সামাজিক ব্যবসা শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় হবে গ্রামীণ ইউনিভার্সিটি

গ্রামীণ ইউনিভার্সিটি ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস
গ্রামীণ ইউনিভার্সিটি ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস  © টিডিসি সম্পাদিত

প্রচলিত ধারায় সনদ দেবে না সম্প্রতি অনুমোদন পাওয়া গ্রামীণ ইউনিভার্সিটি। সম্প্রতি কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের বি২৩৯ মিলনায়তনে আয়োজিত এক বক্তৃতায় এমনটাই জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার ভাষ্য, অনুমোদন পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীদের তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি হাতেকলমে কাজ শেখানো হবে; যেন তারা নিজেরাই সামাজিক উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারে। প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য হবে—সমাজের সমস্যা সমাধানে শিক্ষাকে  কাজে লাগানো।

২৪ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার) কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন শূন্যের একটি বিশ্ব নির্মাণ ‘শূন্য নেট কার্বন নির্গমন, শূন্য সম্পদ মজুদ এবং শূন্য বেকারত্ব’ শীর্ষক এক ভাষণে এসব কথা বলেন দেশের একমাত্র এই নোবেলজয়ী।

অনুষ্ঠানে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক শিক্ষার্থীর প্রশ্নের আলোকে জানান কেমন হবে গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম। তিনি বলেন, আমরা যাত্রা শুরু করেছি একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। এটি হবে সামাজিক ব্যবসা বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে শিক্ষকতা যেই বিষয়েরই হোক না কেন, সেই শিক্ষায় সব সময় মানবিক দায়বদ্ধতা যুক্ত থাকবে। রসায়ন বিভাগের ক্লাসেও আমরা দেখাবো, রসায়নেরও সামাজিক দায়িত্ব আছে। একজন বিজ্ঞানী বা রসায়নবিদ হিসেবে তার ভূমিকা কী হবে—সে প্রশ্ন থেকেই শুরু হবে শিক্ষা।

১০ থেকে ২০০ ডলার পর্যন্ত ঋণ দিয়ে আমরা ১০ মিলিয়নের বেশি নারীকে উদ্যোক্তা বানিয়েছি—তারা সবাই নিরক্ষর। তারা শুধু ঋণ নিচ্ছে না, ব্যবসা করছে, সেই ব্যাংকও তারাই চালাচ্ছে। এই ব্যাংক তাদের, তারা এর মালিক। এবং এই ব্যাংক দেশের সবচেয়ে বড় ক্লায়েন্টভিত্তিক ব্যাংকে পরিণত হয়েছে— অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস

তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা শুধু থিওরি মুখস্থ করে ডিগ্রি নেবে না, বরং প্রতিটি ক্লাস থেকেই তারা শুরু করবে সমাধান তৈরির প্রক্রিয়া। এখানে পড়াশোনা শেষ মানেই কোনো সার্টিফিকেট নয়—যেটি আপনি কোনো চাকরির জন্য নিয়ে যাবেন। আমরা বরং আপনাকে বলব, ‘চাকরির জন্য ঘুরে বেড়ানোর দরকার নেই, নিজের উদ্যোগ শুরু করুন—আমরাই আপনাকে অর্থায়ন করব। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়ন ব্যবস্থা থাকবে, যাতে শিক্ষার্থীরা বাস্তবে তাদের সামাজিক ব্যবসা শুরু করতে পারেন।

নতুন এই  শিক্ষা পদ্ধতির প্রতিটি বিষয়ের সিলেবাসে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে সামাজিক দায়িত্ববোধ। আপনি রসায়নের ছাত্র হলেও আপনাকে ভাবতে হবে—আপনার জ্ঞান কীভাবে সমাজের কল্যাণে কাজে লাগবে। কারণ, আমরা সবাই আগে মানুষ, তারপর পেশাজীবী—জানান অধ্যাপক ইউনূস।

