দুর্নীতির দায় স্বীকার, গুম ও নির্বাচনের প্রশ্নে নীরব ওবায়দুল কাদের

ওবায়দুল কাদের
ওবায়দুল কাদের  © সংগৃহীত

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দুর্নীতির কিছু অভিযোগ আংশিকভাবে স্বীকার করলেও, শেখ হাসিনা সরকারের সময় ঘটে যাওয়া গুম ও নির্বাচনের প্রহসনের প্রসঙ্গে কোনো স্পষ্ট জবাব দেননি। রবিবার আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে ঘোষিত নির্বাচনের সময়সূচির মধ্যেই ‘ভোট না হওয়ার বীজ’ নিহিত রয়েছে।

সাক্ষাৎকারে কাদের বলেন, ‘এই দিনক্ষণ ঘোষণার মধ্যেই ভোট না-হওয়ার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে বলেই আমার ধারণা। যদি আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হয়, তাহলে দেশ-বিদেশ কোথাও তা গ্রহণযোগ্য হবে না। আর যদি জবরদস্তি করে নির্বাচন হয়, তবে তা শুধু আওয়ামী লীগহীন নয়, মুক্তিযোদ্ধাবিহীন পার্লামেন্ট হবে।’

জুলাই-আগস্টের আন্দোলন যে সরকারের পতন ঘটাবে, তা তাঁরা প্রশাসনগত এবং দলগতভাবে বুঝতেই পারেননি বলে মেনে নিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর কথায়, ‘ঠিক এমনটা হবে, এটি আমরা ভাবতে পারিনি। প্রথমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোটা-বিরোধী কর্মসূচি নিয়েছিল। আসলে কোটা-বিরোধী আন্দোলনের কথা বলা হলেও, পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, এটা সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন। গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন রিপোর্ট ছিল, কিন্তু এটি শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারের পতনে গিয়ে শেষ হবে, তা আমাদের অনেকেরই ভাবনার বাইরে ছিল। দলগত ভাবেও আমরা বুঝতে পারিনি।’

তিনি দাবি করেছেন, কোটা-বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে ছিল জঙ্গিরা। তাঁর কথায়, ‘গত জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে যে জঙ্গিবাদী উত্থান হয়েছিল, তাতে আবেগপ্রবণ ছাত্র সমাজের একটা অংশ যোগ দিয়েছিল। পাকিস্তানের জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-এ-তইবার শাখা সংগঠন এই অভ্যুত্থানে জড়িত ছিল বলে এখন আমরা খবর পাচ্ছি।’

ওই আন্দোলনে নিহতেরা পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছেন কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের। এখনও ওই আন্দোলনকে দেশের সামগ্রিক জনরোষ বলে মানতে নারাজ ওবায়দুল। তাঁর দাবি, ওই সময় 'হুজুগে পরিস্থিতি'র সৃষ্টি হয়েছিল। এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে 'সমাজবিরোধী অপশক্তি, লুটেরা শ্রেণি' যুক্ত হয়েছিল।

তাঁর কথায়, ‘এতে বেশিরভাগ অংশগ্রহণ ছিল বাংলাদেশবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী, উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তির। এরা বহুদিন ধরে তলে তলে প্রস্তুতি নিচ্ছিল সরকারের পতন ঘটানোর জন্য। তারা ছিল ৭১-এর পরাজিত শক্তি। ৭১-এর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল।’

জুলাই-আগস্টের আন্দোলন দমনে হাসিনা সরকারের পুলিশ বহু ক্ষেত্রেই বলপ্রয়োগ করেছিল। তাতে বহু মানুষ হতাহত হয়েছিলেন। ওই ঘটনাগুলির জন্য কি শেখ হাসিনার দল ক্ষমা চাইবে, এমন প্রশ্ন বাংলাদেশে উঠেছে।

এই প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘যদি কোনো ভুল করে থাকি, তাহলে জনগণের কাছে ভুল স্বীকার করা হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু প্রয়োজন হলে সেটা তখনই করব, যখন আমরা দেশের মাটিতে থাকব। যা বলা প্রয়োজন, তা দেশের মাটিতেই দাঁড়িয়ে বলব।’

