বুকে লোহা বেঁধে সাগরে ফেলা হয়েছিল মাস্টারদা’র লাশ
- ফরহাদ কাদের
- প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:১০ AM , আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৯, ১২:৫০ PM
ভারতবর্ষে বৃটিশ শোষণের বিরুদ্ধে যে লোকটি তার বিপ্লবী দল নিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন; তিনি হলেন অমর বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেন। জন্ম ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি তাকে কারাগারের ভেতর ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল বৃটিশরা। অনেকেই তাকে বীর, বিপ্লবী, সূর্য-সন্তান ইত্যাদি ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে মাঠ গরম করেন। কিন্তু বেনিয়া-শোষক ব্রিটিশ শাসন কাঁপানো মাস্টারদাকে প্রকৃত অর্থে কতটা চেনেন নতুন প্রজন্ম? কী জানেন তার সম্পর্কে?
ভালো নাম ছিল সূর্যকুমার সেন, ডাকনাম কালু। যদিও মাস্টারদা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। মাতৃভূমিকে ব্রিটিশ মুক্ত করার আন্দোলনের এক পর্যায়ে তিনি ধরা পড়েন ইংরেজদের হাতে। ফাঁসি দেয়া ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারী। মধ্যরাতে। এর আগে তাঁকে নির্মম অত্যাচার করা হত্যা করা হয়। ব্রিটিশরা হাতুরী দিয়ে পিটিয়ে তাঁর দাঁত ও হাড় ভেঙ্গে দেয়। হাতুরী দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে অত্যাচার করার এক পর্যায়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। ফাঁসি দেয়ার পরও তাঁর লাশ হস্তান্তর করা হয়নি পরিবারের কাছে। এমনকি হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী পোড়ানোও হয়নি। জেলখানা থেকে ট্রাকে করে ৪ নম্বর স্টীমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মৃতদেহকে ব্রিটিশ ক্রুজার The Renown-এ তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরা বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন একটা জায়গায় ফেলে দেয়া হয়।
সূর্য সেন সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, ছেলেবেলা থেকেই তিনি পড়ালেখায় মনোযোগী, ধর্মনিষ্ট ও গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন। তার লেখাপড়ার শুরু দয়াময়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯১২ সালে চট্টগ্রামের নন্দনকাননের হরিশদত্তের ন্যাশনাল স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এফএ পাস করেন। ১৯১৮ সালে বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।
বিএ পাসের পর চট্টগ্রামে ফিরে ব্রাহ্ম সমাজের প্রধান আচার্য্য হরিশ দত্তের জাতীয় স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি দেওয়ানবাজারের উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে অংকের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতা করার কারণে তিনি ‘মাস্টারদা’ হিসেবে পরিচিত হন। ১৯১৬ সালে বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের ছাত্র থাকাকালে সূর্য সেন অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর সান্নিধ্যে আসেন। তিনি যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সূর্য সেনকে তিনি বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা দেন। ১৯১৮ সালে শিক্ষাজীবন শেষে চট্টগ্রামে ফিরে বিপ্লবী দলে যোগ দেন। ৪৯নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের নগেন্দ্রনাথ সেন ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে এসে সূর্য সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী ও চারুবিকাশ দত্তের সঙ্গে দেখা করেন। পরে অনুরূপ সেন, চারুবিকাশ দত্ত, অম্বিকা চক্রবর্তী, নগেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখদের সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামে গোপন বিপ্লবী দল গঠন করা হয়। সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী তখন চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানবাজার দেওয়ানজী পুকুরপাড়ে ‘সাম্য আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করে ওখানে থাকেন। সেখানে বিপ্লবীরা জমায়েত হতো। পরবর্তীতে চারুবিকাশ দত্ত তার সহকর্মীদের নিয়ে ‘অনুশীলন’ দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। অন্যদিকে ‘যুগান্তর’ দলের সভাপতি ছিলেন মাস্টারদা। এভাবে চট্টগ্রামেও বাঙলার অন্যান্য জেলার মতো দুটি বিপ্লবী দল গড়ে উঠে।
