ভাগ অংশের সমাধান পারে না প্রাথমিকের ৯৫% শিশু
- খাঁন মুহাম্মদ মামুন
- প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৩, ১২:৪৩ PM , আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:০৬ PM
দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা গণিত বিষয়ে। এ স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণিতের ভাগ অংশের অংক করতে পারেন না ৯৫ শতাংশের বেশি শিশু। এর মধ্যে ছেলে শিক্ষার্থীরা ৯৫.৮৫ শতাংশ এবং মেয়ে শিক্ষার্থীদের ৯৭.২০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভাগ করতে পারেন না। বুধবার (১৪ জুন) রাজধানীতে জাতীয় শিক্ষা সংলাপে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়েভ ফাউন্ডেশনসহ চারটি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণা ফলাফলে জানানো হয়েছে, জরিপে ৫-১৬ বছর বয়সী রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলের ১৫৩৩ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। জরিপে তাদের খুব সাধারণ কিছু বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছে। যা তারা বিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিখন কালে চর্চা করে থাকে।
এতে দেখা যায়, গণিতের একক অংক শনাক্ত করতে পারেনি তাদের ১৪ দশমিক ১৯ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থী এবং ১৩ দশমিক ০৬ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী। তবে, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিয়োগ অংক করতে পেরেছে ১৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থী এবং ২২ দশমিক ২৪ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী।
করোনাকে দোষ দিয়ে আসলে খুব বেশি লাভ নেই। আমাদের এখন শিক্ষার মান বাড়াতে কাজ করতে হবে। এখানে শিক্ষার পরিমান বা সংখ্যাগত অংশগ্রহণ বেড়েছে, এখন তাই মান বাড়াতে কাজ করতে হবে।
গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থী এবং ৮২ দশমিক ৮৬ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী ইংরেজিতে গল্প পড়তে পারেন না। এছাড়া ইংরেজি বর্ণ পড়তে পারেনি ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ ছেলে এবং ১৫ দশমিক ২২ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী। তবে, ইংরেজি শব্দ চিহ্নিত করতে পেরেছেন ২৪ দশমিক ১০ শতাংশ ছেলে এবং মেয়ে শিক্ষার্থীদের ২৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থী।
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল বলছে, অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬১ দশমিক ৯৫ শতাংশ ছেলে এবং ৫৩ দশমিক ১৪ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী বাংলায় গল্প পড়তে পারেননি। আর বাংলা বর্ণ পড়তে পারেননি ১০ দশমিক ২৮ শতাংশ ছেলে এবং ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী। তবে, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বাংলায় শব্দ চিহ্নিত করতে পেরেছেন ২১ দশমিক ০৯ শতাংশ ছেলে এবং ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী।
গবেষণার ভিত্তিতে প্রাপ্ত এ ফলাফল উপস্থাপনকালে সমস্যার সমাধানে চারটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব জানানো হয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক সংখ্যা বাড়ানো, বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন, শ্রেণির পড়া শ্রেণিতেই শেষ করা এবং শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার কথা জানানো হয়েছে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত ক্লাসরুম ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন তথা স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করার প্রস্তাবও জানানো হয়েছে জাতীয় শিক্ষা সংলাপে।
এ সময় সভাপতির বক্তব্যে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, আমাদের এখন শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে কাজ করতে হবে। শুধুমাত্র আয় বাড়লে শিক্ষার উন্নতি হবে, তা নয়। তাহলে তো সিলেট সবচেয়ে এগিয়ে থাকার কথা। কিন্তু, তা হয়নি। এখানে গবেষণা ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে। আমার আহবান, আগামীতে যেন গবেষণার পাশাপাশি সীমাবদ্ধতাগুলো তুলে ধরা হয়।
আরও পড়ুন: প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতেও কাজ করছে সরকার: প্রতিমন্ত্রী
তিনি বলেন, কভিডকালে আমাদের যে শিখন ঘাটতি তা পূরণ করতে কাজ করতে হবে। আমাদের শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে আমাদের দিনের পড়া দিনেই শ্রেণিকক্ষে শেষ করতে হবে; নতুন শিক্ষাক্রমে তা করা হয়নি। পাশাপাশি, শিক্ষায় সবার সমান অংশগ্রহণ ও সুযোগ নিশ্চিতে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। এটি শুধুমাত্র শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে হয়েছে, অন্য কোনো ক্ষেত্রে হয়নি।
ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী বলেন, আমাদের শিক্ষায় অংশগ্রহণ বেড়েছে, এখন আমাদের শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে কাজ করতে হবে। ওয়েব ফাউন্ডেশন শুরু থেকেই বিভিন্ন ধরনের কাজ করছে এবং এর অন্যতম একটি হলো শিক্ষা। আমরা সিভিতে লেখা দেখি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেখি কিন্তু, তিনি বাংলায় একটি বাক্য শুদ্ধ করে লিখতে পারেন না। আমাদের যুবদের দক্ষতা এবং যোগ্যতা বাড়াতে হবে এবং সেজন্য কাজ করতে হবে।
সংলাপে বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. এস এম জুলফিকার আলী বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতি হলে আমাদের শিক্ষার মানে পার্থক্য রয়ে গেছে। আমাদের ২০২৬ সালের লক্ষ্যমাত্রা এবং ২০৪১ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এখনই গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। সেজন্য যুবদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। সেজন্য এখন আমাদের অংশগ্রহণ যা আছে তা ধরে রেখে মান অব্যাহত রাখতে কাজ করতে হবে। তা না হলে শুধু দেশে না দক্ষিণ এশিয়ায়ও আমরা পিছিয়ে যাবো।
তিনি বলেন, করোনাকে দোষ দিয়ে আসলে খুব বেশি লাভ নেই। আমাদের এখন শিক্ষার মান বাড়াতে কাজ করতে হবে। এখানে শিক্ষার পরিমান বা সংখ্যাগত অংশগ্রহণ বেড়েছে, এখন তাই মান বাড়াতে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি কভিডসহ অন্যান্য চ্যালেঞ্জে অর্থনীতির সাথে শিক্ষা উন্নয়নে কর্মসূচিসহ সকল বিষয় দেখতে হবে। একইসাথে শিক্ষার উন্নয়নে এবং ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নিয়মিত পাঠদানের পাশাপাশি ডিস্টেন্স লার্নিং চলামন রাখা যেতে পারে।
আমাদের এখন শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে কাজ করতে হবে। শুধুমাত্র আয় বাড়লে শিক্ষার উন্নতি হবে, তা নয়। তাহলে তো সিলেট সবচেয়ে এগিয়ে থাকার কথা। কিন্তু, তা হয়নি। এখানে গবেষণা ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে।
সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষের কথা উল্লেখ করে জুলফিকার আলী বলেন, আমাদের এখানে এখনও শিক্ষায় অসমতা বিদ্যমান রয়েছে। এখানে প্রতিষ্ঠান, সুযোগ সুবিধা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে এসব অসমতা বিদ্যমান রয়েছে। আমাদের এখন এসব অসমতা দূর করতে কাজ করতে হবে; শিক্ষার মানোন্নয়নে সকলকে একসাথে বাস্তবমূখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের সামাজিক অসমতা দূর এবং চলমান সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
স্ট্রিট চাইল্ড ইউকে’র প্রোগ্রাম ম্যানজার ইমতিয়াজ হৃদয় বলেন, আমরা শুধুমাত্র বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের তথ্য দেখে ভীত হই; কিন্তু, কভিডসহ চলমান চ্যালেঞ্জে একই অবস্থা আফগানিস্তান, মিয়ানমার ও নেপালেও। আমাদের শিক্ষার মান বাড়াতে শুধু আলোচনা করলেই হবে না বরং আমাদের পলিসি লেভেল এবং অ্যাডভোকেসি লেভেলে তা গ্রহণ করতে হবে।
অক্সফ্যাম আইবিআইএস এবং স্ট্রিট চাইল্ড-ইউকে এর আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় ‘এডুকেশন আউট লাউড (ইওএল)’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে নাগরিক সমাজের সংগঠন ওয়েভ ফাউন্ডেশন। এ প্রকল্পের অন্যতম কর্মসূচি হিসাবে ‘নাগরিক কর্তৃক পরিচালিত মূল্যায়ন’ নামক একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। এই জরিপের মাধ্যমে করোনা পরবর্তী শিক্ষার্থীদের শিখন স্তরের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। এ দিন জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ এবং স্থানীয় পর্যায়ে আয়োজিত সংলাপ থেকে প্রাপ্ত সুপারিশসমূহ সকলের সামনে তুলে ধরা হয়।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশনের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। সংলাপে ওয়েভ ফাউন্ডেশনের পক্ষে বক্তব্য রাখেন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী। প্রকল্প ও জরিপ ফলাফল উপস্থাপন করেন প্রকল্পের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক লিপি আমেনা ও প্রকল্প কর্মকর্তা তুলিকা সরকার। উপস্থাপনার ওপর আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. এস. এম. জুলফিকার আলী।
এছাড়াও শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (আইন শাখা) মো. আতাউর রহমান, স্ট্রিট চাইল্ড, ইউকের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ইমতিয়াজ হৃদয় বক্তব্য রাখেন। জাতীয় এই সংলাপের সমাপনী বক্তব্য এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন নাসিফা আলী, উপ-নির্বাহী পরিচালক, ওয়েভ ফাউন্ডেশন। উদ্বোধনী অধিবেশনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ও সঞ্চালনা করেন কানিজ ফাতেমা, উপ-পরিচালক, ওয়েভ ফাউন্ডেশন। এছাড়া নাগরিক সমাজ, যুব ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিসহ অন্যান্য অতিথিরা সংলাপে উপস্থিত ছিলেন।