বাংলাদেশে পালাবদলের পরে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির বহু নেতা-নেত্রী দেশত্যাগ করেছেন। নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ। বহু কর্মী-সমর্থক এখন কারারুদ্ধ। অনেকেই বলছেন, তৃণমূল স্তরের কর্মীদের বিপদের মুখে ছেড়ে পালিয়েছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। এই অভিযোগ মানতে নারাজ দলের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই দেশ ছাড়িনি। অধিকাংশ নেতাই দেশে রয়েছেন। বহু নেতা কারাগারে। কেউ কেউ আত্মগোপন করে দেশে রয়েছেন, তাঁরাই সংগঠনকে ধরে রেখেছেন। আওয়ামী লীগ মনস্ক বিশিষ্টজন-সহ কেউ কথা বলতে পারছেন না। সকলের কণ্ঠরোধ করে রাখা হয়েছে। কর্মীরাই এখন নেতা হয়ে গিয়েছেন।’

তবে তিনি মেনে নিয়েছেন, কারাগারে থাকা কর্মীদের পাশে দলগতভাবে দাঁড়ানো বর্তমান পরিস্থিতিতে খুবই কঠিন কাজ। কারণ, তাঁর দাবি, আওয়ামী লীগপন্থি আইনজীবীরা প্রতিদিন আদালতে যেতে পারছেন না। তাঁদের হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘একদিনে ৮৭ জন আইনজীবীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা যতটা পারছি সাহায্য করছি। কিছু কর্মীকে আইনি সহায়তা দিয়ে জেল থেকে মুক্ত করা গিয়েছে।’

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ইউনূস প্রায়শই বলে থাকেন, বাংলাদেশে এখন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি। ওবায়দুল কাদেরের মতে, বাংলাদেশ জুড়ে এখন চূড়ান্ত অরাজকতা। তার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী ওই প্রধান উপদেষ্টা। তাঁকে 'ক্ষমতালোভী' আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগের এই শীর্ষ নেতা বলেছেন, ‘এই উগ্রবাদী উত্থানের মূল নেতা মুহাম্মদ ইউনূস।’

ইউনূসের বিরুদ্ধে অনৈতিহাসিক ভাষণের অভিযোগ তুলে ওবায়দুল বলেছেন, ‘তিনি দু'বার সুস্পষ্টভাবে আন্দোলন নিয়ে কথা বলেছেন—আমেরিকায় গিয়ে তিনি এটাকে 'মেটিকুলাসলি অর্গানাইজড' আন্দোলন বলেছেন। একজন ছাত্রকে 'মাস্টারমাইন্ড' বলে পরিচয় করিয়ে নিয়েছেন। ইউনূসই আবার কিছু দিন পরে বলছেন, এই আন্দোলন আচমকা হয়েছে, এর সঙ্গে তাঁর কোনো যোগ ছিল না এবং ছাত্ররা তাঁকে দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেছিল বলেই তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন।’

ইউনূস-সহ বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক দলই শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে সরব। হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়েও বারবার এই অভিযোগ উঠেছে। ওবায়দুল অবশ্য তা পুরোপুরি মেনে নেননি। তাঁর কথায়, ‘আমাদের সময় দুর্নীতি হয়নি, এ কথা বলব না। কিন্তু আমাদের আমলে দুর্নীতি করলে সাজা হত। আমাদের সময় দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করেছে। আমাদের দলের কয়েকজন মন্ত্রী-সাংসদের বিরুদ্ধেও ওই কমিশন তদন্ত করেছে, তাঁদের সাজাও হয়েছে।’

বরং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানকে 'দুর্নীতিগ্রস্ত' বলে অভিযোগ করে তিনি বলেছেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংকের দিকে তাকান। ক্ষুদ্র ঋণের নামে কত মানুষ ঘরছাড়া, কত মানুষ জেলে গিয়েছেন, কত মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। এই ধরনের মানুষ দেশের নেতৃত্ব দেবেন?’

ইউনূসকে 'মুক্তিযুদ্ধবিরোধী' বলতেও ছাড়েননি আওয়ামী লীগের এই নেতা। তাঁর কটাক্ষ, ‘গত ৫ আগস্টের আগে কখনও শহিদ মিনারে যাননি, কখনও জাতীয় স্মৃতিসৌধে, বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে যাননি। তা থেকেই বোঝা যায়, লোকটা কতটা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী।’

বিরোধীরা বারবার প্রশ্ন তুলেছে, আওয়ামী লীগের আমলে গুম, ধর এবং নির্বাচনের নামে প্রহসন নিয়ে। গুম নিয়ে ইউনূসের প্রশাসন তদন্ত কমিশনও করেছে। এ নিয়ে সরাসরি কোনো উত্তর দেননি ওবায়দুল কাদের। উল্টে ফের বলেছেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের ছবি টাকা থেকে বাদ দিয়েছেন। তাহলেই বুঝে নিন, ইউনূস কতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ।’


সর্বশেষ সংবাদ