১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে অনেক বিপ্লবী যোগ দেন। গান্ধীজীর অনুরোধে বিপ্লবীরা এক বছরের জন্য কর্মসূচি বন্ধ রাখেন। সূর্য সেনও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯২২ সালে অসহযোগ প্রত্যাহার হলে বিপ্লবী দলগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠে। সে সময় চট্টগ্রাম কোর্টের ট্রেজারি থেকে পাহাড়তলীর আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কারখানার শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতন নিয়ে যাওয়া হতো। ১৯২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর টাইগারপাসের মোড়ে গুপ্ত সমিতির সদস্যরা বেতনের ১৭ হাজার টাকার বস্তা ছিনতাই করে। এর দুই সপ্তাহ পর গোপন বৈঠককালে পুলিশ বিপ্লবীদের আস্তানায় হানা দিলে খণ্ডযুদ্ধ হয়, যা ‘নাগরখানা পাহাড় খণ্ডযুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এতে গ্রেফতার হন সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী।
পরে সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী মামলা থেকে ছাড়া পেয়ে যান। গ্রেফতারের পর নির্যাতনের কারণে কলকাতা পুলিশ কমিশনার টেগার্টকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে বিপ্লবীরা। পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ায় ১৯২৪ সালে ২৫ অক্টোবর গ্রেফতার হন গণেশ ঘোষ, নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিংসহ আরও কয়েকজন। ১৯২৬ সালের ৮ অক্টোবর সূর্য সেন কলকাতার ওয়েলিংটন স্ট্রিটে গ্রেফতার হন। তাকে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়। পরে বোম্বের রত্নগিরি ও বেলগাঁও জেলে পাঠানো হয়। ১৯২৮ সালের শেষভাগে সূর্য সেন ও গণেশ ঘোষ ছাড়া পান।
১৯২৮ সালে কলকাতার পার্ক সার্কাসে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বার্ষিক অধিবেশনে চট্টগ্রাম থেকে যোগ দেন সূর্য সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিং, নির্মল সেন, লোকনাথ বল, তারকেশ্বর দস্তিদার প্রমুখ। সেখানে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের সঙ্গে সূর্য সেনের বৈঠক হয়। ১৯২৯ সালে সূর্য সেন চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৩০ সালে সশস্ত্র বিপ্লবের রূপরেখায় ঠিক করা হয় শুধু শহর না, গ্রাম ও কক্সবাজার থেকে বিপ্লবী নেওয়া হবে। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দলের নাম পরিবর্তন করা হয়- ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চিটাগাং ব্রাঞ্চ। দলকে কয়েক ভাগ করা হয়। সূর্য সেনের দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৫ জন। ওই বছর ১৮ এপ্রিল রাত ১০টায় চারটি বাড়ি থেকে চারটি দল আক্রমণের জন্য বের হয়। আগে থেকে রেললাইনের ফিসপ্লেট খুলে নিলে চট্টগ্রাম সমগ্র দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অন্য দল চট্টগ্রামের নন্দনকাননে টেলিফোন এবং টেলিগ্রাফ অফিস আক্রমণ করে। আরেকটি দল পাহাড়তলীর রেলওয়ে অস্ত্রাগার দখল করে। সর্বশেষে দামপাড়ায় পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক দখল করে নেয়। এ আক্রমণে অংশ নেওয়া বিপ্পবীরা দামপাড়া পুলিশ লাইনে সমবেত হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। মিলিটারি কায়দায় কুচকাওয়াজ করে সূর্য সেনকে সংবর্ধনা দেয়। তিনি অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন।
চট্টগ্রাম সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত ছিল চার দিন। এদিকে মাস্টারদাসহ ছয়জন শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবীকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার ৫ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ে (চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পাহাড়) বিপ্লবীদের ওপর ইংরেজ সৈন্যরা আক্রমণ করে। দুই ঘণ্টার যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০-১০০ এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন নিহত হন। এরপর বিপ্লবীরা আত্মগোপন করেন। ১৯৩২ সালের মার্চের মধ্যে সূর্য সেনের অনেক সঙ্গীর কারাদণ্ড ও নির্বাসন হয়। এ রায়ের পর সূর্য সেনকে ধরার জন্য পটিয়া এবং গোমদন্ডীতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ৫ হাজার টাকার বদলে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯৩২ সালের ১৩ জুন রাত ৯টায় পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী চক্রবর্তীর বাড়িতে তাকে ধরার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ক্যামেরনকে গুলি করে সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্ত পালিয়ে যান কিন্তু নির্মল সেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তার পরিকল্পনায় ২৩ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় ক্লাবে প্রীতিলতার নেতৃত্বে হামলা হয়। এতে ৫৩ জন ইংরেজ হতাহত হয়। গুলিতে আহত প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়নোসাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টায় গৈরলা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভার বাড়িতে বৈঠককালে পুলিশ ও সেনাবাহিনী বাড়িটি ঘিরে ফেলে। গুলিবিনিময় করে কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত ও সুশীল দাসগুপ্ত পালিয়ে যান। রাত ২টার দিকে অস্ত্রসহ ধরা পড়েন সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেন। পুলিশ তার হাতে লেখা অর্ধসমাপ্ত আত্মজীবনীর খাতা উদ্ধার করে। সেই খাতার ওপর লেখা ছিল ‘বিজয়া’। বিচারের সময় একে ষড়যন্ত্রের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেনকে প্রথমে জেলা গোয়েন্দা সদর দফতর, পরে কোর্ট হয়ে চট্টগ্রাম জেলে নেওয়া হয়। ১৯৩৩ সালের মার্চ মাসে বিপ্লবীরা জেল থেকে সূর্য সেনকে মুক্ত করার জন্য কয়েকবার চেষ্টা চালায়। প্রতিবারই তাদের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়।
১৯৩৩ সালের ১৫ জুন শুরু হওয়া মামলায় কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়। আগ্নেয়াস্ত্র বহন করা ছাড়া তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগের প্রত্যক্ষ প্রমাণ উপস্থাপন করা যায়নি। ১৯৩৩ সালের ১৪ আগস্ট রায় ঘোষণা করা হয়। ট্রাইব্যুনালে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। কল্পনা দত্তকে যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়া হয়। পরে তাদের পক্ষে কলকাতা হাইকোর্টে আপিলের আবেদন করা হয়। ১৪ নভেম্বর হাইকোর্ট আগের দণ্ড বহাল রাখে। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মধ্যরাতে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।
মৃত্যুর আগে জেলে আটক বিপ্লবী কালীকিঙ্কর দের কাছে সূর্যসেন পেন্সিলে লেখা একটি বাতায় তিনি লিখেছিলেন…… আমার শেষ বাণী- আদর্শ ও একতা। তিনি স্মরণ করেন তার স্বপ্নের কথা- স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন যার জন্য জীবনভর উৎসাহভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মতো তিনি ছুটেছেন। তার ভাষায় ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখ। তিনি সংগঠনে বিভেদ না নিয়ে আসার জন্য একান্তভাবে আবেদন করেন শেষ দিনগুলোতে জেলে থাকার সময়। তিনি তার বিপ্লবী দলের সহযোদ্ধাদের উদ্দেশে লেখেন- ১৯৩০ সালে ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিদ্রোহের কথা কোনো দিনই ভুলে যেও না। জালালাবাদ, জুলখা, চন্দননগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময় মনে রেখ। ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যেসব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের মনে রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, যারা কারাগারের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে তাদের সবাইকে জানাই আমার আশীর্বাদ। বিদায় নিলাম তোমাদের কাছ থেকে। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। বন্দেমাতরম।’
তাঁর ফাঁসির পরও যুব বিদ্রোহ আরও কয়েক বছর ছিল। শেষে ১৯৪১ সালের ২৩ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাই থানার দুর্গাপুরে বিপ্লবীদের সর্বশেষ ঘাঁটি থেকে গ্রেপ্তার হন বিপ্লবী দলের সর্বশেষ অধিনায়ক বিনোদ দত্ত। এর ভেতর দিয়ে শেষ হয় সূর্য সেনের নেতৃত্বে ১৯১৮ সালে শুরু হওয়া ব্রিটিশবিরোধী যুব বিদ্রোহের সব কর্মকাণ্ডের।