সর্বাধুনিক যে ক্ষেপণাস্ত্র এখনো ব্যবহার করেনি ইরান

ইরানের অত্যাধুনিক খোররামশাহর ক্ষেপণাস্ত্র
ইরানের অত্যাধুনিক খোররামশাহর ক্ষেপণাস্ত্র  © সংগৃহীত

ইরানের সশস্ত্র বাহিনী ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তুতে শুক্রবার পর্যন্ত ১৫তম পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। তবে ইরান এখনো তার নতুন প্রজন্মের বা অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেনি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাসনিম নিউজ এজেন্সির প্রতিবেদনে এ দাবি করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল গত ১৩ জুন ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসী যুদ্ধ শুরু করে। তারা ইরানের পরমাণু, সামরিক ও আবাসিক স্থাপনাগুলোর ওপর বিমান হামলা চালায়। এতে অনেক উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা, পরমাণু বিজ্ঞানী ও সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়।

এ ঘটনার পরপরই ইরানের সামরিক বাহিনী পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। ১৯ জুন পর্যন্ত 'অপারেশন ট্রু প্রমিস থ্রি'-এর অংশ হিসেবে ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ডস কর্পস (আইআরজিসি) ইসরায়েলের ওপর ১৩ দফা পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।

তাসনিম নিউজ এজেন্সি বলছে, সামরিক বিশ্লেষকরা ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন, যা ইসরায়েলি আকাশ প্রতিরক্ষা কৌশলকে প্রায় অকেজো করে তুলেছে। এগুলোর মধ্যে আছে ইরান দিনে ও রাতে, উভয় সময়েই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে। এতে সময় ঠিক করতে এবং প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠন করতে ইসরায়েল কৌশলে ব্যর্থ হচ্ছে। ইরান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও আত্মঘাতী ড্রোনসহ বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করেছে। ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিভিন্ন ধরনের ও অনিয়মিত রণকৌশল প্রয়োগ করেছে, এতে আগাম পূর্বাভাস দিতে পারছে না ইসরায়েল।

আরও পড়ুন : যুক্তরাষ্ট্র ইরানে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করলে ভয়াবহ পরিণতি হবে: রাশিয়া

ইরান ইসরায়েলের বিভিন্ন জায়গায় একযোগে হামলা চালিয়ে তাদের চমকে দিচ্ছে। ইরানের কাছে বিশাল ডেটাবেইস আছে। এতে ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটি, তেল শোধনাগার, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোসহ নানা লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো সম্ভব হচ্ছে বলে জানান তারা। এ ছাড়া ইরান এখনো অনেক অত্যাধুনিক দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রকাশ করেনি, তাই ইসরায়েলের জন্য একের পর এক চমক আসতে থাকবে বলে জানিয়েছে তাসনিম নিউজ।

এদিকে লেবাননের সংবাদমাধ্যম আল মায়েদিন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইরানের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এবং ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) সাবেক কমান্ডার মোহসেন রেজাই রোববার সন্ধ্যায় ঘোষণা করেন যে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতি প্রতিক্রিয়ায় ইরান এখন পর্যন্ত কেবল পুরোনো প্রজন্মের অস্ত্র ব্যবহার করেছে। তিনি সতর্ক করে বলেন যে ইরানের পক্ষ থেকে প্রতিশোধের আরও শক্তিশালী অস্ত্র এখনো বেরই করা হয়নি।

তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, ইসরায়েলি দখলদারিত্বের জন্য যা অপেক্ষা করছে, তা ‘আরও বৃহত্তর এবং আরও তীব্র’ হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘দখলদার সত্তার সম্পূর্ণ পরাজয় না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে।’

তার মতে, ইরান চরম সংযম প্রদর্শন করেছে, ১.৫ টনের ওয়ারহেডসহ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে এবং দেশটি সবচেয়ে শক্তিশালী পেলোড স্থাপন করা থেকে বিরত রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা এখনো শক্তিশালী ওয়ারহেড ব্যবহার করিনি। তিনি সতর্ক করে বলেন যে নতুন ধরনের অস্ত্র শিগগির যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারে।

কী করতে পারে খোররামশাহর ক্ষেপণাস্ত্র

বিশেষজ্ঞ টাল ইনবার নিউ আরবকে বলেন, যদি একটি খোররামশাহর ক্ষেপণাস্ত্র কোনো প্রধান সড়ক বা ঘনবসতিপূর্ণ নগর এলাকায় আঘাত হানে, তাহলে সেটি উভয় পাশে অবস্থিত ভবনের পুরো ব্লক ধ্বংস করে দিতে পারে। যদিও ধারণা করা হয়, ইরানের হাতে এই ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা কয়েক ডজন থেকে কয়েক শর মধ্যে সীমাবদ্ধ, তবে তারা কাদর ও এমাদের মতো হাজার হাজার ক্ষেপণাস্ত্র সংরক্ষণ করে রেখেছে।

সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ইনবারের মতে, একটি সাধারণ ক্ষেপণাস্ত্রের খরচ প্রায় ১০ লাখ ডলার। খোররামশাহরের মতো উন্নত ক্ষেপণাস্ত্রের খরচ আরও অনেক বেশি হতে পারে। তবে ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন সরকারি মালিকানাধীন ও পরিচালনা করে ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড কপস (আইআরজিসি)। ফলে শ্রম ও উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে কম পড়ে।

আরও পড়ুন : ইউরোপে পালাচ্ছে ইসরায়েলি নাগরিকরা

ইরানের হাতে কত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আছে

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের সঠিক সংখ্যা কারোই জানা নেই। তবে ইসরায়েলি সামরিক সূত্রমতে, যুদ্ধের শুরুতে ইরানের হাতে ছিল প্রায় তিন হাজার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এর মধ্যে ২০০ ছোড়া হয়েছে, কিছু ইসরায়েলি বিমান হামলায় ধ্বংস হয়েছে। ফলে এখন সংখ্যাটি নেমে এসেছে আনুমানিক দুই হাজারে। তবে এই তথ্য যাচাই করা সম্ভব নয়।

ইরান এখন পর্যন্ত কী ব্যবহার করেছে ও করেনি?
ইরানের কাদর ও এমাদ ক্ষেপণাস্ত্র একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। উভয়ের পাল্লা প্রায় ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার, এবং এরা প্রায় ৭৫০ কেজি ওজনের ওয়ারহেড বহন করতে পারে; যদিও পুরোটা বিস্ফোরক নয়। ধারণা করা হচ্ছে, এমাদ ক্ষেপণাস্ত্র কাদরের তুলনায় বেশি নিখুঁতভাবে লক্ষ্যভেদ করতে সক্ষম। ২০২৩ সালে 'ট্রু প্রমিস' অভিযানের সময় এই ক্ষেপণাস্ত্র দুটি ব্যবহৃত হয়েছিল।

খাইবার শেকান হচ্ছে ইরানের একটি নতুন প্রজন্মের সলিড-ফুয়েল ক্ষেপণাস্ত্র। এর পাল্লা তুলনামূলকভাবে কম, প্রায় ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার। ফলে এটি কেবল ইরানের পশ্চিমাঞ্চল থেকে ছোড়া হলে ইসরায়েলে পৌঁছাতে পারে। এর ওয়ারহেড ৫০০ থেকে ৬০০ কেজি হলেও, সলিড-প্রোপালশন ব্যবস্থার কারণে এর গতি ও নিখুঁতভাবে হামলার সক্ষমতা বেশি।

দ্য নিউ আরবের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান এখনো ব্যবহার করেনি শহীদ হাজ কাসেম ক্ষেপণাস্ত্র, যার নামকরণ করা হয়েছে কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সোলাইমানির নামে। এটি একটি সলিড-ফুয়েল ক্ষেপণাস্ত্র এবং ইরানের পক্ষ থেকে একে হাইপারসনিক বলা হয়। কারণ এর গতিবেগ শব্দের গতির পাঁচ গুণ। তবে পশ্চিমা বিশ্লেষকরা এই 'হাইপারসনিক' ট্যাগ মানতে নারাজ। তাদের যুক্তি, এর ত্রিমাত্রিক চলাচলের সক্ষমতা নেই।

সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ক্ষেপণাস্ত্রে রয়েছে ইলেক্ট্রো-অপটিক্যাল গাইডেন্স ও অত্যন্ত উচ্চ মাত্রার নিখুঁত সক্ষমতা।

ইসরায়েলি গবেষক ইয়েহোশুয়া কালিস্কি দাবি করেন, ১৫ জুন ইরান সম্ভবত এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলের বাত ইয়াম ও রেহোভট শহরের দিকে অন্তত একটি হামলা চালিয়েছে। লক্ষ্যবস্তুগুলোর একটি ছিল সম্ভবত উইজমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স।

তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো, ইরান এখনো ব্যবহার করেনি ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের ভাষায় 'ডুমসডে অস্ত্র' হিসেবে পরিচিত খোররামশাহর ক্ষেপণাস্ত্র। এটি ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। এর ওয়ারহেড বহনক্ষমতা ১ হাজার ৮০০ কেজি পর্যন্ত। ২০১৭ সালে এটি উন্মোচন করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো সামরিক অভিযানে ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!