‘দুর্বলতা জেনে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করতেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লিমন’
আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের সংবাদ সম্মেলন
- গণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:২২ PM
ঢাকার অদূরে সাভার অবস্থিত গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক মো. লিমন হোসেনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন নিজ বিভাগের একাধিক নারী শিক্ষার্থী। সম্প্রতি এ অভিযোগ উঠার পর তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের একাডেমিক ও প্রশাসনিক থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সোমবার (৮ ডিসেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার আবু মুহাম্মাদ মুকাম্মেল স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ তথ্য জানানো হয়।
এদিকে, ৮ মাস আগের ঘটনায় গত ২ ডিসেম্বর করা মামলায় পিকনিকের কথা বলে আশুলিয়ায় নিয়ে গিয়ে একই বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থীকে সংঘবদ্ধ ‘ধর্ষণ’ ও ভিডিও ধারণের মামলার পর আন্দোলনে রয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে বিভাগের প্রভাষক লিমনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আসার পর দুটি ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকায় তিনিসহ বিভাগের আরেক শিক্ষককে অব্যাহতি দিয়ে পাঁচ সদস্যের এই তদন্ত কমিটি করেছে প্রশাসন।
জানা গেছে, এই দুটি ইস্যুতে বর্তমানে উত্তাল রয়েছে গণ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সর্বশেষ মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) দুপুরে গণ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (গবিসাস) কার্যালয়ে চলমান আন্দোলন-পরিস্থিতি ও আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে আইন বিভাগ শিক্ষার্থী কল্যাণ পরিষদ ও বিভাগটির শিক্ষার্থীরা।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পেশাদারিত্বে অবহেলা, আইন বিভাগের যৌক্তিক আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করতে কুচক্র মহলের তৎপরতা, তদন্ত সাপেক্ষে যৌন হয়রানি ও ব্ল্যাকমেইলের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে আইন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানসহ অন্যান্য শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের সুষ্ঠু বিচারের দাবি করেন। এছাড়া র্যাগিং, যৌন নিপীড়ন ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেল ও কার্যকর পদক্ষেপের দাবি জানান।
এ সময় দাবি করা হয়, দুর্বলতা জেনে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করতেন শিক্ষক লিমন। পায়ের সমস্যার জন্য দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সব শিক্ষার্থীদের জীবন নষ্ট করতে পারের না তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) তাওহীদ আহমদ সালেহীন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দায়িত্বশীল শিক্ষক, কর্মকর্তাদের পেশাদারিত্বে অবহেলা। দায়িত্বশীলদের পেশাদারিত্বে অবহেলার ফলেই ক্যাম্পাসে র্যাগিং, ধর্ষণসহ নানা অপরাধমূলক কাজ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। যেসব যৌক্তিক দাবির প্রেক্ষিতে আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে সকল বিষয়ের সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্তদের শাস্তি প্রদান করে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলে প্রতিষ্ঠানের বাইরে দুজন থাকবে যারা লিঙ্গ ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করবে। অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলের অফিস কোথায়, কমিটির প্রধান ছাড়া বাকি সদস্যরা কারা এখনো জানায়নি। চলমান প্রতিকূলতা কাটাতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) আসাদুর রহমান বিজয় বলেন, লিমন স্যার শুধু ধর্ষণের সহায়তাকারীই নয়। বিভাগের একাধিক নারী শিক্ষার্থী তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ দিয়েছে। ক্লাসে পড়ানোর পরিবর্তে অধিকাংশ সময়ই শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে হস্তক্ষেপ করেন। এছাড়া তিনি স্বজনপ্রীতি করেন। ক্ষমতাসীনদের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে মিশে যেতেন এবং দুর্বলতা জেনে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করতেন।
তিনি বলেন, তার শিক্ষক হওয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। তার পায়ের সমস্যার জন্য দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সব শিক্ষার্থীদের জীবন নষ্ট করতে পারেন না। আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা উনাকে চায় না। তাকে পেশাদারিত্বের পদ থেকে অব্যাহতির দাবি জানাই।
আইন বিভাগের শিক্ষার্থী জাকারিয়া ইসলাম বলেন, লিমন হোসেন শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। ধর্ষণকারীকে রক্ষা করা, যৌন হয়রানিসহ নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। তার বিষয়ের পরীক্ষার খাতা অন্য শিক্ষার্থী দিয়ে দেখাতো। আমরা এমন অযোগ্য শিক্ষক চাই না।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা সত্য কথা বললে তাদের মার খেতে হয়, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা কোথায়? এত অভিযোগ ছাড়াও ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে তাও কেন তাকে বিভাগে রাখা হয়েছে। আমার মনে হয় প্রশাসনও তার কাছে জিম্মি তাই সময়ক্ষেপণ করে তাকে ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে। তবে আমরাও বলছি আমাদের দাবি অব্যাহত থাকবে, আমাদের আন্দোলন চলবে।
এ সময় সংবাদ সম্মেলনে আইন বিভাগ শিক্ষার্থী কল্যাণ পরিষদের নেতৃবৃন্দ ও বিভাগের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদানে লিমনের একাডেমিক যোগ্যতা কম ছিল। তবে তিনি ‘মানবিক’ বিবেচনায় সেই সময় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর থেকে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের পরোক্ষ শক্তিতে নানা অনিয়ম করতে থাকেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সর্বশেষ গত ৪ ডিসেম্বর নিজ বিভাগে ধর্ষণে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের পক্ষে থানায় গিয়ে তোপের মুখে পড়েন তিনি।
প্রসঙ্গত, লিমনকে ১৬ বছর বয়সে ২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে কুখ্যাত অপরাধী বিবেচনা করে বাম পায়ে গুলি করে র্যাব—৮ এর কয়েকজন সদস্য। পরে লিমনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সেদিনই তার বিরুদ্ধে আলাদা দুটি মামলা করে র্যাব। এর ৪ দিন পর লিমনের বাম পা কেটে ফেলতে হয়। বর্তমানে তিনি কৃত্রিম পা দিয়ে চলাফেরা করছেন।
সেই সময় রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ঠুরতার শিকার তরুণ লিমন পিজিএস কাউখালী কারিগরি বহুমুখী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০১০ সালে এসএসসি এবং ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করেন। ২০১৭ সালে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে অনার্স এবং ২০১৯ সালে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ২০২০ সালে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি।