মজলুমের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর মওলানা ভাসানী

মজলুমের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর মওলানা ভাসানী
মজলুমের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর মওলানা ভাসানী  © ফাইল ছবি

মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়। মাস দুইয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গেছেন লন্ডনে, চিকিৎসার প্রয়োজনে। দেশে শুরু হয়েছে খাদ্যের তীব্র সংকট। দ্রব্যমূল্যের বাজার লাগামহীন। জনজীবনে নাভিশ্বাস অবস্থা তৈরি হয়েছে প্রায়। ভুখা মিছিল নিয়ে মওলানা ভাসানী গিয়েছেন গণভবন ঘেরাও করতে। মিছিল থেকে ভাসানীকে গণভবনের ভেতরে নিয়ে গেলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ এবং রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা।

ভাসানীর সাথে কাজী জাফর আহমেদ, রাশেদ খান মেনন এবং হায়দার আকবর খান রনো। খেতে দেওয়া হলো স্যান্ডউইচ, পেঁপে, মিষ্টিসহ নানা ফলমূল। কাজী জাফর এবং মেনন মওলানাকে খেতে নিষেধ করলেন। কিন্তু এককালের সহযোদ্ধাদের এবং রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বদৌলতে দূরদর্শী ভাসানী কাজী জাফর এবং মেননের কথা শুনলেন না; সৌজন্যতা রক্ষার্থে স্যান্ডুইচ এবং পেঁপে খেলেন।

পড়ুন: মওলানা ভাসানীর জন্মদিন আজ

সাংবাদিকেরাও সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন; তারা নানানভাবে ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়া ভাসানীর খাওয়ার ছবি তুললেন। ‘ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়া মওলানার আহার বিলাস’ ইঙ্গিত করে পরের দিন খবরের সাথে পত্রিকায় সেই ছবি প্রচারিত হলো। লন্ডনে বসে বঙ্গবন্ধু ভাসানীকে অপদস্ত করার এই কৌশল দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন।

সজীব ওয়াফি

বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে যোগাযোগ করে উত্তেজিত হয়ে বলেছেন, ‘‘মওলানাকে ওরা কতটুকু জানে!’’ আবার মাঝেমধ্যেই রাজনৈতিক কারণে দিনের আলোয় ভাসানী-মুজিব একে অপরের তুমুল বিরোধীতা চলতো। তারপর গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু ছুটে যেতেন টাঙ্গাইলের সন্তোষে ভাসানীর কাছে পরামর্শ এবং দোয়া চাইতে। প্রকাশ্যে সবার সামনে যখন যেতেন পায়ে হাত দিয়ে সেলাম করতেন। বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী যার জীবন্ত সাক্ষ্য।

স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত এই জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর তৎকালীন পাবনার সিরাজগঞ্জে প্রত্যন্ত ধানগড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হাজী শারাফত আলী খানের চার সন্তানের সবচেয়ে ছোট আবদুল হামিদ খান। দুরন্ত-ডানপিটে হওয়ার কারনে ডাক নাম পরলো চেগা মিয়া। শিশু বয়সেই পিতৃবিয়োগের কিছুদিন পরে মহামারিতে স্নেহমহী মা, বোন এবং বড় দুই ভাইকে হারিয়ে এতিম হয়ে পরেন; একলা হয়ে যান।

পড়ুন: নামের ভুলেই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম

প্রথাগত কোন উচ্চ শিক্ষায় তিনি শিক্ষিত ছিলেন না। ছিলেন ভারতবর্ষে ইসলামি শিক্ষার আতুরঘর দেওবন্দ মাদ্রাসার ছাত্র। বলতে গেলে আধ্যাত্মিক জগতে ছিলো তার মহা-বিচরণ। জড়িত হয়েছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে। তরুণ বয়সেই হয়ে উঠেছিলেন বাংলার গরিব কৃষকদের মধ্যমণি। জমিদারদের অত্যাচার থেকে বাঁচাতে এবং দারিদ্র্য কৃষকদের সংগঠিত করতে সিরাজগঞ্জে করেছিলেন কৃষক সভা।

