কিভাবে এলো নির্বাচন, কেন এলো ভোট?

  © ফাইল ফটো

মানুষ যখন থেকে সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করতে শুরু করেছে তখন থেকেই তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা। আর এই সংগঠনকেন্দ্রিক জীবন প্রণালী মানুষের মধ্যে তৈরি করেছে নেতা নির্বাচনের ধারণা। সেই সূত্রে নির্বাচন সুপ্রাচীন একটি প্রক্রিয়া। সভ্যতার এক একটি পর্যায়ে এই নির্বাচনী ব্যবস্থার ভিন্ন ভিন্ন রীতি প্রচলিত ছিল। তবে সপ্তদশ শতক থেকে বর্তমান বিশ্বে নির্বাচন কথাটি সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে দাড়িয়েছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি দেশের সরকার গঠনের পাশাপাশি আইনসভা কার্যনির্বাহী ও বিচারব্যবস্থা সাজানো হয়ে থাকে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমেই গঠন করা হয় আঞ্চলিক এবং স্থানীয় সরকার। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে ক্লাব, সমিতি থেকে শুরু করে বহু বেসরকারি সংস্থা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানেও প্রতিনিধি তৈরিতে এ ব্যবস্থা যেন আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চলুন ইতিহাসের কাল পরিক্রমা থেকে জেনে আসা যাক রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনী ব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশের আদ্যোপান্ত।

 

যেভাবে নির্বাচন ব্যবস্থার শুরু হলো 

সভ্যতার যাত্রার শুরু থেকেই নানা প্রয়োজনে মানুষ নির্বাচন ব্যবস্থার প্রয়োগ করে আসছে। তবে ইতিহাস বলছে, শাসন কাঠামো পরিচালনায় সর্বপ্রথম গ্রীকরাই নির্বাচন ব্যবস্থার প্রচলন করে।  লটারির মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের শাসক নির্বাচন করতো। সভ্যতার ইতিহাসের প্রাচীন কাল থেকেই প্রাচীন রোমেও নির্বাচনের ব্যবহার হয়ে আসছে এবং গোটা মধ্যযুগে পবিত্র রোমান সম্রাট ও পোপের মত শাসক বাছাই করতেও নির্বাচনের ব্যবহার হতো। দীর্ঘ সময় নিলেও ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থা উত্তরাধিকার নীতির বিপরীতে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। এছাড়া পাত্রে শস্যকণা নিক্ষেপের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনের প্রথা প্রচলিত ছিল আমেরিকার কয়েকটি আদিবাসী গোত্রের মধ্যে। 

আরব অঞ্চলে নির্বাচন

তবে সভ্যতার উর্বর ভূমি আরব অঞ্চলে নির্বাচন ব্যবস্থার প্রচলন দীর্ঘদিনের।  ইসলাম পূর্ববতী সময়ে এ অঞ্চলে গোত্রীয় শাসন ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। এক্ষেত্রে গোত্রীয় মর্যাদা, যোগ্যতা ও নেতৃত্ব প্রদানের দক্ষতার বিচারে নেতা নির্বাচিত হতেন। কোথাও কোথাও পরামর্শ ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার প্রচলনও ছিল। বংশীয় ধারা রক্ষার প্রচলিত নিয়ম ভেঙ্গে প্রাচীন ভারতে কখনো কখনো স্থানীয় প্রধান নির্বাচিত হতেন।  ইসলাম শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরবর্তী যুগে বিশেষ করে খোলাফায়ে রাশেদীনের সময় থেকে জনগনের পছন্দের ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়া আরো জোরদার হয়। 

প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা 

ভারতীয় সমাজে বৈদিক যুগ থেকে নির্বাচনের প্রচলন ছিল বলে জানা যায়।  বৈদিক যুগে ভারতের ‘গণ’ নামক সংগঠন রাজা নির্বাচন করতো। মধ্যযুগে এক শতাব্দী ধরে চলা ‘মাৎস্যন্যায়’ অবসানের জন্য বাংলার সামন্তপ্রধানরা গোপাল নামে এক জনপ্রিয় সামন্ত নেতাকে বাংলার রাজপদে নির্বাচিত করেন। দশম শতাব্দির শুরুর দিকে ভারতের চোলা সাম্রাজ্যের উঠিরামেরুরে (বর্তমানে তামিলনাড়ু) পাম গাছের পাতায় ভোটদানের মাধ্যমে গ্রাম পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করা হতো। মাটির তৈরি একটি পাত্রে প্রার্থীদের নাম লেখা পামপাতাগুলো রাখা হতো। কুডাভোলা নামক এ ব্যবস্থায় একজন বালককে গ্রাম পরিষদের যতজন সদস্য ততটি পাতা তুলতে বলার মধ্য দিয়ে প্রার্থী নির্বাচন করা হতো। অন্যদিকে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার পর উত্তরাধিকার ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালিত হলেও স্থানীয় শাসকের বিভিন্ন প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার জনগনের হাতে ছিল।

