দুই সীমান্ত পাহারায় নতুন যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে বিএসএফ
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৪১ PM , আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৪১ PM
ভারতের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার দুটি অঞ্চলে সীমান্ত প্রহরায় নতুন বেশ কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। এই অঞ্চলের বাংলাদেশ সীমান্তের একদিকে আছে যশোর, আরেক দিকে সাতক্ষীরা জেলা।
বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের প্রায় ৩৬৩ কিলোমিটার নদী সীমান্ত। ফ্রন্টিয়ারের ৯০০ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকার মধ্যে প্রায় ৪০০ কিলোমিটারে চিরাচরিত কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া গেছে, বাকি প্রায় অর্ধেক এলাকায় এখনো কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া সম্ভব হয়নি বলে বিএসএফ জানাচ্ছে।
কিন্তু এই এলাকায় বেশ কিছু অরক্ষিত বা ভালনারেবল জায়গা চিহ্নিত করেছে বিএসএফ, যেগুলো দিয়ে সীমান্ত অপরাধ হচ্ছে। চিহ্নিত জায়গাগুলোতে প্রহরীরা তো থাকবেনই আগের মতো, কিন্তু তার সঙ্গে সমন্বিত একগুচ্ছ অন্য ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।
নতুন সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় এক সারি কাঁটাতারের বেড়া লাগানো হবে এবং একই সঙ্গে নজরদারির জন্য একাধিক বৈদ্যুতিক যন্ত্র এবং অত্যাধুনিক ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। সঙ্গে প্রহরীদের সতর্ক করার জন্যও কিছু যন্ত্র লাগানো হয়েছে।
বিএসএফ বলছে, ‘ইলেকট্রনিক সারভেইল্যান্স অ্যাট ভালনারাবেল প্যাচেস–ইএসভিপি’ বা ‘অসুরক্ষিত এলাকাগুলোর জন্য বৈদ্যুতিক নজরদারি’ ব্যবস্থা।
আবার সীমান্ত লাগোয়া ১৫০ মিটার বসতি খালি করে দিয়ে সেখানকার মানুষকে অন্যত্র জমি দেওয়ার জন্য আলোচনাও চলছে। সীমান্ত লাগোয়া এলাকা খালি করে দেওয়ার পরেই সেখানে ইএসভিপি ব্যবস্থাপনা চালু করা হবে।
মাঝে সোনাই নদ, দুদিকে দুই দেশ
সাতক্ষীরার বিপরীতে উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগর থানার অধীন একটি গ্রাম তারালি। উল্টো দিকে সাতক্ষীরা জেলার কাকডাঙ্গা গ্রাম। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে সোনাই নদ। এখানে কোনো কাঁটাতারের বেড়া নেই। তাই এই অঞ্চলে সীমান্ত পাহারা দেওয়া কতটা কঠিন, সেটা বলতে বলতে নদীর ধার দিয়ে কয়েকজন সাংবাদিককে নিয়ে হাঁটছিলেন বিএসএফের কর্মকর্তারা।
তারালি গ্রামের শ্মশানের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে এক কর্মকর্তা বললেন, ‘আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চারদিক পুরো অন্ধকার হয়ে যাবে। এক পা দূরের পথও দেখা যায় না। এর মধ্যেই আমাদের প্রহরীদের নজর রাখতে হয় যাতে সীমান্ত দিয়ে কোনো অবৈধ কাজ না হয়।’
তিনি বলেন, ‘অথচ এই জায়গাটা খুবই অপরাধপ্রবণ। একটা সময়ে এই অঞ্চল দিয়ে প্রচুর গরু পাচার হতো। এখন সেটা বন্ধ। তবে সীমান্তের ওদিক থেকে মানুষ আসা এবং সোনা পাচার চলে আর এদিক থেকে বাংলাদেশের দিকে পাঠানো হয় রুপা, গাঁজা, পোশাক ও দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্র।’
তিনি বলছিলেন, ‘স্থানীয় কালোরা বাজার, হাকিমপুরের বাজারগুলোতে খোঁজ নিলে দেখবেন প্রয়োজনের তুলনায় প্রচুর বেশি সামগ্রী তারা মজুত করে। এতই বেশি খাদ্যসামগ্রী, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস এমনকি বিড়ি মজুত থাকে, যা এই গ্রামের মানুষের দরকারের থেকে বহু গুণ বেশি। এসবই রাতের অন্ধকারে অন্যদিকে পাচারের জন্য রাখা থাকে। আমরা সব জানি কে কোথায় কী সামগ্রী মজুত করছে।’
২২ হাজার মানুষকে সরাতে হবে
বিএসএফের আরেক সিনিয়র অফিসার বলেন, ‘এটা এমন এক অঞ্চল, প্রায় সবারই আত্মীয়স্বজন দুদিকেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এরা একই সময়ে নদীতে স্নান করেন, গল্পও করেন। আবার রাতে পাচারও হয় এখান দিয়েই।’