তার পরামর্শে অবহেলিত নির্যাতিত কৃষকরা ক্রমেই বিদ্রোহী হয়ে ওঠায় রোষের মুখে পরেন জমিদার শ্রেণির। জমিদার মহারাজাদের বিরাগভাজন হয়ে এক পর্যায়ে ভাসানীকে বাংলা ছাড়তে হয়। তাকে বহিষ্কার করা হয় পূর্ব বাংলা থেকে। ত্যাগ করতে হয় নিজ ভূখন্ড। শুরু হয় আসামে ভাসানীর লড়াই-সংগ্রামের দিনগুলো।

পড়ুন: গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক মেরেছে ঢাবি!

আসামে ভাসানী প্রত্যক্ষ করলেন সেখানেও একেই দূরাবস্থা। দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করা মানুষের মুক্তি সেখানেও নেই। তখনকার দিনে আসাম অঞ্চল ছিলো জঙ্গলে পরিপূর্ণ। বাধ্য হয়েই বাংলার ভূমিহীন লোকজন পাড়ি জমাতো আসামে। উদ্বাস্তু বাঙালিরা বিপদসংকুল পরিত্যাক্ত জঙ্গল পরিস্কার করে বসতি স্থাপন করতো, চাষাবাদ করতো। আসাম সরকার এবং অহমিয়ারাও তখন বাঁধা প্রদান করেননি। এ বিষয়ে তারা বরং উৎসাহ যোগাতো, কারণ তাদের খদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণ যোগান এবং জাতীয় আয় বেড়ে যাওয়ার জন্য। অসুবিধা সৃষ্টি হয় বিশের দশকে এসে। বাঙালিদের চাপে অহমিয়ারা সংখ্যালঘু হয়ে পরবে এরকম ধারণা বদ্ধমূল হয়। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে আসাম সরকার প্রবর্তন করে লাইন প্রথা আইন।

অর্থাৎ ভূমির উপর দাগ বা লাইন টেনে দেওয়া। সে লাইনের বাইরে গিয়ে বাঙালিরা বসতি স্থাপন করতে পারতো। আগে থেকে লাইনের অন্যপাশে যারা বসবাস করে আসছিলো তাদের উপরেও নেমে আসলো নির্যাতন। কোন পূর্ব বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই হঠাৎ করে হাতি দিয়ে করা হয় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা। সর্বহারা মানুষ সব হারিয়ে আবার সর্বস্বান্ত। এভাবে বাঙালিদের উপর চলতো সর্বাত্মক দমন-নিপীড়ন।

পড়ুন: বাংলাদেশ: গণতন্ত্রের শ্মশান যাত্রা

দারিদ্র্য নিষ্পেষিত কৃষকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে মওলানা ভাসানী অনুভব করলেন রাজনৈতিক দলের। যোগ দিলেন গান্ধিজীর জাতীয় কংগ্রেসে। দুর্ভাগ্য! মহাত্মা গান্ধী-নেহেরুর কংগ্রেস জমিদার মহারাজাদের পার্টি; এমনকি তারা জমিদার বিরোধী আন্দোলনেরও বিরোধী। ১৯২৮ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদে উত্থাপিত প্রজাস্বত্ব আইনের বিপক্ষে ভোট দিলো কংগ্রেসীরা। ফলে তারা গরিব মানুষের স্বার্থ বাতিল করে জমিদার-মহারাজাদের পক্ষাবলম্বন করলো।

অন্যদিকে মওলানা ভাসানী নির্যাতিত নিগৃহীত দারিদ্র্য কৃষকের প্রতিনিধি। মওলানা ভাসানী বুঝতে পারলেন ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ রক্ষক এবং অভিভাবক হচ্ছে জমিদার-মহারাজারা। অথচ মওলানা ভাসানী কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তীব্রতর করে, জমিদার বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে অবহেলিত কৃষকদের অধিকার আদায় করতে। কংগ্রেসের অধিকাংশ জমিদার ছিলো ধর্মে হিন্দু। জমিদারদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করাকে কংগ্রেস হিন্দু বিরোধীতা হিসেবে দেখতে শুরু করলো। চরমভাবে মনোক্ষুণ্ণ হলেন মওলানা।

