সকাল বেলার পাখি কবি কাজী নজরুল ইসলাম

সকাল বেলার পাখি কবি হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গায়ক, সমাজ সংস্কারক। অন্যায়, অসত্যের বিরুদ্ধেও এক বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করার কারণে কারাভোগ করেন।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র (১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট) আজকের দিনে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের এক প্রবাদপুরুষ। কবি হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। শিশু, কিশোর, প্রৌঢ় সকলের জন্য লিখেছেন। মানবতার গানই গেয়েছেন সবসময়। আমি তাকে বলি সকাল বেলার পাখি কবি।

প্রকৃতিতে পাখিরা খুবই আনন্দের বিষয়। নিজের মতো করে ছুটে চলে কারো ধার ধারে এই পাখি। আকাশে যেমন, সাগরের উপরে তেমন। গ্রামে যেমন, শহরের ইট-পাথরে ঘেরা দালান কোটাতেও পাখির আচরণ একই। বিশাল যান্ত্রিক বিমানে বসে মানুষ বিশ্বভ্রমণ করে কখনো তো পাখি হতে পারেনি! তবে পাখির স্বভাব তো অর্জন করতে পারে। মনটা পাখির মতো আনন্দময় করা যেতে পারে।পাখির মতো ভয়হীনতা নিয়ে চলাফেরা করা যেতে পারে। সর্বোপরি পাখির স্বভাব অর্জন করা যায়। নজরুল কি চমৎকার করেই না বলেছেন-

আমি হবো সকাল বেলার পাখি/ সবার আগে কুসুমবাগে উঠবো আমি ডাকি।
সূর্যি মামা জাগার আগে উঠবে আমি জেগে/ হয়নি সকাল ঘুমো এখন মা বলবেন রেগে।

কবিতার ভেতর খোকা যখন সকাল সকাল জেগে ওঠার ঘোষণা দিয়েছে মা তো তখন রাগ করে ঘুমিয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। কেন?কারণ, এখনো সকাল হয়নি। মায়ের আদেশ শুনে খোকার দুঃসাহসিক জবাব-

‘বলবো আমি আলসে মেয়ে
ঘুমিয়ে তুমি থাকো
হয়নি সকাল তাই বলে কি
সকাল হবে নাকো!’

কি অসাধারণ এক কথা! যে কথা শুনলে মনের ভিতর সাহস চলপ আসে। কি আশা জাগানিয়া কথা। তারপরে তো আরো অবাক হওয়ার মতো কথা!

‘আমরা যদি না জাগি মা
কেমনে সকাল হবে
তোমার ছেলে উঠলে মাগো
রাত পোহাবে তবে।’

কবি নজরুল কি শুধু সকাল বেলার পাখি কবি? না, আমি ই তার নাম দিয়েছি সকাল বেলার পাখি কবি। কবি নজরুল তো মানবতার কবি, সাম্যের কবি। তিনি সারাটি জীবন মানুষের মাঝে যে ভেদাভেদ রয়েছে তা দূর করতে চেয়েছেন। তিনি লিখেছেন সাম্যের এক কবিত যার নাম “সাম্যবাদী”।

হ্যাঁ, নজরুল জাগরণের কবি। জাতিকে জাগিয়ে তোলার জন্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস,বক্তৃতা, ভাষণ, গান,সবই রেখেছেন,লিখছেন। অনেকে বলেন তিনি স্বাধীনতার কবি। ব্রিটিশদের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ ছিলো জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো। তাকে জেলে নিয়েও স্তব্ধ করা যায় নি। জেলে বসে লিখেছেন –

‘লাথি মার ভাঙরে তালা
যত সব বন্দীশালা
আগুন জ্বালা
আগুন জ্বালা
ফেল উপাড়ি।’

কি আশ্চর্যের এক কথা! তাই না? একজন কবি একটি জাতি কে জাগিয়ে তুলেছেন। শুধু বাঙালি জাতি নয়, পুরো ভারত উপমহাদেশকে জাগিয়ে তুলেছেন। দেখিয়েছেন স্বাধীনতার সিঁড়ি। নজরুলের কথা বললে তো মন সাগরের বিশাল হয়ে যায়। কি আজব! চাঁদ জোছনা জমে ওঠে এই বুকে– কেন? তার কারণ হলো:

