শিক্ষক থেকে রাজনীতিক আল্লামা বাবুনগরী
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২১, ০১:২৬ PM , আপডেট: ১৯ আগস্ট ২০২১, ০২:২২ PM
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর ও দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার শাইখুল হাদীস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী মৃত্যুবরণ করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আজ বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন।
আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ১৯৫৩ সালের ৮ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। ছিলেন একজন বাংলাদেশি দেওবন্দি ইসলামি পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, ইসলামি বক্তা ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর, দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষা সচিব ও শায়খুল হাদিস, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহ-সভাপতি, চট্টগ্রাম নূরানী তালীমুল কুরআন বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং মাসিক মুঈনুল ইসলামের প্রধান সম্পাদক ছিলেন।
এছাড়াও তিনি নাজিরহাট বড় মাদ্রাসার মুতাওয়াল্লী, মাসিক দাওয়াতুল হকের পৃষ্ঠপোষক, ইনসাফ২৪.কম ও কওমিভিশন.কমের প্রধান উপদেষ্টা সহ কয়েকটি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নেতৃস্থানীয় পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার অনুসারীরা তাকে ‘মজলুম জননেতা’, ‘কায়েদে মিল্লাত’, ‘আপোষহীন সিপাহসালার’ ইত্যাদি উপাধিতে ডেকে থাকে। তিনি পাকিস্তানের বিখ্যাত ইসলামি ব্যক্তিত্ব ইউসুফ বিন্নুরীর শিষ্য। মুসলিম নেতা হিসেবে তিনি দেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়। তিনি ২০১৩ সালের হেফাজত আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে কারাবরণ করেছিলেন।
জন্ম ও বংশ
বাবুনগরী ১৯৫৩ সালের ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার বাবুনগর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবুল হাসান ও মাতা ফাতেমা খাতুন। হারুন বাবুনগরী তার নানা। মায়ের দিক দিয়ে তার বংশধারা আবু বকর সিদ্দীকের সাথে মিলিত হয়। মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী তার মামা।
শিক্ষাজীবন
৫ বছর বয়সে তিনি আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগরে ভর্তি হন। এখানে তিনি মক্তব, হেফজ ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। কুরআনের হেফজ শেষ করার পর আজহারুল ইসলাম ধর্মপুরীর কাছে তিনি পুরো কুরআন মুখস্থ শুনিয়েছিলেন। এরপর তিনি ভর্তি হন দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসায়। ১৯৭৬ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। হাটহাজারী মাদ্রাসায় তার উল্লেখযোগ্য শিক্ষকগণের মধ্যে রয়েছেন: আব্দুল কাইয়ুম, আহমদুল হক (মুফতি), আবুল হাসান, আব্দুল আজিজ, শাহ আহমদ শফী সহ প্রমুখ খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ।
তারপর উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি পাকিস্তান গমন করেন। ১৯৭৬ সালে করাচিতে অবস্থিত জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়ায় তাখাচ্ছুছাত ফিল উলুমুল হাদিস তথা উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগে ভর্তি হন। ২ বছর হাদিস নিয়ে গবেষণা সম্পন্ন করে তিনি আরবি ভাষায় ‘সীরাতুল ইমামিদ দারিমী ওয়াত তারিখ বি শায়খিহী’ (ইমাম দারিমী ও তার শিক্ষকগণের জীবন বৃত্তান্ত) শীর্ষক অভিসন্দর্ভ জমা দেন। এই অভিসন্দর্ভ জমা দেওয়ার পর তিনি জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়া থেকে হাদিসের সর্বোচ্চ সনদ লাভ করেন। জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়ায় তার উল্লেখযোগ্য শিক্ষকগণের মধ্যে রয়েছেন: মুহাম্মদ ইউসুফ বিন্নুরী, ইদ্রিস মিরাঠী, আব্দুল্লাহ ইউসুফ নোমানী সহ প্রমুখ। পাশাপাশি তিনি ওয়ালী হাসান টুঙ্কির কাছে সুনান আত-তিরমিজী ও মুহাম্মদ ইউসুফ বিন্নুরীর কাছে সহীহ বুখারী দ্বিতীয় বারের মত অধ্যয়ন করেন।
কর্মজীবন
১৯৭৮ সালের শেষের দিকে তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করে বাবুনগর মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। বাংলাদেশের মাদ্রাসা সমূহের সর্বপ্রথম বাবুনগর মাদ্রাসায় তিনি উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগ চালু করেন। ২০০৩ সালে তিনি দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসায় যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক নিযুক্ত হন। ২০২০ সালের ১৭ জুন মাদ্রাসা কমিটি সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়। তার স্থলে মাদ্রাসার জ্যেষ্ঠ শিক্ষক শেখ আহমদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে তার অনুসারীদের দাবি অনুযায়ী, “তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার, দাবি আদায়ে কঠোর অবস্থানে থাকায় সরকারি চাপে তাকে সরানো হয়েছে।”
পরবর্তীতে ১৪ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় ছাত্র আন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলন তীব্র হতে থাকলে ১৭ সেপ্টেম্বর মাদ্রাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে মাদ্রাসার দায়িত্ব মজলিসে শুরাকে দিয়ে দেন। ওই দিন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে বাবুনগরীসহ তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি গঠিত হয়। তিনি মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস ও শিক্ষা সচিব হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।
২০১০ সালে তাকে মহাসচিব করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সংগঠনটির আমীর মৃত্যুবরণের পর ১৫ নভেম্বর সংগঠনের একটি কেন্দ্রীয় সম্মেলনের মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে তিনি আমীর নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালের মে মাসে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, “শিক্ষকতা জীবনে এ পর্যন্ত (২০১৯) আমার ছাত্র সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজারেরও বেশি।
পরিবার
পারিবারিক জীবনে তিনি বিবাহিত, ৫ মেয়ে ও ১ ছেলের জনক। ছেলের নাম মুহাম্মদ সালমান। পরিবারের সবাই ইসলামি কর্মকান্ডে সক্রিয় রয়েছেন।
গ্রেফতার
হেফাজত আন্দোলনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হত্যার অভিযোগ সহ কয়েকটি অভিযোগে ২০১৩ সালের ৭ মে তাকে পুরান ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দির এলাকা থেকে গ্রেফতার করে ১৩ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তিনি মুক্তি পান। রিমান্ডে তাকে অমানুষিক নির্যাতন ও চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল বলে তিনি দাবি করেছেন।
সমালোচনা
২০২০ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশে ভাস্কর্য বিতর্ক শুরু হলে ইসলামি নেতা মামুনুল হকের পক্ষে সমর্থন দিয়ে তিনি কঠোরভাবে ভাস্কর্য বিরোধী বক্তব্য তুলে ধরেন। তার এই মন্তব্যে আওয়ামী লীগ ও তার ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন সমূহের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।