কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ‘ধোঁয়াশা’ সিদ্ধান্তে বড় সংকটের মুখে কুবি
- হাছান আল মাহমুদ
- প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৩০ PM , আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২২, ১০:২৪ PM
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্তিকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ‘ধোঁয়াশা’ সিদ্ধান্তে বড় সংকটে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। কমিটি বিলুপ্তি নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগও। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে বড় ধরনের সংঘর্ষের আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ক্যাম্পাসের সর্বশেষ কয়েকদিনের পরিস্থিতি অনুযায়ী ইতিমধ্যে ক্যাম্পাসে ফাঁকা গুলি ও ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন সাবেক ছাত্র খালেদ সাইফুল্লাহ হত্যা মামলার প্রধান আসামিসহ অন্যান্য বহিরাগতরা। তাদেরকে প্রতিহত করতে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে মহড়া দিয়েছে ছাত্রলীগের ‘বর্তমান’ কমিটির নেতাকর্মীরাও।
প্রশাসনের সামনেই বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে আবার নির্বিঘ্নে বেরিয়ে যাওয়ায় তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। শুক্রবার রাত পৌনে ১২টার দিকে কুবি শাখার কমিটি বিলুপ্তি সংক্রান্ত একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ফেসবুক পেজ ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের ফেসবুক ওয়াল থেকে ওই বিজ্ঞপ্তি সরিয়ে নেওয়া হলেও সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের ওয়ালে এখনও ভাসছে ওই বিজ্ঞপ্তি।
বিষয়টি নিয়ে দু’ধরনের মন্তব্য করেছেন কেন্দ্রীয় নেতারাও। জয়ের অনুসারীরা কমিটি বিলুপ্ত দাবি করলেও লেখক ভট্টাচার্য ও তার অনুসারী হিসেবে পরিচিতরা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি ভুলে ছড়িয়ে পড়েছে বলে মত দিয়েছেন। তারা বলছেন, কুবি কমিটি বিলুপ্ত হয়নি।
এ ঘটনার পর শনিবার দুপুর ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকীর সামনে দিয়েই শতাধিক বহিরাগতদের নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে অস্ত্রের মহড়া দেয় ছাত্রলীগের একটি অংশ। ক্যাম্পাসে প্রবেশের পরই ফাঁকা গুলি ও ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটান তারা।
আরও পড়ুন: ছাত্রলীগের অস্ত্র মহড়ায় কুবিতে হল বন্ধ, পরীক্ষা স্থগিত
এ অংশের নেতৃত্বে ছিলেন ২০১৬ সালের পহেলা আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দেওয়াকে কেন্দ্র করে নিহত খালেদ সাইফুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি বিপ্লব চন্দ্র দাস ও ২০১৭ সালে বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক রেজা-ই-এলাহীসহ আরও কয়েকজন।
বহিরাগতদের মধ্যে ছিল বিভিন্ন সময়ে ছিনতাইয়ে অভিযুক্ত ইকবাল হোসেন ওরফে টারজান ইকবাল, ডাকাতি মামলার আসামি শাহজাহান, কোটবাড়ি, সালমানপুর ও বাতাইছড়ি (রেজা-ই-এলাহীর গ্রাম) এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা কবির, লিটন, আলাউদ্দিন, মনির, মোশাররফ, আকতার, নজির আহমেদ, সুমনসহ স্থানীয় বিভিন্ন অটো ও সিএনজি চালকরা।
তবে বহিরাগতদের বিষয় অস্বীকার করে এ অংশের নেতা রেজা-ই-এলাহী বলেন, কমিটি বিলুপ্তির সংবাদে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ও অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আনন্দ মিছিল বের করেছি। এখানে কোনো বহিরাগত ছিল না। ককটেল বিস্ফোরণ ও ফাঁকাগুলির অভিযোগ মিথ্যা। আর বিপ্লব দাসকে খালেদ সাইফুল্লাহর খুনি বলা হলেও এখনও মামলা চলছে এবং এ মামলার অনেক আসামি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছে।
খালেদ সাইফুল্লাহ হত্যা মামলার প্রধান আসামি বিপ্লব চন্দ্র দাসের মুঠোফোনে কল দিয়েও কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বঙ্গবন্ধু হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী বলেন, তারা স্পষ্টতই গুলি ছুঁড়েছে। প্রশাসনের সংশ্লিষ্টতা না থাকলে তাদের সামনেই গুলি ও ককটল বিস্ফোরণ করে তারা বেরিয়ে যেতে পারতো না।
বহিরাগতদের প্রবেশের কিছুক্ষণ আগ থেকেই ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকে অবস্থান করছিলেন প্রক্টরসহ কয়েকজন শিক্ষক ও পুলিশ প্রশাসন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্যাম্পাসে হামলার বিষয়ে প্রশাসন আগে থেকেই জানতো এবং তাদের যোগসাজোশেই বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছেন।
শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইমাম হোসাইন মাসুম, যিনি বহিরাগতরা চলে যাওয়ার পর প্রক্টরের সাথে জেরা করেছিলেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, প্রক্টর বলছেন যে তারা আগে থেকেই ঘটনার আভাস পেয়েছেন। তাহলে তারা হলের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে পুলিশকে প্রধান ফটকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন কেন? তাঁদের সামনেই প্রধান ফটক খোলা হয়েছে, বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে ঢুকেছে। অথচ ওনারা নীরব দর্শক ছাড়া কোনও ধরনের ভূমিকা পালন করেননি।
