বাংলাদেশ: গণতন্ত্রের শ্মশান যাত্রা

লেখক সজীব ওয়াফি
লেখক সজীব ওয়াফি  © টিডিসি ফটো

গণতন্ত্র বলতে শুধুমাত্র ভোট প্রদানকে বুঝায় না। গণতন্ত্র ধারণ করে তার নাগরিকদের বাক স্বাধীনতার অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার, মৌলিক চাহিদা পূরনের অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার। সুষ্ঠুভাবে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়া গণতন্ত্রের একটা অংশ মাত্র। সংবাদপত্র রাষ্ট্রের সেই গণতান্ত্রিকতার দর্পণ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে পৌছাতে পৌছাতে সাধের গণতন্ত্র ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ।

একটি রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের সূতিকাগার তার বিশ্ববিদ্যালয় গুলো। এ কারণে গণতন্ত্রের রূপ নির্ভর করেও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর উপরে। স্বায়ত্তশাসিত এই প্রতিষ্ঠানের পার্লামেন্ট হচ্ছে সিনেট, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত পাশ হয়। সিনেটে ছাত্র স্বার্থ রক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ছাত্র প্রতিনিধিরা। প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ডিন, গ্রাজুয়েট এবং শিক্ষক সমিতির নেতাদের সাথে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সিনেটে অংশগ্রহণ করেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে কোন ছাত্র সংসদ কার্যকর নাই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর দেড়েক আগে সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হলেও কার্যকারিতা পরিণত করা হয়েছিল অথর্ব ডাকসুতে। অন্যসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ পাওয়া দুঃস্বপ্নের ব্যাপার। ফলাফলে গণতান্ত্রিক পথ রুদ্ধ এবং প্রশাসন তার স্বৈরাচারী কায়দায় নানান স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েই খালাস।

নাগরিকেরা স্বাধীন মত প্রকাশ করলেই পাকিস্তান আমলের দেশরক্ষা আইনের ন্যায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়গ। একের পর এক নীতিমালা দিয়ে খর্ব হচ্ছে সংবাদপত্রের প্রকাশের স্বাধীনতা। সাংবাদিকদের করা হচ্ছে হয়রানি। অন্যায়ভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে রাজপথে টুটি চেপে ধরছে রাজনৈতিক কর্মীদের।

b8505d9c-a510-41af-8b68-3069f9b276ff

জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারি দলের সাংসদদের বিলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার সুযোগ অনুপস্থিত। ফ্লোর ক্রসিং করে বিপক্ষে সমর্থন দিলে বাংলাদেশ সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদে আছে অটোভাবে সংসদ সদস্য পদ বাতিল হওয়ার আইন। তাহলে গনবিরোধী সিদ্ধান্তে হাত পা বাঁধা এই সাংসদেরা কি করতে পারবেন? গণতন্ত্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী জনগণ। তাহলে নির্বাচিত প্রতিনিধি জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নিলে জনগণের পক্ষে তার সাংসদ পদ বাতিল করার আইন কোথায়? এই হল আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান!

তিন কোটি প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নে সংসদে কোন কথা হয় না। প্রান্তিক মানুষও জনগণ, তারাও গণতন্ত্রের অংশ। দুর্ভাগ্য আমাদের গণতন্ত্র চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে, যারা দিন শেষে সওদা করে ঘরে ফেরেন। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন, জনচিন্তা করা নয়।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া সরকারের কার্যকলাপে বিরক্ত জনগণ চেয়েছিলেন স্বস্তি। হতাশাজনক! পরবর্তী দশম নির্বাচনে বিনা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন অর্ধেরও বেশি আসনে জিতে বিজয় নিশ্চিত করে আওয়ামী লীগ।

একাদশ নির্বাচনে যা হল, সারা পৃথিবীর মানুষ দেখলো। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনেক; কিন্তু তারা বাংলাদেশের ইতিহাস এবং নৈতিকভাবে নিজেদের রাজনৈতিক কলঙ্কিত করেছেন।

অন্ধবাদী একদল খোঁড়া যুক্তি দাড় করিয়ে বলবেন গণতন্ত্র বা বাক স্বাধীনতা না থাকলে লিখতে পারতেন না। তাদের জন্য জবাব থাকবে ‘লেখার পরে শফিকুল ইসলাম কাজলদের গুম হয়ে যেতে হয়। চট্টগ্রামে সাংবাদিক কে লেখার কারণে নির্যাতনের স্বীকার হয়ে উচ্চারণ করতে হয় ভাই আমাকে আর মাইরেন না, আমি আর লিখবো না। প্রথম আলো সম্পাদক কে আদালতে দৌড়াতে হয় এই কলম চালানোর জন্যই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাব সভাপতি বাপ্পি কে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হয়ে হাজতে যেতে হয়৷ সৃজনশীল বহু নাগরিক লিখে হয়রানির স্বীকার হচ্ছেন দেদারসে।’

গণতন্ত্র নদীর মত। স্বচ্ছ পানি, ঘোলা পানি, ময়লা-আবর্জনা নিয়ে নদী তাঁর গন্তব্যের দিকে গতিশীল। নির্দিষ্ট স্বার্থে এই নদীতে বাঁধ নির্মানে বিপর্যয় ঘটিয়ে নদী গতিপথ পরিবর্তন করে সামনে আগায়। দুর্দশা হয় জনগণের।

ইতিহাসের শিক্ষা- বাংলাদেশের মানুষ সব ভুলে যায়, কিন্তু ভোট না দিতে পারার দুঃখ কোনদিন ভুলে না। স্বেচ্ছাচারীতা, দম্ভোক্তি এবং হিংসাত্মক অবয়ব গণতন্ত্রের বিপরীত তন্ত্রের চরিত্র। সুস্থ রাজনৈতিক চর্চায় গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম হোক!

 

লেখক: রাজনৈতিক কর্মী ও বিশ্লেষক


সর্বশেষ সংবাদ