তার কথায়, ‘এ জন্যই এই গ্রামটি অত্যন্ত অরক্ষিত সীমান্ত। তাই এই নদীর ধারেও আমাদের নতুন প্রহরার কথা ভাবা হয়েছে। এর জন্য নদী এবং সীমান্ত লাগোয়া জায়গা থেকে ১৫০ মিটার দূরে বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে।’
যদি পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে স্থানীয় প্রশাসন জমি অধিগ্রহণ করতে পারে, তাহলে প্রায় ২২ হাজার মানুষকে সরতে হবে বলে জানালেন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এক অফিসার।
তিনি বলেন, ‘স্থানীয় প্রশাসন আইন অনুযায়ী বাসিন্দাদের জমির দাম ক্ষতিপূরণ হিসাবে দিতে চেয়েছে। তবে এখানকার মানুষ বলছেন, শুধু জমি দিলে কী করে হবে, তাদের বাড়িঘরও তো ছাড়তে হবে, তার ক্ষতিপূরণও করা হোক। প্রায় রোজই গ্রামবাসীদের সঙ্গে বৈঠক হচ্ছে। যদি প্রশাসন রাজি করাতে পারে, তাহলে এই তারালি গ্রামেরই প্রায় ২২ হাজার মানুষকে সীমান্ত লাগোয়া এলাকা থেকে সরানো হবে। তারপরে এখানে চালু হবে নতুন পদ্ধতিতে সীমান্ত প্রহরার ব্যবস্থাপনা।’
যখন বিএসএফের ঘাটে ফিরছেন এই প্রতিবেদক, তখন টর্চের আলো ছাড়া এক পা-ও ফেলা যাচ্ছে না। ওই ঘাটেই অন্ধকারের মধ্যে এক বয়স্ক মানুষ বলছিলেন, ‘সীমান্তে বেড়া দেওয়া হবে শুনছি। হলে তো ভালোই হয়, আমরাও চাই সেটা। কিন্তু আমাদের ঘর ছেড়ে যে চলে যেতে হবে, তার জন্য তো সরকারকে ব্যবস্থা করতে হবে!’
বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই অবশ্য সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চলের বাসিন্দাদের একাংশ ক্ষতিপূরণ নিয়ে সরে যাওয়ার পক্ষেই কথা বলেছিলেন।
হ্যালো এক্সেলেন্সি, অল গুড?
বিএসএফ নতুন যে সীমান্ত পাহারার ব্যবস্থা করেছে, সেটা ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে ওই উত্তর ২৪ পরগনারই আরেকটি সীমান্তে। সেই ব্যবস্থা হাতে-কলমে দেখাচ্ছিলেন বিএসএফ রক্ষীরা। জায়গাটা পেট্রাপোল সীমান্ত ফটকের একেবারে গায়েই।
একটা মনসা মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে বিএসএফের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বললেন, ‘আমাদের যেমন সীমান্ত পাহারা দিতে হয়, তেমনই আবার এই মন্দিরে বিশাল জনসমাগমের ব্যবস্থাও করতে হয়। তার জন্য আলাদা একটা গেট করতে হয়েছে আমাদের।’
মন্দিরের পেছনেই কচুরিপানায় ভরা একটা খাল। তার ওপারে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডসের ক্যাম্প। খালের ধার দিয়ে মাটির এবড়োখেবড়ো পথে হাঁটতে হাঁটতে বিএসএফের এক কর্মকর্তা বলছিলেন, ‘খালের ঠিক ওপারে দেখুন মাঝেমধ্যে সাদা পতাকা লাগানো আছে। ওই পর্যন্ত ভারতের এলাকা। তারপরেই বাংলাদেশের এলাকা শুরু।’
বাংলাদেশের এক রক্ষীকে দেখে এদিক থেকে বিএসএফ অফিসার হাত তুলে চেঁচিয়ে বললেন, ‘হ্যালো এক্সেলেন্সি। অল গুড?’
ওদিক থেকেই হাত তুলে অভিবাদন ফিরিয়ে দিলেন বিজিবির অফিসার।
বিএসএফের ওই অফিসার বলছিলেন, ‘এটা আমাদের মধ্যে সব সময় চলতে থাকে। একে অপরকে আমরা এক্সেলেন্সি বলে সম্বোধন করি।’
কাঁটাতারের কাছে যেতেই যা ঘটল
খালের পাড় দিয়েই এক সারি দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া। চিরাচরিতভাবে সীমান্তে যে কাঁটাতারের বেড়া লাগানো হয়, এটা সে রকম নয়।
সেখানকার এক বিএসএফ কর্মকর্তা বলছেন, ‘এলাকা অনুযায়ী আমাদের বিভিন্ন ব্যবস্থা উদ্ভাবন করতে হয়েছে। যেমন এই বাঁশের খুঁটির গায়ে এক সারি দিয়ে কাঁটাতার। এগুলোকে আমরা বলছি সিঙ্গল রো ফেন্সিং।’
তবে এটাই স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। বাঁশের খুঁটিতে সাধারণ মানুষ যেমন কাঁটাতার বেঁধে বেড়া দেন, এটা অনেকটা সে রকম। তবে জমি অধিগ্রহণ হয়ে গেছে এখানে। স্থানীয় প্রশাসন খুঁটি পুঁতে দিয়ে জায়গা চিহ্নিত করে গেছে। এবার সিঙ্গল রো ফেন্সিং বসলে সেটা হবে স্থায়ী ব্যবস্থা–সিমেন্ট ঢালাই করে খুঁটি পুঁতে এক সারির বেড়া দেওয়া হবে এই জায়গায়।
কর্মকর্তারা দেখাচ্ছিলেন, এলাকা অনুযায়ী নানা ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবন করে যে সমন্বিত প্রহরা চালু করেছেন, সেটা ঠিক কী? ঠিক তখনই কারও একটা পা পড়েছিল বেড়ার একেবারে পাশে থাকা একটা শুকনো গাছের ডালে। হঠাৎই সবাইকে চমকে দিয়ে সাইরেন বেজে উঠল!