যদিও এমন আভাস পাওয়ার বিষয় অস্বীকার করে প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকী প্রতিবেদকের কল কেটে দিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের আরেক নেতা বলেন, প্রক্টরই বহিরাগতদেরকে প্রটোকল দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করিয়েছেন। তাদের প্রবেশের সময় পুলিশ প্রশাসন ঘটনাস্থলে থাকলেও তাদেরকে পদক্ষেপ নিতে দেয়নি প্রশাসন। আবার হামলা চালিয়ে তাদের সামনে দিয়েই নির্বিঘ্নে বেরিয়ে গেছে বহিরাগতরা। অথচ প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে তাদেরকে বেরিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে।
আরও পড়ুন: হল ছাড়ার সময় বিলুপ্ত কমিটির নেতাদের উপর প্রতিপক্ষের হামলা
‘বর্তমান’ কমিটির সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ বলেন, হামলায় তিন-চার সাবেক ছাত্র এবং একজন রানিং ছাত্র, অটোচালক, সিএনজি চালক, বহিরাগত ও বিভিন্ন মামলার আসামী ছিল। প্রশাসন যদি বহিরাগত সন্ত্রাসীদের ঠেকাতে না পারে, তাহলে সরকারকে বলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিক। বহিরাগতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তো এখানে কোন ঘটনাই ঘটতো না। প্রশাসনের বহিরাগতদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেওয়ার মানে হচ্ছে এখানে প্রশাসনের নির্লিপ্ততা আছে এবং তারাই এখানে দায়ী।
এদিকে শনিবার বহিরাগতদের মহড়ার পরই বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে মহড়া দিয়েছে শাখা ছাত্রলীগের ‘বর্তমান’ কমিটির নেতা-কর্মীরা। এদের মধ্যে ছিলো বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইমাম হোসাইন মাসুম, সহ-সম্পাদক কাজল হোসাইন , বিজ্ঞান অনুষদ শাখার সভাপতি জিলান আল সাজিদসহ অন্যান্য আরো অনেকেই।
তাদের হাতে রামদা, হকিস্টিকসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র দেখা যায়। পুলিশ ও প্রক্টরের সামনেই এসব অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেন তারা। ‘ক্যাম্পাস ও প্রধান ফটক বন্ধ থাকার পরও কিভাবে বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে ঢুকে’- দেশীয় অস্ত্র হাতে নিয়েই প্রক্টরকে এমন জিজ্ঞাসা করে প্রক্টরের সাঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন তারা।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য আবাসিক হলসমূহ বন্ধ করে দেওয়াসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আগামী ৯ অক্টোবর শেষ হচ্ছে চলমান পূজার বন্ধ। বন্ধের পর আগামী ১০ থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পরীক্ষা স্থগিত রাখারও সিদ্ধান্ত রয়েছে কর্তৃপক্ষের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, কর্তৃপক্ষের এমন নির্লিপ্ততায় স্পষ্টতই বড় সংকটে পড়তে যাচ্ছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। ইতোমধ্যে হল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কতদিন নাগাদ খুলবে, তা-ও বলা যাচ্ছে না।
শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. দুলাল চন্দ্র নন্দী বলেন, হল বন্ধ করার মতো বড় ঘটনায় অতীতে জরুরি অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল কিংবা সিন্ডিকেট সভা ডেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। প্রশাসন এখন শুধুমাত্র ডিন, প্রক্টর ও প্রভোস্টদের নিয়েই নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সবদিক থেকে কথা আসলে আরও ভালো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত।
যা বলছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন
এসব ঘটনায় প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, ক্যাম্পাসে কোনো ঘটনা ঘটলে প্রক্টরিয়াল বডি সেখানে যাবে এটাই স্বাভাবিক। প্রক্টরিয়াল বডি এটা ইফেশিয়েন্টলি হ্যান্ডেল করে শেষ করেছে কিনা এটা হচ্ছে পয়েন্ট। প্রক্টরিয়াল বডি সাথে সাথে সেখানে উপস্থিত হয়ে সবাইকে সাক্সেসফুলি বের করতে পেরেছে।
ক্যাম্পাসে গোলাগুলির অভিযোগের ব্যাপারে প্রক্টর বলেন, তদন্ত শেষ হওয়ার আগে আমি কিছু বলতে পারছি না।
হত্যা মামলার আসামি প্রক্টরের সামনে দিয়ে চলে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোন খুনের আসামি, আমি তো চিনি না।’ পরবর্তীতে খালেদ সাইফুল্লাহ হত্যার কথা বলা হলে তিনি বলেন, এই মামলার কি রায় হয়েছে? আমি জানি না তো!
তিনি বলেন, বহিরাগতদের কিছুই না করে ছাত্রদের হল থেকে বের করে দেয়া.... শিক্ষার্থীরা তো যেকোনো কিছুই বলতে পারে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, যেহেতু পূজার বন্ধে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বাড়িতে, তাই বাকি কমসংখ্যক যারা আছে তারাও বাড়িতে চলে যাক।
জানতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও বরাবরের মতো কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ছাত্র না হয়ে অছাত্র যদি হয়ে থাকে, তাহলে তাদের প্রবেশ বিশ্ববিদ্যালয় কখনই গ্রহণ করবে না। এক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা নেব। ওদের শনাক্ত করার বিষয়ে আমি প্রক্টরের সাথে কথা বলবো। পরবর্তীতে যাতে বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে না পারে আমরা সে ব্যবস্থা নেব।