নিম্নমানের কাগজে পরীক্ষা নিচ্ছে কুবি, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ 

আগের ও বর্তমান কাগজের অবস্থা
আগের ও বর্তমান কাগজের অবস্থা  © টিডিসি ফটো

আগের তুলনায় নিম্নমানের কাগজে সেমিস্টার ও মিডটার্ম পরীক্ষা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) প্রশাসনের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, বর্তমানে সরবরাহকৃত অমসৃণ, খসখসে নিউজপ্রিন্ট (মোটা) কাগজে লিখতে বিড়ম্বনায় পড়ছেন তারা। এছাড়াও এক পৃষ্ঠার লেখা অপর পৃষ্ঠায় ভেসে উঠা, কাগজে ছোট বড় ছিদ্র থাকা, বিভিন্ন অংশে কালো কালো দাগ থাকা এবং কাগজের পাতার বহুবিধ রঙের বৈচিত্র্য রয়েছে।

এদিকে পেপার রিকুইজিশন কমিটি, যাচাই বাছাই কমিটি ও ক্রয় কমিটির দায়িত্ব পালন নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। খাতার গুণগত মান নিয়ে নানা মন্তব্য  চলছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে। এদিকে সেমিস্টার ও মিডটার্মের কাগজ নিম্নমানের হওয়ার  কথাটি স্বীকার করলেও এ কাগজেই সকল পরীক্ষা দিতে হবে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিগত অর্থবছরগুলোতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা পেপার মিলস থেকে সরবরাহকৃত হোয়াইট প্রিন্ট মসৃণ কাগজে পরীক্ষা নেওয়া হতো। তবে  ২০২২-২৩ অর্থবছরে (জুন-জুলাই) জরুরি পরিস্থিতিতে উপাচার্যের নির্দেশে জিটুজি পদ্ধতিতে চলতি বছরের মে ও জুলাই মাসে প্রায় ২ লক্ষাধিক খাতা সরবরাহ করে কর্ণফুলী পেপার মিলস লিমিটেড। তবে এর আগে পরীক্ষার কাগজ ক্রয়ের জন্য টেন্ডার আহবান করে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন। 

সেসময় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘বর্ণলিপি’ পেপার মিলস লিমিটেডের সাথে চুক্তি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। তবে ঐ সময়ে বৈশ্বিক সংকটের কারণে কাগজের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় চুক্তি অনুযায়ী কাগজ সরবরাহ করতে পারেনি ঐ প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে জরুরি ভিত্তিতে কাগজ কেনা হয় কর্ণফুলি পেপার মিলস থেকে। তবে কাগজ ক্রয়ের আগে কাগজের মান যাচাই না করার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রেজওয়ান আহমেদ বলেন, খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় লেখা সম্বলিত যে লোগো, আইডি নেম ও অন্যান্য তথ্য লিখার নির্দেশনা রয়েছে সেগুলো অপর পৃষ্ঠায় দেখা যায়। ফলে ঐ জায়গাগুলোতে যদি আমরা লিখি তাহলে লেখাগুলোর স্পষ্টতা কম থাকে। আমরা অনেকে কলমে কম প্রেশার দিয়ে লিখি, আবার অনেকে বেশি প্রেশার দিয়ে লিখি। যারা বেশি প্রেশার দিয়ে লিখে তাদের লেখাগুলো ঐ পেইজে একটু হিজিবিজি দেখা যায়।

নিম্নমানের কাগজে লিখা যায় না মন্তব্য করে লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী সাফাত মুহাম্মদ ওয়াসিব বলেন, অতীতে আমরা দেখেছি যে খাতাগুলো দিয়ে মিডটার্ম পরীক্ষা নেওয়া হতো তা অনেক ভালো ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে লক্ষ করছি আমাদের মিডটার্ম পরীক্ষায় যে খাতাগুলো দেওয়া হচ্ছে সেগুলো অনেক নিম্নমানের, ঠিকমতো লিখা যায় না। এতে করে পরীক্ষার সময় আমাদের  সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।  আমাদের যাতে করে  অতীতের ন্যায় ভালো মানের কাগজ সরবরাহ করা হয় সে জন্য  প্রশাসনের কাছে জোর  দাবি জানাচ্ছি।

গত ২১ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) অর্থনীতি বিভাগের মাইক্রো ইকোনমিক থিওরির (ইকো-৩২১) সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন বনলতা (ছদ্মনাম) নামের এক ছাত্রী। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমাদের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার খাতাগুলো অনেক নিম্নমানের ছিল। খাতার মাঝখানে ছেঁড়া এবং কালো কালো ছোট ছোট দাগ রয়েছে। এছাড়াও খাতা অমসৃণ, খসখসে হওয়ায় লিখার ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে। তিনি আরও বলেছেন, খোলা চোখে খাতাগুলো দেখতেও অনেক খারাপ লাগে। কারণ খাতার একেক পৃষ্ঠায় একেক কালার।

