বজ্রকন্ঠে তর্জনীর হেলনে মুক্তির বার্তা
- অধ্যাপক ড. মো: আকরাম হোসেন
- প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২২, ০৯:৫৯ PM , আপডেট: ০৬ মার্চ ২০২২, ১০:১৫ PM
৭ মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর একটি। ১৯৭১ সালের এইদিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) বিশাল জনসমাবেশে ঐতিহাসিক এক ভাষণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের জন্য জাতিকে প্রস্তুত করেন এবং সংগ্রামের পথ রচনা করেন।
ভাষা, সংস্কৃতি, সংগ্রাম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, খাদ্যাভ্যাস - প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রচণ্ড অমিল থাকার পরেও কেবল ধর্মের ভিত্তিতে এক হাজার মাইলের অধিক দূরত্বে থাকা পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশকে একত্র করে এর নাম পূর্ব পাকিস্তান দিয়ে ১৯৪৭ সালে অসম এক কৃত্রিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রটি শুরু থেকেই ছিল বাঙালি-বৈরি। পশ্চিম পাকিস্তান বাঙালির প্রাণের ভাষা 'বাংলাকে' আক্রমণের মধ্য দিয়ে বাঙালিদের শোষণ-নিপীড়নের সূচনা করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাকে পরিণত করে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প কারখানার কাঁচামালের যোগানদাতা হিসেবে৷ পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প কারখানাগুলোর নিয়ন্ত্রণও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য পাকিস্তানের পূর্বাংশে ভরাযৌবনা হলেও করলেও সমস্ত লভ্যাংশ পাচার হতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানে।
১৯৪৬ সালে পাঁচ বছরের জন্য পাকিস্তান প্রাদেশিক আইন পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই হিসেবে পাঁচ বছর পর অর্থাৎ ১৯৫১ সালে আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকেরা এই নির্বাচন নানা অজুহাতে বিলম্বিত করতে থাকে। নির্বাচন বিলম্বিত করার পেছনে কারণ ছিল ১৯৪৯ সালে টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিশাল ভরাডুবি। এই পরাজয় তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করেছিল। বাঙালি নীরবে এই অন্যায় হজম করে নেয়নি। মুসলিম লীগের অনিয়ম এবং শোষণের প্রতিবাদস্বরূপ মুসলিম লীগ ক্রমশই সংকুচিত হতে থাকে।পূর্ব পাকিস্তানে গড়ে ওঠে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল।এই দলগুলোর চাপে পড়ে মুসলিম লীগ সরকার প্রাদেশিক নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলে পূর্ব পাকিস্তানের সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো এক হয়ে মুসলিম লীগ বিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠণ করে। ১৯৫৪ সালের ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে সরকার গঠন করলেও সামরিক শাসন জারি করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেয়া হয়। ৬২' সালে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টকে কেন্দ্র করে আন্দোলন শুরু হয়। '৬৬ সালে বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক 'ছয় দফা' উত্থাপন করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতির পিতার আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকেরা তাঁকে ক্ষমতায় আসতে দেয়নি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ ২৪ বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশ করেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালির চরম দুর্দিনে ঠিক যেন আশার প্রদীপ হয়ে দেখা দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭ মার্চ তিনি বজ্রনিনাদে ঘোষণা করেন বাঙালির মুক্তির রূপরেখা।
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনা যেভাবে বাংলাদেশকে বদলে দিলেন
৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ফুটে উঠেছে৷ বাঙ্গালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছেন তাঁর বাগ্মিতার বুলেটে। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পরই এটা স্পষ্ট হচ্ছিল যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তারা নানা কৌশলে কালক্ষেপণ করছিল আর বাঙালির বিরুদ্ধে হামলে পড়ার জন্য সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। বঙ্গবন্ধু এসব জানতেন। তাই ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বাঙালি জাতিকে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতির নির্দেশনা দিয়েছেন। এ ভাষণ এমন এক ভাষণ, যেখানে তিনি অনুচ্চারেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন কিন্তু প্রতিপক্ষকে কোন সুযোগ দেননি বাঙালিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহী বলার। রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক ব্যাকরণের প্রতিটি সূত্র প্রতিফলিত হয় এই ভাষণে।