বিশ্বব্যাপী প্রচলিত ব্যবসায় শিক্ষার প্রচলিত ধারার সমালোচনা করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আজকের ব্যবসা শিক্ষার মূলমন্ত্র হলো—যত বেশি লাভ, তত বেশি সাফল্য। এতে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, আর দরিদ্ররা আরও নিঃস্ব। আমি বলি, অন্তত একটা ডিপার্টমেন্ট তো রাখুন—যেটি শুধু সামাজিক ব্যবসার শিক্ষা দেবে, কীভাবে একটি ব্যবসা দিয়ে দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য, পরিবেশের মতো সমস্যার সমাধান করা যায়। ইউরোপের HEC Paris সহ অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যেই সামাজিক ব্যবসা কেন্দ্র চালু করেছে বলে জানান তিনি।

আমাদের প্রচলিত ধারণা বলে, সবাই উদ্যোক্তা হতে পারে না। আমি বলি, প্রতিটি মানুষ জন্মগতভাবে উদ্যোক্তা। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ অশিক্ষিত দরিদ্র নারী এখন নিজস্ব ব্যবসা চালাচ্ছেন, ব্যাংক পরিচালনা করছেন, এবং সবচেয়ে বড় কথা, তারাই সেই ব্যাংকের মালিক। এটা শুধু সম্ভবই নয়, এটি বাস্তবে ঘটে চলেছ—শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

তিনি বলেন, এসব শুধু মানার বিষয় নয়। আপনি বিতর্ক করুন, যুক্তি দিন। বিকল্প পথ খুঁজুন। আমি বলি, আমরা সবাই একেকজন মহাকাশযানের পাইলট। আমাদের নিজেদের পথ ঠিক করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে—কোন পথে যাবো।

ক্ষুদ্রঋণ প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, মাইক্রোক্রেডিট একটা প্রতিবাদের ভাষা। প্রচলিত ব্যাংকিং বলতো, গরিবদের ঋণ দেওয়া যায় না। আমরা বললাম, এই ধারণা ভুল। প্রচলিত ব্যাংক ধনীদের আরও ধনী করছে। আমরা উল্টোটা করলাম—একটা ব্যাংক বানালাম; যা গরীবদের উদ্যোক্তা বানায়।

অধ্যাপক ইউনূস জানান, ১০ থেকে ২০০ ডলার পর্যন্ত ঋণ দিয়ে আমরা ১০ মিলিয়নের বেশি নারীকে উদ্যোক্তা বানিয়েছি—তারা সবাই নিরক্ষর। তারা শুধু ঋণ নিচ্ছে না, ব্যবসা করছে, সেই ব্যাংকও তারাই চালাচ্ছে। এই ব্যাংক তাদের, তারা এর মালিক। এবং এই ব্যাংক দেশের সবচেয়ে বড় ক্লায়েন্টভিত্তিক ব্যাংকে পরিণত হয়েছে।

অন্তত একটি প্রচলিত বিশ্বাসকে বদলে দেওয়ার ডাক দেন অধ্যাপক ইউনূস। তার ভাষায়, বলা হয়ে থাকে উদ্যোক্তা হতে বিশেষ প্রতিভা লাগে। আমি বলি, প্রতিটি মানুষ জন্মগতভাবেই উদ্যোক্তা। আপনি যদি না বিশ্বাস করেন, তাহলে গ্রামীণ ব্যাংকের দিকে তাকান। এই নারীরা প্রমাণ করছে, উদ্যোক্তা হওয়া মানুষের সহজাত সক্ষমতা।

আরও পড়ুন: নতুন বিশ্ববিদ্যালয় আনছে গ্রামীণ ট্রাস্ট

তিনি জোর দিয়ে বলেন, দারিদ্র্য গরীবরা সৃষ্টি করে না, এটি সৃষ্টি করে সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি। তাই দরকার একটি ‘কাউন্টার সিস্টেম’, যেটি দারিদ্র্য সৃষ্টি না করে বরং তা দূর করে। আমরা চাই শিক্ষার্থীরা সে পথ তৈরি করুক, তারাই হবে সেই মহাকাশযানের পাইলট—যারা নতুন পৃথিবীর দিকনির্দেশনা ঠিক করবে।

ক্ষুদ্রঋণের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, আমাদের প্রচলিত ধারণা বলে, সবাই উদ্যোক্তা হতে পারে না। আমি বলি, প্রতিটি মানুষ জন্মগতভাবে উদ্যোক্তা। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ অশিক্ষিত দরিদ্র নারী এখন নিজস্ব ব্যবসা চালাচ্ছেন, ব্যাংক পরিচালনা করছেন, এবং সবচেয়ে বড় কথা, তারাই সেই ব্যাংকের মালিক। এটা শুধু সম্ভবই নয়, এটি বাস্তবে ঘটে চলেছে।