কংগ্রেস বিরোধীতার কারনে মুসলিম লীগ কৃষকদের পক্ষাবলম্বন করলো। এর ভিতরে বিভিন্ন স্থানে মুসলিম লীগ কৃষক-প্রজা সম্মেলন করেছে। হতোদম্য মওলানা ভগ্নহৃদয়ে যোগ দিলেন মুসলিম লীগে। ভাসান চরে আন্দোলন করে ভাসানী হয়ে ওঠা মওলানা শেষে আসামের মুসলিম লীগ সভাপতি নির্বাচিত হলেন। ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচন; আসামের রাজনীতি দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পরলো।

ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির স্যার মোহাম্মদ সাদুল্লাহ ভাসানীর মুসলিম লীগে যোগাযোগ করলেন। সাদুল্লাহ ছিলেন একজন অহমিয়া। লাইন প্রথা বাতিলের শর্তে মওলানা ভাসানী সাদুল্লাহকে সমর্থন করলেন। ভাসানীর চাপে মুসলিম লীগ এবং স্যার মোহাম্মদ সাদুল্লাহ অঙ্গীকার করলো বাঙালিসহ সকল নির্যাতিত মানুষের অধিকার সমুন্নত রাখার। আর কংগ্রেস শুরু করলো 'বাঙ্গাল খেদাও' শ্লোগান। চরম আঞ্চলিক বিদ্বেষ ছড়িয়েও আসামে কংগ্রেসের শেষ রক্ষা হয়নি। আসন সংখ্যানুপাতিক ভরাডুবি ঘটেছে।

অল্প কিছু দিনের ভেতরেই স্যার মোহাম্মদ সাদুল্লাহ মুসলিম লীগে যোগ দিলেন মওলানা ভাসানীর ক্যারিশমা দেখে। এই সময়ে মওলানা ভাসানী স্যার মোহাম্মদ সাদুল্লাহকে মুখ্যমন্ত্রী হতে সাহায্য করেছিলেন এবং নিজে আইন পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন একমাত্র লাইন প্রথা বাতিল করে দারিদ্র্য বাঙালির মুক্তির জন্য। আইন পরিষদেও ভাসানী এ নিয়ে বিশদ বক্তব্য রেখেছেন। মুসলিম লীগও ভাসানীর পথে এগিয়ে এসেছিলো। কিন্তু ক্ষমতাসীন হয়ে স্যার সাদুল্লাহ পূর্ব প্রতিশ্রুতি করলেন ভঙ্গ। ভাসানীও প্রতিবাদে সোচ্চার হলেন।

গণআন্দোলনে রূপ দিয়েছেন আইন পরিষদের বাইরেও। নির্যাতিত মানুষের স্বার্থে নিজ দলের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে একটুও পিছপা হননি। বরঞ্চ মওলানা ভাসানী আন্দোলন এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যে স্যার সাদুল্লাহ সরকারের পদত্যাগ করার দাবি উঠিয়েছিলেন। বক্তব্যে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘যেই যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ।’ সেই সময়ে সাদুল্লাহর মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার অর্থ হচ্ছে- ভবিষ্যতে আসামে কংগ্রেসের কাছে মুসলিম লীগের নাকানিচুাবানী। হয়েছিলোও তাই, কংগ্রেসের বড়দলূই ক্ষমতায় এসেছে। ভাসানী এবং জনতার পথে না হেঁটে স্যার সাদুল্লাহ একসময় রাজনীতি থেকেই হারিয়ে যায়।

দেশ ভাগের পরপরই মওলানা ভাসানী ফিরলেন পূর্ব পাকিস্তানে। তিনি ধরতে পেরেছিলেন বাঙালিদের উপর পাকিস্তানের নতুন উপনিবেশিক শোষণ। ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন রোজ গার্ডেনে গঠন করলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, আজকের আওয়ামী লীগ। পরবর্তীতে ভারত থেকে পাকিস্তানে ফেরত এসে, মওলানা ভাসানীর অনুরোধ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কূটনৈতিক সফলতায় আওয়ামী মুসলিম লীগের সাথে যোগ দিলেন হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী।

চুয়ান্ন’র নির্বাচন ঘনিয়ে আসলে ২১ দফা ইশতেহার নিয়ে মওলানা ভাসানী গঠন করলেন যুক্তফ্রন্ট। যার অন্যতম ছিলো লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। নানান কারনে ভাসানী নিজে আর নির্বাচন করলেন না। যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে মুসলিম লীগকে হারিয়ে দেয়। সে নির্বাচনে জিতে আসে হক-সোহরাওয়ার্দী আর শেখ মুজিব। অতঃপর ভাসানীর চাপে ৫৫ সালের দিকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলে পরিণত হয় আওয়ামী লীগ।

১৯৫৭ সাল, পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় তখন। মওলানা ভাসানী সম্মেলন ডাকলেন টাঙ্গাইলের কাগমারীতে। সম্মেলন চলাকালীন মওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানের পূর্নাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন চাইলেন। প্রশ্ন তুললেন পাকিস্তানে বিদেশ নীতি নিয়ে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির কথা বলা আছে, কিন্তু সোহরাওয়ার্দী সরকার দলীয় গঠনতন্ত্র না মেনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামরিক জোটে ঢুকেছেন।

উত্তরপর্বে সোহরাওয়ার্দী জানালেন পূর্ব পাকিস্তানকে ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছে। বোঝানো হলো শহিদ সোহরাওয়ার্দী যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানের পূর্নাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন পাওয়া হয়ে গেছে। বাংলার শোষিত মানুষের অধিকার আদায় এবং বাঙালির স্বাধীনতার ইঙ্গিত দিয়ে ভাসানী বললেন, যদি পূর্নাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন না দেওয়া হয় পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’। স্বায়ত্তশাসন আর বিদেশ নীতির অবস্থানে সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের কাছে হেনস্তার শিকার হলেন মওলানা। পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ে, স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে তিনিও আওয়ামী লীগ ছাড়তে কিঞ্চিৎ পিছপা হলেন না।

আওয়ামী লীগ ছেড়ে দেওয়ার কয়েক দিনের মাথায় মওলানা ভাসানী গঠন করলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। বাম-প্রগতিশীল ঘরানার লোকজন অংশগ্রহণ করলো ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ৬২'র শিক্ষা আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান হয়েছে মওলানা ভাসানীর হাত ধরেই। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে ৭১-এর ৬ এপ্রিলের পর টাঙ্গাইলের বিন্যাফৈর গ্রাম থেকে ভারত যাত্রা করেন বয়োবৃদ্ধ ভাসানী।

ভারত যাত্রার পূর্বে তিনি যমুনার চরাঞ্চলে থেকে মুক্তাঞ্চল গড়ার চেষ্টা করেছিলেন। অন্যদিকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে টাঙ্গাইল আক্রমণ করে ভাসানীর সন্তোষের বাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাকবাহিনী। হত্যার জন্য তাঁকে হন্য হয়ে খুঁজেছে সেনারা। ভারত যাত্রাপথে কয়েকবার পাকবাহিনীর সামনেও পরেছিলেন। কিন্তু সাধারণ বেশভূষায় আর দশজন বৃদ্ধের সাথে ভাসানীকে পাকসেনারা আলাদা করতে পারেননি।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির উপরেও ভাসানী আর নির্ভর করতে পারলেন না। মনোযোগী হলেন কৃষক সংগঠনের দিকে। তবে মওলানা ভাসানীর আহুত হরতাল, ঘেরাও, লংমার্চের মতো কর্মসূচিতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সদস্যরা সফল করেছে। যদিও তখনো তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির চেয়ারম্যান; কিন্তু কৃষকের মুক্তির জন্য লাল মওলানা ফিরে গেলেন তার লালটুপির দিকে। পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে জীবনের শেষ অবিস্মরণীয় ফারাক্কা মিছিল করলেও রাজনৈতিক দল থেকে পূর্বেই আস্তে আস্তে নিস্ক্রিয় হলে গেলেন। আর ফেরত আসেননি।

মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি করেছেন, আবার ঘটনাক্রমে সেই দল ত্যাগ করেছেন। এ বিষয়ে নানান লোকজন তাকে অভিহিত করেছে 'দলছুট মওলানা' হিসেবে। এমনকি মৃত্যুর পরেও বিতর্ক তাঁর পিছু ছাড়েনি। অথচ কি রকম মুহূর্তে মওলানা তাঁর নিজের সংগঠিত করা দলের মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন, এ কথা কেউ বলেন না।

মওলানা ভাসানীর জীবন বিশ্লেষণ করলে বেরিয়ে আসে- তাঁর রাজনৈতিক দলের দুর্দিনে তিঁনি কোন দলই ছাড়েননি। এমন একটা সময়ে দল ছেড়েছেন যখন তাঁর দল ক্ষমতায় বা যৌবনে রূপ নিয়েছে। মজলুমের স্বার্থে নীতি-আদর্শের বিচ্যুতি দেখলেই ভাসানী বিদ্রোহ করেছেন জমিদারের প্রতি, কখনো কংগ্রেস-মুসলীম লীগের প্রতি, আবার কখনো নিজ দলের প্রতি। নতুবা একজন মানুষ প্রতিকূল পরিবেশে রাজনৈতিক দল সংগঠিত করে অনুকূল সময়ে নিজের দল কেউ ত্যাগ করতে চায়? যখন একটু স্বস্তি ফেলবার সময় তখন কেনই বা দল ত্যাগ করবেন?

মওলানা ভাসানী তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির লোকজন ডাকলেন; মিটিংয়ে বললেন, ‘‘আমার মৃত্যুর পর আমাকে সবাই ঢাকাতে রাখতে চেষ্টা করবে। তোমরা আমাকে ঢাকাতে নিতে দিবা না।’’ এর কারণ জানতে চাইলে জানালেন, ‘‘আমার কবর জিয়ারত করতে ঢাকা থেকে সাহেবরা সন্তোষে আসতে পারবে, কিন্তু গ্রাম থেকে মেহনতী মানুষ ঢাকায় যেতে পারবে না। গরিব কৃষকদের থেকে আমি আলাদা হতে চাই না। মৃত্যুর পরেও আমি সন্তোষে আমার মেহনতী মানুষের সাথে থাকতে চাই।’’

সত্যি বলতে ভাসানীর মৃত্যুর পর তাঁকে ঢাকাতে রাখতে চেষ্টা হয়েছিলো। মওলানা ভাসানী আজীবন ছিলেন মজলুমের কন্ঠস্বর। আপোসহীন ভাষায় উচ্চারণ করেছেন 'খামোশ'! শান্তি এবং নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেছেন পুরো পৃথিবী জুড়ে। শান্তির এই নিশানা মৃত্যুর পরেও স্ব-ইচ্ছায় মেহনতী মানুষের সাথে সন্তোষে থেকে গেলেন। কোলাহল মুক্ত ছায়া সুশীতল বট গাছ প্রাঙ্গণে। ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মৃত্যুবরণ করেন। এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বাংলার জনপদ, থেকে গেছেন কৃষক-শ্রমিক মজলুম মানুষের হৃদয়ে। ১৪১ তম জন্মবার্ষিকীতে জীবনের গভীর থেকে হুজুরের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ঢাকা


সর্বশেষ সংবাদ