পৃথিবীর সেরা রাজনৈতিক ভাষণের তালিকায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ব্যতিক্রমী এবং অনন্য। অন্য সব কালজয়ী ভাষণ ছিল পূর্বলিখিত। লিখিত বক্তব্য যতটা না মন থেকে আসে তার চেয়ে বেশি আসে কলম থেকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি লিখিত ছিল না। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার মনের কথা জনতার উদ্দেশ্যে বলেছেন। প্রায় ১৯ মিনিটের ভাষণ শেখ মুজিব শুরু করেছিলেন জনতাকে ‘আপনি’ সম্বোধনের মাধ্যমে। বলেছিলেন ‘আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন’। তিনি জনতাকে তার সহযাত্রী মনে করেছিলেন। তাঁর এসকল সহযোদ্ধারা সব কিছু সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল। উভয়ের দুঃখ-বেদনা আশা-আকাঙ্ক্ষা এক। কেউ কারও চেয়ে কম জানে না বা বোঝে না। প্রকৃত নেতা কখনও তার কর্মী-সমর্থকদের ‘কম বুদ্ধিমান’ মনে করেন না। যেমন করেননি বঙ্গবন্ধু। তিনি শুধু বাস্তবতার দিকগুলো তুলে ধরেছেন। সাধারণ মানুষের অনুভূতিগুলোকে নিজের অনুভূতির সঙ্গে ঝালিয়ে নিয়েছেন। একপর্যায়ে উপস্থিত জনতার সঙ্গে এতোটাই একাত্ম হয়ে পড়েছেন, কখন যে জনতা ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে পরিণত হয়ে গেছে তা না-বক্তা, না-শ্রোতা কেউই খেয়াল করেননি। ভাষণের একপর্যায়ে তিনি বলেছেন:
‘তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’
এই বক্তব্যের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান একটি গেরিলাযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। ভাষণ শেষে স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগানমুখর হয়ে উঠেছিলো ঢাকার রাস্তাগুলো।
আরও পড়ুন: মহানায়কের মৃত্যু হয় না
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন। একদিকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অন্যদিকে তাকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা না হয়, সেদিকেও তার সতর্ক দৃষ্টি ছিলো। তিনি পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নেননি। তার এই কৌশলের কারণেই ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই জনসভার ওপর হামলা করার প্রস্ততি নিলেও তা করতে পারেনি। অথচ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার অপেক্ষায় ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও শেখ মুজিবকে ‘চতুর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে এক গোয়েন্দা কর্মকতা বলেন, শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে চলে গেল, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না (ডয়েচে ভেলে, ৩১ অক্টোবর ২০১৭)।
৭ মার্চের একদিন আগে অর্থাৎ ৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান টেলিফোনে কথা বলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সরকারের তৎকালীন তথ্য কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিকের ‘Witness to Surrender’ গ্রন্থে এসব তথ্য রয়েছে। জেনারেল ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে বলার চেষ্টা করেন, তিনি (বঙ্গবন্ধু) যেন এমন কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করেন, যেখানে থেকে ফিরে আসার উপায় আর না থাকে।’ ৬ মার্চ এ-ও ঘোষণা করা হলো যে, ২৫ মার্চে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে।
পরিস্থিতির চাপে ভীতসন্ত্রস্ত পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সদর দপ্তর থেকে বিভিন্নভাবে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে এই বার্তা দেয়া হয় যে, ৭ মার্চ যেন কোনোভাবেই স্বাধীনতা ঘোষণা না করা হয়। ৭ মার্চ জনসভাকে কেন্দ্র করে কামান বসানো হয়। এমনকি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র প্রস্তুত রাখা হয়। মেজর সিদ্দিক সালিক তার গ্রন্থে লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি ৭ মার্চের জনসভার প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ নেতাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা হলে তা শক্তভাবে মোকাবেলা করা হবে। বিশ্বাসঘাতকদের (বাঙালি) হত্যার জন্য ট্যাংক, কামান, মেশিনগান সবই প্রস্তুত রাখা হবে। শাসন করার জন্য কেউ থাকবে না কিংবা শাসিত হওয়ার জন্যও কিছু থাকবে না।’
আরও পড়ুন: শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: অবদান, প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা
এমন এক কঠিন সংকটময় পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ মার্চ রেসকোর্সে তার অমূল্য ভাষণটি প্রদান করেন। সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফেরত নেওয়া, নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা এবং যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা। এ চারটি শর্ত দিয়ে একদিকে আলোচনার পথ উন্মুক্ত রাখলেন, অপরদিকে বক্তৃতা শেষ করলেন এই কথা বলে যে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি প্রকারান্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বলেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কিছু অংশ ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, তিনি সেদিন যুদ্ধের ঘোষণা যেমন পরোক্ষাভাবে প্রদান করেন, আবার যুদ্ধে কীভাবে জয়ী হতে হবে সে ব্যাপারেও দিকনির্দেশনা দেন। স্বাধীন রাষ্ট্রের বৈধ সরকারপ্রধানের মতো এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন।… যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো – কেউ দেবে না!’
অনেকেরই আশঙ্কা ছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা কিংবা গ্রেপ্তার করা হতে পারে। এ আশঙ্কা হয়তো বঙ্গবন্ধুরও ছিল। তাই তিনি আগাম সতর্কতা হিসেবে বলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা রাস্তাঘাট সবকিছু বন্ধ করে দেবে।’ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাঙালি যেন শত্রু পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে কোনোভাবেই নমনীয়তা প্রদর্শন না করে। জয় ছাড়া আর কিছু নয়–এটাই ছিলো ৭ মার্চের ভাষণের প্রধান সুর।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন এটা বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোও অনুমান করেছিলো। ৬ মার্চ, ১৯৭১ লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ছাপা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমান আগামীকাল (৭ মার্চ) পূর্ব পাকিস্তানের একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন’।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাত্তরের ৭ মার্চ সরাসরি কেন স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, তার ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে তিনি নিজেই দিয়েছেন। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে এনডব্লিউ টিভির দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ৭ মার্চের ঘটনা বর্ণনা করেন। শেখ মুজিবের কাছে ফ্রস্ট জানতে চান – ‘আপনার কি ইচ্ছা ছিলো যে, তখন ৭ মার্চ রেসকোর্সে আপনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা দেবেন’? জবাবে শেখ মুজিব বলেন, ‘আমি জানতাম এর পরিণতি কী হবে এবং সভায় আমি ঘোষণা করি যে এবারের সংগ্রাম মুক্তির, শৃঙ্খল মোচন এবং স্বাধীনতার।’ ফ্রস্ট প্রশ্ন করেন ‘আপনি যদি বলতেন, আজ আমি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা করছি, তো কী ঘটতো’? শেখ মুজিব উত্তর দেন, ‘বিশেষ করে ওই দিনটিতে আমি এটা করতে চাইনি। কেননা বিশ্বকে তাদের আমি এটা বলার সুযোগ দিতে চাইনি যে, মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন তাই আঘাত হানা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প ছিলো না। আমি চাইছিলাম তারাই আগে আঘাত হানুক এবং জনগণ তা প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একটি অগ্নিমশাল, যা প্রজ্জ্বলিত করেছিলো মুক্তিযুদ্ধের দাবানল, যার সামনে টিকতে পারেনি হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়কেই নাড়া দেয়নি, ভাষণটি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। এ ভাষণের মধ্যে দিয়ে সমগ্র জাতিকে মুক্তির মোহনায় দাঁড় করিয়েছিলেন শেখ মুজিব। তিনি একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন।
মূলত স্বাধীনতা সংগ্রাম স্বাধীনতা যুদ্ধের রূপ নেয় যখন ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক চলাকালীন ২৫ মার্চের কালরাতে জেনারেল টিক্কা খান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে নারকীয় গণহত্যা শুরু করে। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম সশস্ত্র রূপ ধারণ করলেও আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক সমর্থন এবং নৈতিক বৈধতা বাংলাদেশের পক্ষে চলে আসে। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ এই ১৮ দিনে এই ভাষণ বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষকে প্রস্তুত করেছে মুক্তির সংগ্রামে, স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে।
কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছেন,‘৭ মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।’ যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ বলেছেন ‘ পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরুক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।’
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘নিউজউইক’ সাময়িকীর বিখ্যাত রিপোর্টে বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করা হয়েছিলো ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ হিসেবে:‘৭ মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয় একটি অনন্য কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমে তিনি ‘রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি পান।’ ১৯৯৭ সালে টাইম ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে ‘ শেখ মুজিব ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমেই আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন’। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ১৯৭১-এর এক ভাষ্যে বলা হয়- ‘শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তীকালে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ঐ ভাষণেরই আলোকে।’
কাজেই এ কথা বলা যায় যে, ৭ মার্চ এর ভাষণ ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ৷ যার আলোকে যুদ্ধ হয়েছে নয় মাস, আমরা অর্জন করেছি বিজয়, পেয়েছি স্বাধীন পতাকা।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। বাঙলির মর্যাদা উন্নীতকরণে এবং পরবর্তী প্রজন্মের নিকট বাংলাদেশের পরিচয় সুস্পষ্ট করে তুলে ধরতে এই ভাষণ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং রাখবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু'।
লেখক: প্রাধ্যক্ষ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল; কোষাধ্যক্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