এদিকে পূর্বের খাতার সাথে বর্তমানে সরবরাহকৃত খাতার গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য কুমিল্লার কয়েকটি পাইকারি কাগজ  বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের। তাদের ভাষ্য, খাতা দুটি খালি চোখে দেখেই বুঝে যায় দু’টির মধ্যে কত ব্যবধান। একটি খাতা হোয়াইট প্রিন্ট কাগজ (পূর্বের সরবরাহকৃত)। অন্যটি মোটা নিউজ প্রিন্ট কাগজ (বর্তমানে সরবরাহকৃত)। বর্তমানে সরবরাহকৃত কাগজের থিকনেস অনেক কম, মালের চাকচিক্য অনেক কম এবং দামেও পার্থক্য রয়েছে অনেক। এছাড়াও বর্তমানে সরবরাহকৃত কাগজগুলো খসখসে হওয়ার কারণে লিখার জন্য আগের কাগজের চেয়ে কষ্টকর হবে।

বর্তমানে সরবরাহকৃত কাগজ নিম্নমানের হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন পেপার ক্রয় কমিটির আহ্বায়ক ও ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ আহসান উল্যাহ। তিনি বলেন, খাতাগুলো খোলা চোখে দেখতেও ভাল দেখায় না। খাতার মান যেহেতু খারাপ তাই এ বিষয়ে নূরুল করিমকে বলেছি যে এ খাতা দিয়ে মিডটার্ম পরীক্ষা দিতে শিক্ষার্থীরা কমফোর্ড ফিল করছে না। এ খাতা দিয়ে সেমিস্টার পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হবে না। আপনারা এ বিষয়টি প্রশাসনের উচ্চ মহলে অবগত করেন।

এমন মানহীন কাগজ ক্রয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, আগে কাগজ কেনা হতো বসুন্ধরা থেকে। তবে এবার কাগজের সংকট দেখা দিলে জরুরি প্রয়োজন সাপেক্ষে জিটুজি প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে উপাচার্য মহোদয়ের নির্দেশে কর্ণফুলী পেপার মিলস লিমিটেডের কাছ থেকে কেনা হয়। আমরা ভেবেছিলাম সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় খাতার মান ঠিক থাকবে কিন্তু এখন দেখছি খাতার মান তেমন ভালো নয়। যদিও এর আগে ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে টেন্ডার হলেও তারা সঠিক সময়ে কাগজ আমাদের সরবরাহ করতে পারেনি। তবে আগের কাগজের চাইতে এখনকার কাগজের দাম তুলনামূলক কম। 

এদিকে একই কথা বলছেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ নূরুল করিম। তিনি বলেন, খাতাগুলোর মান আগের চেয়ে খারাপ। পেজগুলো মাল্টিকালার। এই খাতা দিয়েই সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়া হবে। তবে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমি উপাচার্য স্যারকে বিষয়টি অবহিত করেছি যে তাই এ পেপার আর আনা বা ব্যবহার করা সমীচীন হবে না। 

কাগজের মান খারাপ ও ক্রয়সংক্রান্ত বিষয়ে একই কথা বলেছেন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামানও। তিনি জানান, কর্ণফুলী পেপার মিলের অতীতের যে ঐতিহ্য সেটি এখন আর নেই। আমরা কাগজ আনার পর তা বুঝতে পেরেছি। কাগজের গুণগতমান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে এটা সত্য। তবে আমাদের তৎকালীন উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে কাগজ ক্রয় করতে আমরা বাধ্য হই। তবে কাগজের দামও পূর্বের চেয়ে এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে।

তিনটি কমিটি গঠন করারও পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিম্নমানের কাগজ আসার পিছনে দায়ভার কার এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে কমিটির কোন দায়ভার নাই। কারণ কমিটি কাজ করেছে তা  হলো টেন্ডার আহ্বান করে কীভাবে ভালো কাগজ কেনা যায়। গতানুগতিক ধারায় কিংবা অতীতেও যে-রকম আমরা স্যান্ডার্ডিটি মেইনটেইন করেছি সে কাজটি কমিটি করেছে। 

শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কিভাবে লাঘব করবেন এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেহেতু কাগজ কেনা হয়ে গেছে, সেজন্য কাগজগুলো এখন ব্যবহার করতে হবে। তবে চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ভালোমানের কাগজ কেনার বিষয়টি আমরা খেয়াল রাখবো।

সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড এএফএম. আবদুল মঈনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।


সর্বশেষ সংবাদ