হকচকিত হয়ে সেখানে যে প্রহরী ছিলেন, তিনি দ্রুত নিচু হয়ে শুকনো গাছের পাতার তলায় হাত দিয়ে একটা সুইচ বন্ধ করে দিলেন, থামল তারস্বরে বাজতে থাকা সাইরেন।
বিএসএফের এক কর্মকর্তা বললেন, ‘এটা আমাদের একটা উদ্ভাবন ইন্ট্রুডার অ্যালার্ম। শুকনো গাছের পাতার তলায় লুকোনো আছে এই বাক্সটা। ওখানে পা পড়লেই সাইরেন বেজে ওঠে কাছাকাছি থাকা প্রহরীদের সতর্ক করে দেবে।’
এ ছাড়া পুরো এলাকায় খুঁটির মাথায় জোরালো আলো লাগানো হয়েছে, বসানো হয়েছে অতি উচ্চমানের সিসিটিভি।
এক অফিসার বলেন, ‘এসব ক্যামেরা প্রায় এক কিলোমিটার পর্যন্ত স্পষ্ট ছবি তুলতে পারে। কিছু ক্যামেরা আছে ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পাওয়া যায়, আর কিছু ক্যামেরা ফিক্সড। সব ক্যামেরার ছবি সীমান্ত চৌকির কন্ট্রোল রুমে বসে দেখা যায়।’
ফেনসিডিল, সোনা পাচার চিন্তার বিষয়
বিএসএফ দাবি করছে, গত বছর তিনেকে দক্ষিণবঙ্গ সীমান্ত অঞ্চলে গরু পাচার বহুলাংশে বন্ধই হয়ে গেছে।
এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের এখন বড় চিন্তা ফেনসিডিল পাচার। এমন একটা দিনও যায় না, যেদিন পাঁচ-ছয় এমনকি সাতটি জায়গা থেকেও আমরা বহু ফেনসিডিল পাচার ধরছি। এর অর্থই হলো পাচারের চেষ্টা চলছেই নিয়মিত এবং এটা বাড়ছে। এ ছাড়া সোনা পাচারও বাড়ছে এই সীমান্ত দিয়ে।’
তনি বলেন, ‘বছর দুয়েক আগেও পাচার হওয়ার সময়ে তেমন একটা সোনা আমাদের হাতে আটক হতো না। কিন্তু এখন ব্যাপকভাবেই বাংলাদেশ থেকে পাচার করে আনা সোনা আমাদের হাতে ধরা পড়ছে। পুরো ফ্রন্টিয়ারে ২০২৩ সালে ১৬০ কেজিরও বেশি সোনা ধরা পড়েছিল, সেটা ২০২৪ সালে বেড়ে হয়েছে ১৭৬ কেজিরও বেশি।’
ফেনসিডিল বা অন্য যেকোনো জিনিস পাচারের একটা কৌশল অনেক বছর ধরেই পাচারকারীরা ব্যবহার করতেন– কাঁটাতারের বেড়ার ওপর দিয়ে প্যাকেট 'টপকিয়ে' দেওয়া।
‘সীমান্তের এদিকে গাছপালা-জঙ্গল, ওদিকে চাষের ক্ষেত আর জঙ্গল। এর মধ্যে পাচারকারীরা লুকিয়ে বসে থাকে দীর্ঘক্ষণ’ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা নজর রাখে কখন বিএসএফ প্রহরীর চোখ অন্যদিকে ঘুরেছে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কাঁটাতারের বেড়ার ওপর দিয়ে প্যাকেট টপকিয়ে দেওয়া হয়। ওদিকের পাচারকারী জিনিস নিয়ে চলে যায়।’
সীমান্তচৌকি জয়ন্তীপুরে প্রহরারত এক নারী প্রহরী বলছিলেন, ‘আমি একদিন রাতের ডিউটি করছিলাম। বেড়ার ওদিক থেকে একটা প্যাকেট উড়ে এসে এই সামনের বাড়িতে এসে পড়েছিল। এখন আর সেই সুযোগ নেই। কাঁটাতারের বেড়ারও ওপরে উঁচু নাইলন জাল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে।’