আধুনিক বিশ্বে নির্বাচন

আধুনিক বিশ্বে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয় ত্রয়োদশ শতকে। ইংল্যান্ডে সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে এই ব্যবস্থার সূচনা হয়। এরপর ১৬৯৪ সালে ট্রিনিয়্যাল অ্যাক্ট এবং ১৭১৬ সালের সেপ্টেনিয়্যাল অ্যাক্টের মাধ্যমে এই ব্যবস্থাকে স্থায়ী রুপ দেয়া হয়। ১৮৭২ সালে গোপনে ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদানের পদ্ধতি প্রণীত হয়। ১৯২৮ সালে সার্বজনীন ভোটাধিকার নীতি গ্রহণ করা হয়।

নারীদের ভোটাধিকার

গোপন ব্যালট পদ্ধতির নির্বাচন ব্যবস্থা প্রচলনের পর পুরুষরাই একমাত্র ভোট প্রদানের অধিকার রাখতো। ১৮৯৩ সালে সর্বপ্রথম নারীদের ভোট প্রদানের অধিকার নিশ্চিত করে নিউজিল্যান্ড। এরপর ১৯১৭ সালে রাশিয়া, ১৯১৮ সালে ইংল্যান্ড ও জার্মানি, ১৯২০ সালে মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্র এবং ১৯৪৪ সালে ফ্রান্স নারী ভোটাধিকার নিশ্চিত করে। এরপর ক্রমান্বয়ে বিশ্বের প্রায় সব দেশে নারীর ভোটাধিকার নিশ্চিত হলেও এই তালিকায় নাম লেখায়নি রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রধান কেন্দ্র ভ্যাটিকান সিটি।  দেশটিতে নারীদের ভোট দেয়া নিষিদ্ধ।

ভোট দেয়ার বয়স

নির্বাচন ব্যবস্থা প্রচলিত হওয়ার পর থেকে ভোট দেয়ার মার্জিন বয়স ছিল ২১ বছর এবং সেনাবাহিনীতে নিয়োগের ন্যূনতম বয়স ছিল ১৮ বছর। ১৯৭১ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালে মার্কিন নাগরিকরা উপলব্ধি করে যে একজন নাগরিক যে বয়সে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে পারে, সেই বয়সটিই তার ভোট দেওয়ার জন্য যোগ্য। ফলে সংবিধানের ২৬তম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ভোট দেওয়ার বয়স ১৮ করা হয়। বিশ্বে ভোট ব্যবস্থা চালু আছে এমন দেশগুলোতে এখন ১৮ বছর হলেই নাগরিকরা ভোট দেয়ার অধিকার লাভ করে। 

বাংলা অঞ্চলে যেভাবে এলো নির্বাচন 

উনিশ শতকের সত্তর ও আশির দশকে বাংলায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের আগ পর্যন্ত  এ অঞ্চলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। পঞ্চায়েতরা মূলত গ্রাম্য সরকারের কাজ করতেন। সাধারণ জনগন এসব পঞ্চায়েত নিবার্চিত করতেন। ১৮৬৮ সালে পৌর আইন (৬ নম্বর আইন) প্রণয়নের মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশ নির্বাচিত এবং এক-তৃতীয়াংশ মনোনীত সদস্যদের সমন্বয়ে পাশ্চাত্য ধরনের পৌর কমিটি গঠনের বিধান প্রর্বতন করা হয়। শুধু পৌর করদাতাদেরই সদস্য নির্বাচিত করার অধিকার ছিল। ১৮৮৪ সালে প্রবর্তিত ৩ নম্বর আইন বলে ঢাকাসহ বাংলার গুরুত্বপূর্ণ পৌরসভাগুলো নির্বাচনী ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়। পৌর ও গ্রাম এলাকায় এই সীমিত নির্বাচনী ব্যবস্থা চালুর পর থেকেই গ্রামপর্যায়ে ভোটাধিকার সম্প্রসারণের নতুন পর্বের সূচনা হয়। ১৯০৯ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় আইনসভায় নির্বাচনের বিধান প্রবর্তন করা হয়। ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ভোটাধিকার ও নির্বাচনী সংস্থাকে সম্প্রসারিত করা হয়। ১৯০৯ সাল থেকে সম্প্রদায় ও পেশার ভিত্তিতে নির্বাচন শুরু হয়। ১৯২০ সাল থেকে অনিয়মিতভাবে হলেও পৃথক নির্বাচনের ওপর ভিত্তি করে স্থানীয়, পৌরসভা ও জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন তখনো সর্বজনীন না হলেও সেখানে ব্যাপকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক আইন পরিষদে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পৃথক নির্বাচনব্যবস্থার ভিত্তিতে এটাই ছিল সর্বশেষ নির্বাচন। 


সর্বশেষ সংবাদ