যার কারণে তা সম্ভব হয়নি। ফলে সেশনজট বাড়ছে। এছাড়াও শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিস থেকে যথাসময়ে সার্টিফিকেট, মার্কশিট, ট্রান্সক্রিপ্ট সংগ্রহ ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। জনবল সংকট, জায়গা সংকট ও বিভিন্ন সমন্বয়হীনতার কারণে সেবার মান কমেছে। অফিসটি নতুন ভবনে স্থানান্তরিত হলে সেবার মান আরও বাড়বে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত চারটি সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম সমাবর্তন ২৭ এপ্রিল ১৯৯৩ সালে, দ্বিতীয় সমাবর্তন ৫ ডিসেম্বর ১৯৯৯ সালে, তৃতীয় সমাবর্তন ২৮ মার্চ ২০০২ সালে এবং সর্বশেষ ৪র্থ সমাবর্তন ৭ জানুয়ারি ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হয়।
ক্রীড়া ক্ষেত্রেও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। অ্যাথলেটিক্সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সাতবার এবং ছাত্রীরা আটবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি ফুটবলে তিনবার, হ্যান্ডবলে (ছাত্র) তিনবার, ভলিবল (ছাত্র) ১৩ বার এবং বাস্কেটবলে চারবার চ্যাম্পিয়ন হয়। এছাড়াও ব্যাডমিন্টনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ২০২৪ সালে এবং ছাত্রীরা ২০১৭ ও ২০১৮ সালে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি অর্জন করে। এ বিশ্বব্দ্যিালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্রী তামান্না আক্তার সাতবার জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার হাডেলস ইভেন্টে স্বর্ণপদক লাভ করেন।
‘ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন (৩য় পর্যায়)-১ম সংশোধিত’ শীর্ষক প্রকল্পটি ৫৩৭ কোটি ৭ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ২০১৮ সালের জুলাই হতে চলতি বছরের জুলাই মেয়াদে বাস্তবায়নাধীন আছে। প্রকল্পের ৩২টি অঙ্গের মধ্যে ১৩টি অঙ্গের কাজ সমাপ্ত হয়েছে এবং চারটি অঙ্গের কাজ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। বাকি ১৫টি অঙ্গের কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ৯টি ১০ তলা ভবনের সবগুলোর নির্মাণকাজ এগিয়ে চলেছে। ১১টি ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শ্রেণিকক্ষ ও আবাসন সংকটের অনেকটাই নিরসন হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এ প্রকল্পের আওতায় দৃষ্টিনন্দন লেকের কাজ শেষ হয়েছে। কেন্দ্রীয় গবেষণাগারের জন্য সরঞ্জামাদি ক্রয় সম্পন্ন হয়েছে। ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ সাবস্টেশন ও সোলার প্যানেল এবং বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে দু’টি গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ ডিসেম্বর নাগাদ শেষ হবে। এছাড়া এ প্রকল্পের আওতায় একটি উন্মুক্ত জলাশয় তৈরির কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
বর্তমানে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে বই রয়েছে এক লাখ ২৬ হাজার ৭২টি। এছাড়া জার্নাল, ম্যাগাজিন এবং নিউজ পেপারের সংখ্যা ১৯ হাজার ৪০০। রিমোট এক্সেস এর মাধ্যমে অনলাইনে সাবস্ক্রাইবড ই-বুক এবং ই-জার্নাল পড়ার সুবিধা রয়েছে। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য বর্তমানে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন পুলে নিজস্ব গাড়ি রয়েছে ৪৬টি।
৫২ আসনের নন-এসি বাস ১৩টি, দ্বিতল বাস একটি, এসি বাস একটি, ৩০ আসনের এসি কোস্টার সাতটি, নন-এসি মিনিবাস পাঁচটি, হায়েস এসি মাইক্রো পাঁচটি, জীপ সাতটি, কার তিনটি, পিক-আপ দু’টি এবং অ্যাম্বুলেন্স দু’টি। এছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের যাতায়াতের জন্য ভাড়াকৃত ৯টি দ্বিতল বাসসহ মোট ৩২টি বাস-মিনিবাস রয়েছে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, বর্তমানে তাদের জন্য বিষফোঁড়া আইডি কার্ড সমস্যা। কারণ হলভিত্তিক আইডিকার্ডটি কোনো মূল্য থাকে না গ্রন্থাগার বা মেডিকেলে। প্রতিক্ষেত্রে লাগে ভিন্ন কার্ড। টাকাও প্রদান করতে হয় পৃথকভাবে। ৪৬ বছরেও এ সংকটটি কাটেনি। তবে শিক্ষার্থীরা এখন পাচ্ছেন প্রাতিষ্ঠানিক মেইলের সুবিধা। চতুর্থ বর্ষ ও মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা এ সুবিধার আওতায় এসেছেন গত বছর থেকেই।
আরো পড়ুন: ভেঙে যাচ্ছে ৩৬ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ, কী করবেন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা?
জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ ও লালনে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসে জুলাই বিপ্লবের শহিদদের স্মরণ করা হচ্ছে। গত ৩০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেক সংলগ্ন বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় জুলাই-আগষ্টের বিপ্লবের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য জুলাই উদ্যান-২০২৪ এর উদ্বোধন করা হয়। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বিভাগসমূহের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে ধারাবাহিক মতবিনিময়ে অংশ নিয়েছেন।
মতবিনিময়কালে বিভাগসমূহে বিরাজমান সংকটগুলো তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে জানার চেষ্টা করেছেন এবং সেগুলো ক্রমান্বয়ে নিরসনের চেষ্টা করবেন, এ আশ্বাস দিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত বর্তমান প্রশাসন ইসলামী শিক্ষার সাথে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা প্রদানের মূল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা ও গবেষণা নিশ্চিতে সচেষ্ট রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।