সবশেষে তিনি বলেন, আমরা যা করছি, তা হলো প্রচলিত ভুল পথে একটি প্রতিবাদ। আর সেই প্রতিবাদের পথ ধরেই তৈরি হয়েছে এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের লক্ষ্য একটাই—একটি ‘থ্রি-জিরো’ বিশ্বে শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব, শূন্য কার্বন নিঃসরণ। আর এই বিশ্ববিদ্যালয় হবে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পাঠশালা।

তথ্যমতে সম্প্রতি গ্রামীণ ইউনিভার্সিটি নামে নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সোমবার (১৮ মার্চ) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান মো. আশরাফুল হাসানকে চিঠি দিয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থাপনের অনুমোদনে মোট ২২টি শর্ত দিয়ে আদেশ জারি করেছে।

এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে- সাময়িক অনুমতির মেয়াদ হবে অনুমতি প্রদানের পরবর্তী ৭ (সাত) বছর; প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এ বর্ণিত সকল বিধান ও শর্ত মেনে চলবে; পাঠদানের নিমিত্তে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যাপ্ত সংখ্যক শ্রেণিকক্ষ, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি, মিলনায়তন, সেমিনার কক্ষ, অফিস কক্ষ, শিক্ষার্থীদের পৃথক কমন রুম এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য কক্ষের জন্য পর্যাপ্ত স্থান ও অবকাঠামো থাকতে হবে।

প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যূন ২৫ হাজার বর্গফুট আয়তনবিশিষ্ট নিজস্ব বা ভাড়া করা ভবন থাকতে হবে। প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যূনতম তিনটি অনুষদ এবং ওই অনুষদের অধীন অন্যূন ছয়টি বিভাগ থাকতে হবে; প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কিত একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে, যা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক পূর্বে অনুমোদিত হতে হবে; প্রস্তাবিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যেক বিভাগ, প্রোগ্রাম ও কোর্সের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত সংখ্যক পূর্ণকালীন যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে।

প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিবিড় পাঠক্রম এবং প্রতিটি বিষয় ও কোর্স প্রণয়নসহ প্রত্যেক বিষয়ে মোট আসন সংখ্যা উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পূর্ব অনুমোদন নিতে হবে; প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে সংরক্ষিত তহবিল হিসেবে অন্যূন এক কোটি ৫০ লাখ টাকা যেকোনও তফসিলি ব্যাংকে জমা থাকতে হবে এবং সরকারের অনুমতি ছাড়া লভ্যাংশ উত্তোলন করা যাবে না; প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় স্বার্থ ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত হতে পারে এমন কোনও কার্যকলাপে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করবে না এবং সন্ত্রাসী বা জঙ্গি তৎপরতা বা এই জাতীয় কোনও কার্যকলাপে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কোনোভাবেই কোনও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করবে না।

কেবল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অনুমোদিত অনুষদ, বিভাগ ও কোর্সে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি এবং শুধু ক্যাম্পাসভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে; সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পূর্বানুমোদন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে না ইত্যাদি; বর্তমানে দেশে ১১৫টি অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তবে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এখনও কার্যক্রমে নেই।

জানা যায়, বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় কমপক্ষে এক একর এবং অন্যান্য এলাকায় ২ একর জমি থাকার বিধান রয়েছে। তবে রাজধানীর উত্তরা উত্তরে অবস্থিত নতুন এই আবেদিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ একর মতো জায়গা রয়েছে।

এর আগে ইউজিসির সদস্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সম্প্রতি আমরা ক্যাম্পাস পরিদর্শন করেছি। আমাদের প্রতিনিধি দল এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শনে গিয়ে খুবই ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে। সাধারণত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য ঢাকা শহরে এক একর জায়গার প্রয়োজন হয়, সেখানে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ২৫ একর মতো জায়গা রয়েছে। এখন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টির অনুমোদনের বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেখবে।

প্রস্তাবিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এর সদস্য হিসেবে ১৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এদের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ছোট ভাই মুহাম্মদ ইব্রাহিম এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক প্রধান সমন্বয়কারী লামিয়া মোর্শেদও রয়েছেন।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence