‘সুচিন্তা’ যেভাবে চঞ্চল চৌধুরী হয়ে উঠলেন

চঞ্চল চৌধুরী
চঞ্চল চৌধুরী  © সংগৃহীত

যেকোনো চরিত্রে সাবলীল এক অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। যাকে অভিনয়ের যাদুকর বলা হয়। তিনি একজন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেতা। যেকোনো চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নিজকে মেলে ধরেছেন দর্শকদের মাঝে। অভিনয়, আত্মবিশ্বাস, সব মিলিয়ে সবার থেকে যেন আলাদা তিনি। সবশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘হাওয়া’ দিয়ে ফের দর্শকদের মুখে মুখে চঞ্চল।

পাবনার সুজানগরের ১৯৭৪ সালে এক হিন্দু পরিবারে জন্ম চঞ্চল চৌধুরীর। বাবা রাধে গোবিন্দ চৌধুরী ছেলের নাম রাখেন সুচিন্তা। গ্রামের আলো-বাতাস আর প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠেন তিনি। ১৯৯০ সালে উদয়পুর হাই-স্কুল থেকে এসএসসি আর রাজবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে ১৯৯২ সালে এইচএসসি পাস করেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই গান-বাজনা, আবৃত্তির পাশাপাশি নাটকের প্রতিও বিশেষ আগ্রহ ছিল তার।

১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে ভর্তি হন। চারুকলা অনুষদ থেকে এমএফএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। পড়তে এসে কিংবদন্তি অভিনেতা মামুনুর রশীদের নাট্যদল যোগ দেন। কাল দত্ত মঞ্চ নাটকে অভিনয় দিয়ে দর্শকের কাছ থেকে দারুণ প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। আরণ্যক নাট্যদলের সদস্য চঞ্চলের প্রথম অভিনীত চলচ্চিত্র ‘রূপকথার গল্প’।

বড় পর্দায় চঞ্চল চৌধুরী বরাবরই প্রশংসিত। ২০০৬ সালে তৌকির আহমেদ পরিচালিত গল্প সিনেমার মাধ্যমে বড় পর্দায় অভিষেক ঘটে। কাটপিস আর অশ্লীল সিনেমার যুগ থেকে বেরিয়ে এসে প্রথম যে বাংলা ছবি মধ্যবিত্তকে আবারও সিনেমা হল মুখে করেছে সেটি গিয়াসউদ্দিন সেলিমের মনপুরা।

২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া ইতিহাস সৃষ্টিকারী চলচিত্র মনপুরা। ভাগ্যবিড়ম্বিত সময় থেকে শুরু করে এখন ২০২২ সালে এসেও হাওয়া চলচ্চিত্রের মাঝি হয়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন সিনেমা হল। দর্শকদের অবিরাম ভালোবাসার মানুষটি চঞ্চল চৌধুরী। প্রথাগত নায়কদের মত সিক্স প্যাক বডি নিয়ে পর্দায় হাজির হননি তিনি। তার চরিত্রের নাম মানুষের হৃদয়ে গেঁথে যায়। কখনো কাঁদে কখনো হাসে কিন্তু দর্শকদের হতাশ করেনি।

গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ', মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর ‘টেলিভিশন', অমিতাভ রেজা চৌধুরীর ‘আয়নাবাজি', অনুম বিশ্বাসের ‘দেবী', গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘পাপ পুণ্য' এবং মেজবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া' চলচিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু ক্ল্যাসিকাল গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে বাস্তবের কাছাকাছি পৌঁছে দেওয়ার বিশেষ প্রতিভা রয়েছে এই অভিনেতার। নিজের অভিনয়ের মাধ্যমেই মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে।

আরও পড়ুন: কোক স্টুডিওর গানে নকলের অভিযোগ, যা বললেন অর্ণব

চঞ্চল চৌধুরী অভিনীত সবশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘হাওয়া’। মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত মিস্ট্রি, ড্রামা ঘরানার সিনেমাটি মুক্তির আগেই আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। বিশেষ করে ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটির জন্য। দর্শক সিনেমাটি দেখার জন্য মুখিয়ে ছিলেন এবং মুক্তির পরই তারা প্রেক্ষাগৃহে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তবে হাওয়া পরিবর্তন হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। আলোচনার পাশাপাশি সমালোচনায় জড়িয়ে পড়ে ‘হাওয়া’।

একের পর এক বৈচিত্র্যময় চরিত্রে হাজির হওয়া অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। তার হাসি মুখের অভিনয়শৈলী দিয়ে মাতিয়ে রাখবেন আরো অনেক বছর এটাই দর্শকদের কামনা।

টিভি নাটকে সাফল্য

২০১১ সাল থেকে তিনি আরটিভির অলসপুর ধারাবাহিকে অভিনয় শুরু করেন। মামুন অর রশিদের রচনা ও আল হাজেনের পরিচালনায় ধারাবাহিকটি ১২ই মে থেকে প্রচারিত হয়। এই ধারাবাহিকে অভিনয়ের জন্য তিনি ২০১২ ও ২০১৩ সালে টানা দুবার তারকা জরিপে শ্রেষ্ঠ টিভি অভিনেতা বিভাগে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন। এছাড়া তিনি এই কাজের জন্য ২০১৩ সালে ধারাবাহিক নাটকে শ্রেষ্ঠ কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনেতা বিভাগে বিভাগে আরটিভি আরটিভি স্টার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।

২০১২ সালে নভেম্বর মাস থেকে চ্যানেল নাইনের ইডিয়ট ধারাবাহিকে অভিনয় শুরু করেন। এই ধারাবাহিকে অভিনয়ের জন্য তিনি ২০১৪ সালে তারকা জরিপে শ্রেষ্ঠ টিভি অভিনেতা বিভাগে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন। এই বছরের ১৪ ডিসেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক পিতা চলচ্চিত্রে ইমন সাহার সঙ্গীতায়োজনে তিনি শাওনের সাথে "তোর ভিতরে আমি থাকি" গানে কণ্ঠ দেন।

২০১৩ সালে তিনি বাংলাদেশ ও জার্মানির যৌথ প্রযোজনায় মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত টেলিভিশন চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। একই বছর ঈদুল আযহায় প্রচারিত হয় তার অভিনীত টিভি নাটক ঈদের নাটক। রুম্মান রশীদ খান রচিত ও রিপন মিয়ার পরিচালিত নাটকটিতে তাকে একজন নাট্য পরিচালক হিসেবে দেখা যায়, যিনি রওনক হাসান অভিনীত চরিত্রের অনুরোধে ঈদের জন্য একটি নাটক পরিচালনা করেন।

২০১৪ সালে ভালোবাসা দিবসে এনটিভিতে প্রচারিত মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজের লাল খাম বনাম নীল খাম টেলিভিশন নাটকে তাকে দেখা যায়। এই নাটকটিতে অভিনয় করে তিনি ২০১৫ সালে সমালোচকদের দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ টিভি অভিনেতা বিভাগে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন। সমালোচক শাখায় এটি তার প্রথম মনোনয়ন। ২০১৫ সালে তিনি বৃন্দাবন দাস রচিত এবং সালাউদ্দিন লাভলু পরিচালিত ছয় পর্বের মিনি ধারাবাহিক ওয়াইফ মানে স্ত্রী-এ অভিনয় করেন। নাটকটি ঈদুল আযহা উপলক্ষে বাংলাভিশনে প্রচারিত হয়।

পুরস্কার ও সম্মাননা

তিনি তার অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, এবং সেরা অভিনেতা বিভাগে একটি মেরিল-প্রথম আলো দর্শক জরিপ পুরস্কার ও দুটি সমালোচক পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া তিনি মোট বারোটি মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের মনোনয়ন লাভ করেন।


সর্বশেষ সংবাদ