‘পাতাল ফুঁড়ে নামবো আমি উঠবো
আমি আকাশ ফুঁড়ে
বিশ্বজগত দেখবো আমি আপন
হাতের মুঠোয় পুরে।’

আহা কি কল্পনা! কি ভাবনা! এরকম ভাবনা আর কেউ করেছেন তা আমার জানা নেই।

নজরুল ইসলাম শিশুদের জন্য রচনা করেছেন শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ “ঝিঙেফুল”। তিনি কত রসিক ছিলেন, কতটা প্রাণবন্ত, হাসোজ্জল ছিলেন তা তার ছড়াগ্রন্থ পড়লে বুঝা যায়। তার এক অসাধারণ কবিতা যার নাম হলো “লিচুচোর”। কবির নাম ছিলো খোকা। এই খোকা শিশু থেকে আস্তে আস্তে বড় হচ্ছেন তখন তো দুষ্টুমি আসে মাথায় নানান রকমের। পাড়াময় ঘুরে বেড়ানো, এর গাছের বরইতে ঢিল ছোঁড়া, ওর গাছের লিচু চুরির পরিকল্পনা–

‘বাবুদের তালপুকুরে/ হাবুদের ডাল কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া/ বলি থাম,একটু দাঁড়া!
পুকুরের এক কাছে না/ লিচুর এক গাছ আছে না
হোথানা আস্তে গিয়ে /য়্যাব্বর কাস্তে নিয়ে
গাছে গ্যে যেই চড়েছি /ছোট এক ডাল ধরেছি,
ও বাবা মড়াৎ করে/পড়েছি সড়াৎ জোরে।’

কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার রচনায় বিদেশি শব্দের প্রচুর ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে উর্দু, ফারসি, আরবি এবং ইংরেজি। তিনি ফারসি কবি ওমর খৈয়াম’র ‘রুবাইয়াত ‘ অনুবাদ করেছেন। তা থেকে বুঝা যায় তিনি কত বোদ্ধা ছিলেন ফারসি ভাষায়। তিনি পবিত্র কুরআনের ত্রিশ তম পারার কাব্য অনুবাদ করেছেন। যারা নাম তিনি দিয়েছেন ‘কাব্য আমপারা’। ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) জীবন নিয়ে রচনা করেছেন কাব্য জীবনী ‘মরুভাস্কর’। অবশ্যই তিনি তা পুরোপুরি শেষ করতে পারেননি।

মোসলেম ভারত পত্রিকায় প্রকাশের জন্য আফজালুল হক ঢাকার নওয়াব স্যার আহসান উল্লাহ বাহাদুরের কন্যা ও নওয়াব সলিমুল্লাহ বাহাদুরের বোন নওয়াবজাদী মেহেরবানু খানমের আঁকা একটি চিত্রশিল্প সংগ্রহ করেন। ছবিটিতে ফুটে উঠেছিল খেয়াপারের দৃশ্য। আফজালুল হকের ছবির পরিচিতি লিখে দিতে নজরুলকে অনুরোধ করলে নজরুল লিখলেন বিখ্যাত কবিতা ‘খেয়াপারের তরুণী’-

নহে এরা শঙ্কিত বজ্র নিপাতেও/ কান্ডারী আহমদ তরী ভরা পাথেয়।
আবু বকর, ওসমান, ওমর, আলী হায়দর/ দাঁড়ি যে এ তরণীর নাই ওরে নাই ডর!
কান্ডারি এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা/ দাঁড়ি মুখে সারি গান লা শরীক আল্লাহ

নজরুলকে নিয়ে এত অল্প লিখে শেষ করা মোটেই সম্ভব নয়। নজরুল হলেন প্রশান্ত মহাসাগর বরং অনেকক্ষেত্রে তারি চাইতে বিশাল। এই মহাসাগর পাড়ি দিতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। তারপর এক এক করে চলে গেলো অনেক বছর। কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেন কবি। স্তব্ধ হয়ে গেলো মুখের ভাষা। প্রায় ৩৬ বছর এভাবে বেঁচেছিলেন।

১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকা পিজি হাসপাতালে কবি ইন্তেকাল করেন। চলে গেলেন আমার সকাল বেলার পাখি কবি। কবি তার মৃত্যুর কথা ভেবেই হয়তো একদিন বলেছিলেন:

“মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই
যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।”

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence