বাংলাদেশে বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারা

১৯৫৯ সালে ভারত ভ্রমণে চে
১৯৫৯ সালে ভারত ভ্রমণে চে  © ফেসবুক

বাংলায় এসেছিলেন বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারা। হ্যাঁ বিস্ময়কর মনে হলেও এই তথ্য এখন সত্য। বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য প্রমাণ নথি ঘেটে সম্প্রতি আবিষ্কার হয়েছে বিপ্লবের এই মহানায়ক হেঁটেছিলেন বাংলাদেশের পথেও। পরিচয় গোপন রেখে কথা বলেছেন শ্রমিকদের সঙ্গে। বাংলাদেশের পাটকল ঘুরে দেখেছেন তিনি।

রাজনৈতিক দীক্ষা, বিপ্লবী রাজনীতিকে ছড়িয়ে দেওয়া, বিশ্বজুড়ে সমাজতন্ত্রের লড়াইকে বেগবান করতেই কিউবামুক্ত করা এই সফল বিপ্লবী ছড়িয়ে পরে স্পিলিন্টারের মতো আঘাত করতে চেয়েছিলেন পূঁজিবাদীদের শোষণের দূর্গে।

তাই তিনি নানাভাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। ১৯৫৯ সালে কিউবার হয়ে এশিয়ার উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ সফরে বের হয়েছিলেন চেগুয়েভারা। তিন মাসের সেই সফরে ঘুরতে ঘুরতে জুলাই মাসে এসেছিলেন বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান)।

তিনি বাংলাদেশে আদমজী পাটকলে শ্রমিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তবে সেই সব শ্রমিকরা জানত না তিনি আসলে কে।

বাংলাদেশে চে গুয়েভারার সঙ্গে স্বাক্ষাতের দাবি করা শ্রমিক নেতা ছায়দুল হক ছাদু সেই ঘটনার বর্ণনা দেন। এক সময় শ্রমিক নেতা হয়ে ওঠা ছায়দুল হক ছাদু ১৯৫৯ সালে ছিলেন সাধারণ শ্রমিক।

পরবর্তীতে তিনি আদমজী জুট মিলের শ্রমিক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হন। সেই শ্রমিক নেতা আদমজী জুটমিলের কর্মকর্তা হাসানের কাছে চে গুয়েভারার একটি ছবি সম্বলিত একটি বই দেখে স্বনাক্ত করেন যে এই ছবির মানুষটির সঙ্গেই তাদের মতবিনিময় হয়েছে।

ছাদু জানান, চে গুয়েভারা ১৯৫৯ সালের জুলাই মাসে আদমজী পাটকলে আসেন। সাদা রঙের একটি প্রাইভেট কারে করে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে তিনি আসেন এবং তার পরিচয় তখন সাধারণ শ্রমিকরা জানত না। তাই তার এই আগমনকে ছাইদুল হক ছদ্মবেশে আগমন হিসেবেই উল্লেখ করেন।

তিনি জানান, সেই সফরে আদমজী শ্রমিক ইউনিয়নের শ্রমিক নেতারা ছাড়াও ৩ নম্বর মিলের তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজারের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন চে গুয়েভারা। ৩০ মিনিটের মতো চের সঙ্গে আলাপ হয় শ্রমিকদের।

ছায়দুল হক ছাদুর দেওয়া সেই তথ্য যে মিথ্যা নয় তা আরো বেশকিছু তথ্যসূত্র থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়।

বিপ্লবী চে গুয়েভারার বিভিন্ন রহস্যময় সফর, গোপন দলিল প্রকাশ ও বিভিন্ন সময়ে আবিষ্কৃত নানা তথ্য-উপাত্ত থেকে ছায়দুল হকের করা দাবি আরো স্পষ্ট ও জোরালো হয়ে উঠেছে।

চে ১৯৫৯ সালে জাপান ও ভারতবর্ষ সফরে বের হন কিউবার সরকারি সিদ্ধান্তে। এটা উল্লেখ আছে বেশ কিছু দলিলে। ১২ জুন এই ভ্রমণে বের হন চে গুয়েভারা। এই সফরে তার সঙ্গী ছিলো দেহরক্ষী হোসে আর গুদিন, দুজন সরকারি কর্মকর্তা ওমর ফার্নান্দেজ ও ফ্রান্সিস কোগার্সিয়াবালস।

কায়রোয় দলটির সঙ্গে যোগ দেন গণিতবিদ সালবাদর বিলাসেকা ও ভারতে যুক্ত হন সাংবাদিক জোসে পার্দোয়াদা।

এই সফরে যাওয়ার কিছুদিন আগেই মাত্র চে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন প্রেমিকা অ্যালেইদা মার্চকে। অ্যালাইদা ছিলেন তার বিপ্লবী সহযোদ্ধা। সদ্যবিবাহিতা অ্যালাইদাও যেতে চেয়েছিলেন চে গুয়েভারার সঙ্গে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সফরে ব্যক্তিগত প্রভাব যাতে না পড়ে সেজন্য তিনি অ্যালাইদাকে নিয়ে যাননি সঙ্গী করে।

যা ছিল অ্যালাইদার জন্য বিরহের। দীর্ঘ এই সফরের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে আল্যাইদা এক স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছিলেন, ‘চেগুয়েভারার এ বিদেশ সফরের সময়টা ছিল ১৯৫৯ সালের ১২ জুন থেকে ৬ সেপ্টেম্বর। এ সফরে চে গিয়েছিলেন মিসর, সিরিয়া, ভারত, বার্মা (মিয়ানমার), শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান), পাকিস্তান (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান), যুগোস্লাভিয়া, থাইল্যান্ড, গ্রিস, সিঙ্গাপুর, সুদান ও মরক্কো।’

তার বাংলাদেশে আসার খবর পাওয়া যায় ভারতের দিল্লী থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা জন সত্তার সম্পাদক ওমথানভি’র এক লেখায়ও।

২০০৭ সালে ‘দ্যারোভিং রেভুলেশনারি’ নামে ‘হিমালসাউথ এশিয়ান’ একটি নিবন্ধন প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ভারত সফর শেষে চে গুয়েভারা বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) এসেছিলেন। বাংলাদেশ থেকে চে মিয়ানমার ( তৎকালীন বার্মা) হয়ে ইন্দোনেশিয়া ও জাপান যান।

চে’র ভারতবর্ষ সফরের তথ্য প্রকাশের পর অনেকেই এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তখন থানভি এ নিয়ে আরো বিস্তারিত গবেষণা করেন। কিউবা চে রিচার্স সেন্টারেও যান। এসব গবেষণা থেকে বের হয়ে আসে এঅঞ্চলে তার সফর সংক্রান্ত নানা তথ্য। তার গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমেই তিনি জানান ভারত থেকে চে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) এসেছিলেন। এরপর সেখান থেকে মিয়ানমার ( তৎকালীন বার্মা) গিয়েছিলেন।

চের ভারত সফর থেকে কেন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা ভারত সফরের কয়েকটি দিক বিবেচনায় আনতে পারি। যার একটি হলো পাট। চে ভারতের কৃষিমন্ত্রী এপি জৈনের সঙ্গে বৈঠকে ভারত থেকে পাট আমদানীর বিষয়ে আগ্রহ দেখান। তখন বাংলাদেশকে বলা হতো সোনালী আঁশের দেশ। অর্থাৎ উন্নতমানের পাট ও পাটজাত দ্রব্য উৎপাদনে বাংলাদেশ তখন এগিয়ে। যেহেতু পাটবিষয়ক আগ্রহ প্রকাশ করেন চে সেহেতু এতদূর ভ্রমনে এসে পাটের মূল অঞ্চলে প্রবেশ করার সুযোগ হাতছাড়া করার কোনো কারন নেই। সেখান থেকে চে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন সেই যুক্তিকে আরো জোরাল করেছে।

এখান থেকেই আমরা ফিরে যেতে পারি পাটকলের সেই শ্রমিক নেতা ছায়দুল হক ছাদুর কাছে। যিনি চের বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে দাবি করেছিলেন। এই পাটকল শ্রমিকের দেওয়া তথ্য, পাটকল পরিদর্শন ও চে’র পাটজাত দ্রব্যের প্রতি আগ্রহ এসব ঘটনাকে একসুতোয় গেঁথে নিলে চের বাংলাদেশ সফরের বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তবে চে গুয়েভারার বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মিয়ানমার ভ্রমণ নিয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক সরকারি দলিল প্রকাশ হয়নি। বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছিল।

বাংলাদেশ-পাকিস্তান এখন আলাদা রাষ্ট্র হলেও তৎকালীন সময়ে একটি রাষ্ট্র ছিল। তখন পাকিস্তান সরকার আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ট মিত্র। ধারণা করা হচ্ছে এসব কারণেও সফরটি গোপন রাখা হতে পারে।

চে গুয়েভারার জীবন নিয়ে গবেষণা করা লেখক জনলি অ্যান্ডারসন তার চে গুয়েভারা: আ রেভল্যুশনারি লাইফ বইতে লিখেছেন ‘চে গাজা ও পাকিস্তান সফর করেছেন। এসময় সাধারণ মানুষ বিপুল উল্লাসে তাকে বরণ করে নিয়েছেন।’
হোর্হে কাস্তেনাদা তার গ্রন্থ ‘কম্পানেরো: দ্য লাইফ অ্যান্ড ডেথ অব চে গুয়েভারা’য় শ্রীলংকা ও পাকিস্তান সফরের কথা উল্লেখ করেন।

[আরিফ রহমানের ফেসবুক থেকে নেয়া]


সর্বশেষ সংবাদ