ভারতের পৌর নির্বাচনে হঠাৎ ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ ইস্যু
- টিডিসি আন্তর্জাতিক ডেস্ক
- প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২০, ১১:৪৫ AM , আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২০, ১১:৪৬ AM
ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেত্রী ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি বলেছেন, মুসলিমদের রাজনৈতিক দল সর্বভারতীয় মজলিসে-ই-ইত্তেহাদুল মুসলেমিনের (এমআইএম) নেতাদের নাম ছাপানো প্যাডে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’দের ভোটার তালিকায় তোলার সুপারিশ করা হয়েছে।
গত বুধবার হায়দরাবাদ নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে একটি জাতীয় টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে তিনি এ কথা বলেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হায়দরাবাদের সংসদ সদস্য এমআইএম-এর প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াইসি এবং তেলেঙ্গানা সরকারকে রোহিঙ্গা ও বেআইনিভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের জায়গা দেয়ার জন্য দায়ী করেছে বিজেপি। যদিও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দুই রাজ্য আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশ থেকে কথিত অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়টি বিজেপি নেতারা ভোটের ইস্যু হিসেবে তুলে ধরেন। তবে এবার সুদূর দক্ষিণ ভারতের হায়দ্রাবাদ শহরের পৌর নির্বাচনেও কথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গ তোলা হয়েছে।
বিজেপি তেলেঙ্গানা রাজ্য সভাপতি ও সংসদ সদস্য বান্ডি সঞ্জয় এক নির্বাচনী সভায় বলেন, আমাদের দল পৌরসভা নির্বাচনে জিতলেই রোহিঙ্গা ও পাকিস্তানিদের এক সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে পুরনো হায়দরাবাদ শহর থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে। তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি ও এমআইএম রোহিঙ্গা, পাকিস্তানি ও আফগানদের ভোট পেয়ে নির্বাচনে জেতার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
আরেকটি জনসভায় এমআইএম-এর প্রধান ও হায়দরাবাদের সাংসদ আসাদুদ্দিন ওয়াইসি বান্ডি সঞ্জয়ের এ অভিযোগের জবাব দেন। তিনি বলেন, বিজেপির অভিযোগ, হায়দরাবাদে ভোটার তালিকায় নাকি ৩০ হাজার ৪০ হাজার রোহিঙ্গা আছে। যদি ৩০ হাজার রোহিঙ্গা হায়দরাবাদে থাকে, তাহলে অমিত শাহ কী করছেন? তিনি কি ঘুমিয়ে আছেন? তিনি তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ৩০-৪০ হাজার রোহিঙ্গার নাম ভোটার তালিকায় কীভাবে আসল তার তো সেটা দেখার কথা।
অবৈধ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বান্ডি সঞ্জয়ের ব্ক্তব্যের পর বিতর্কের মধ্যেই গত বুধবার হায়দরাবাদে দলের প্রার্থীদের হয়ে প্রচারে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি। সেখানে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, একটি স্থানীয় টিভি চ্যানেলে দেখানো হয়েছে, ভোটার তালিকায় নাম তুলে দেয়ার জন্য এমআইএম ও তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রীকে প্রকাশ্যে একজন রোহিঙ্গা মুসলিম কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন। একটি জাতীয় চ্যানেলের প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, এমআইএম নেতাদের নাম ছাপা প্যাডে চিঠি লেখা হয়েছে, যাতে অবৈধ বাংলাদেশিদের নাম ভোটার তালিকায় তোলা হয়।
গত ৭-৮ বছর ধরে হায়দরাবাদ ১২শ থেকে ১৩শ রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিবার বসবাস করছে। তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই বেসরকারি জমিতে ঝুপড়ি করে। তারা সবাই শ্রমিক। নূর বাশার তাদেরই একজন।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী আমাদের কাছে এসে কখনই বলেনি, দলে এসো, তোমাদের নাগরিকত্ব পাইয়ে দেব বা ভোটার তালিকায় নাম তুলে দেব। কিন্তু কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে এরকম খবর দেখানো হয়েছে।
নূর বাশার বলেন, সমস্যাটা আসলে ভাষার। শরণার্থীদের বেশিরভাগই স্থানীয় ভাষা বোঝে না। আর আমার সামনে একবার সংবাদকর্মীদের কিছুটা রাজনৈতিক প্রশ্ন করতে দেখেছি। সাংবাদিক কাউকে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘আপনার নাম ভোটার লিস্টে আছে?’ কোনো শরণার্থী বলে দিয়েছে ‘হ্যাঁ’। আবার প্রশ্ন করেন, ‘এর জন্য কী এমআইএম ও মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি আপনি কৃতজ্ঞ?’ তিনি আবার বলছেন, ‘হ্যাঁ’। আসলে ওই শরণার্থী প্রশ্নটাই বুঝতে পারেননি!
রোহিঙ্গারা বলছেন, তাদের প্রায় সবারই জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের দফতর থেকে দেয়া পরিচয়পত্র আছে। যাদের সেই পরিচয়পত্র নেই, তাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। প্রাপ্ত বয়স্ক হলেই এই পরিচয়পত্র পাওয়া যাবে বলেও জানান রোহিঙ্গারা।
হায়দরাবাদের পৌরসভা নির্বাচনে হঠাৎ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গ তোলার ব্যাপারে বিশ্লেষকরা বলছেন, হায়দরাবাদের পৌরসভা নির্বাচন নয়, বিজেপি হিসাব কষেই এই ইস্যুটা তুলেছে। তবে তাদের আসল লক্ষ্য তিন বছর পরের বিধানসভা নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
হায়দরাবাদের ইংরেজি দৈনিক ডেকান ক্রনিকালের রেসিডেন্ট এডিটর শ্রীরাম কারি বলেন, তিন বছর পরের বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়েই এখন রাজ্য সরকারকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে বিজেপি। সেজন্যই তারা হিন্দু-মুসলিম প্রসঙ্গ সামনে এনে বিভাজনের চেষ্টা করছে। আর পুরনো হায়দ্রাবাদ শহর, যে অঞ্চলটি রাজনৈতিকভাবে আসাদুদ্দিন ওয়েইসির এমআইএম নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানেই এই তত্ত্ব চালানোর চেষ্টা হচ্ছে যে, এমআইএম অবৈধভাবে বাস করা পাকিস্তানি, বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছে।
শ্রীরাম কারি আরও বলেন, এটা খুবই দুর্ভাগ্যের। পৌরসভা নির্বাচনে ইস্যু হওয়ার কথা রাস্তা, আলো, পানি ও চিকিৎসা। কিন্তু এসবের বদলে বহু দূরের একটা ইস্যু নিয়ে আসা হলো।
এদিকে বিজেপি নেতাদের তাড়িয়ে দেয়ার হুমকির পরও রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সেরকম বিচলিত নন। তারা বলছেন, তাদের সবার কাছেই জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের দিল্লি দফতর থেকে দেয়া বৈধ নথি রয়েছে। তাই ভারত সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই তারা মেনে চলবেন।