উচ্চশিক্ষায় ব্লেন্ডেড লার্নিংই হতে পারে একটি টেকসই ও নিরাপদ পদ্ধতি
- ড. মো. আকতারুজ্জামান
- প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৪:২৬ PM , আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৪:৪৪ PM
কোভিড-১৯ অতিমারী এখনো শেষ হয়নি, আবার এটাকে শেষ প্রাকৃতিক বিপর্যয় মনে করা ঠিক হবে না। যদিও অবস্থা ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে, তারপরও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা আমাদের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবক, সরকারসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকল অংশীদারদের মধ্যে এখনো অনেক বড় দুশ্চিন্তার বিষয়।
অন্যদিকে অতিমারীর শুরু হতে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা ব্লেন্ডেড ও অনলাইন শিক্ষায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আমাদের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় নূন্যতম গুগল ক্লাসরুমের সাথে জুম বা মিট ভিডিও কনফারেন্সিং ব্যবহার করে অনলাইন ক্লাস চালিয়ে নিচ্ছে যদিও তারা পূর্ণাঙ্গ লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম যেমন মুডল, ক্যানভাস বা ব্ল্যাকবোর্ড ক্লাসে অন্তর্ভুক্ত করেনি। তদুপুরি এটা একটা ভাল শুরু, কিন্তু আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে যে, শিক্ষকগণ নিয়মিত ও কার্যকরভাবে ক্লাস নিচ্ছে, শিক্ষার্থীরা ভালভাবে ক্লাসে মনোনিবেশ করতে পারছে ও শিক্ষা কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পাদন করতে পারছে।
জাতীয় ব্লেন্ডেড লার্নিং পলিসি-২০২১ মোতাবেক প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ব্লেন্ডেড লার্নিং সেন্টার এবং একটি লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এলএমএস)থাকতে পারে যার কাজ হবে নজরদারি, জবাবদিহিতা এবং পেশাদারী বিকাশের মাধ্যমে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষার শ্রেষ্ঠত্বের দিকে নিয়ে যাওয়া। এখন আমাদের কৌশল কি হওয়া উচিত?
শিক্ষা মূলত তিনটি আন্তঃসম্পর্কিত উপাদান নিয়ে গঠিত – টিচিং, লার্নিং এবং এসেসমেন্ট। শিক্ষার এই উপাদানগুলির প্রতিটিতে প্রতিফলিত হলে সেটিকে আমরা ব্লেন্ডেড লার্নিং বলতে পারি। মানব সৃষ্টির শুরু থেকে আমরা ফেস-টু-ফেস শিক্ষায় অভ্যস্ত, যা পরবর্তীতে ডিজিটাল সরঞ্জাম বা আইসিটি’র মাধ্যমে আরও উন্নত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরসহ একটি শ্রেণীকক্ষে পাঠদান। অনলাইন লার্নিং হল এমন শিক্ষা যা ইন্টারনেটে এবং দূরশিক্ষণের মাধ্যমে হয়, প্রচলিত ক্লাসরুমে হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এলএমএস দিয়ে জুম বা মিট ভিডিও কনফারেন্সিং ব্যবহার করে ক্লাস পরিচালনা করা।
ব্লেন্ডেড লার্নিং এর অর্থ হল ফেস-টু-ফেস এবং অনলাইন কার্যকলাপের উদ্দেশ্যমূলক সংমিশ্রণ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তিন দিন ফেস-টু-ফেস এবং দুই দিন অনলাইনে সমন্বিত ক্লাস পরিচালনা করা। তবে প্রচলিত ক্লাসে স্মার্টবোর্ড ব্যবহার করা বা অনলাইন ক্লাসে জ্যামবোর্ড বা একটি লেকচার ক্লাসের পর মাঠ পরিদর্শনের কাজগুলো সাধারণত আজকের প্রেক্ষাপটে ব্লেন্ডেড লার্নিং নয় - এটিতে অনসাইট এবং অনলাইন উভয় উপাদান থাকা উচিত। আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এবং ইন্টারনেটের স্বল্প গতির মধ্যে কোভিড-পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থা অনলাইন বা ফেস-টু-ফেস নয় বরং স্মার্ট পদ্ধতিতে ব্লেন্ডেড লার্নিং হতে পারে।
কোভিড পরবর্তী ব্লেন্ডেড শিক্ষা পদ্ধতি
যদিও উন্নত দেশগুলি কমপক্ষে ১০-১৫ বছর আগে ব্লেন্ডেড এবং অনলাইন শিক্ষার নীতি গ্রহণ করেছে, ভারত ২০২১ সালের মে মাসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্লেন্ডেড মোড চালু করেছে, যেখানে যেকোনো কোর্সের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত অনলাইনে এবং ৬০ শতাংশ অফলাইনে শেখানোর অপশন রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় একমাস পর ভারতীয় ইউজিসি তাদের দেশের কিছু নির্বাচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনলাইন ডিগ্রী এবং প্রোগ্রাম স্বীকৃতি দিতে শুরু করে। আগস্ট ২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), বাংলাদেশ জাতীয় ব্লেন্ডেড লার্নিং পলিসি অনুমোদন দেয়, যা প্রোগ্রাম স্তরে (যেমন, বিএসসি ইন সিএসই) বিবেচনা করা হতে পারে এবং একটি প্রোগ্রামের মোট ক্রেডিটের প্রায় ৩৩-৪০ শতাংশ সংশ্লিষ্ট কমিটির পূর্বানুমতি সাপেক্ষে অনলাইনে অফার করা যেতে পারে। করোনা মহামারীর শুরু থেকে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস এর মতো আমাদের কয়েকটি সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন এবং ব্লেন্ডেড লার্নিং এ বেশ ভালো করছে। তাদের মধ্যে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি দেশের ব্লেন্ডেড এবং অনলাইন শিক্ষার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সম্প্রতি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যানভাস এলএমএস এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এডএক্স প্ল্যাটফর্ম চালু করেছে।
ব্লেন্ডেড লার্নিং কেবল ডেলিভারি মোডে সীমাবদ্ধ না হয়ে ক্লাসের সময়সূচিতেও প্রতিফলিত হওয়া উচিত। উদাহরণস্বরূপ, আমি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের একটি সেকশন পড়াই যারা এই সেমিস্টারে অপারেটিং সিস্টেম এবং এর ল্যাব, ডেটা মাইনিং এবং এর ল্যাব, অর্থনীতি, সিস্টেম এনালাইসিস এ্যান্ড ডিজাইন, একাডেমিক রাইটিং সহ পাঁচটি কোর্স নিয়েছে। কোর্সের ধরণ থেকে বলা যায়, দুটি ল্যাব-ভিত্তিক কোর্স - অপারেটিং সিস্টেম এবং ডেটা মাইনিং (থিয়োরি এবং ল্যাব) ফেস-টু-ফেস পদ্ধতিতে এবং অবশিষ্ট কোর্সগুলি অনলাইনে আরও কার্যকরভাবে নেওয়া খুবই সম্ভব। সার্বিক মূল্যায়ন (যেমন, ফাইনাল পরীক্ষা) ব্যতীত অন্যান্য সব ধরনের চলমান মূল্যায়ন যেমন কুইজ, প্রেজেন্টেশন, অ্যাসাইনমেন্ট, এমনকি মিডটার্ম পরীক্ষা অনলাইনে হতে পারে।
ক্লাস শিডিউলটা এমনভাবে করা যেতে পারে যেন কোনো একক সময়ে একটি সেকশনের এক তৃতীয়াংশ বা সর্বোচ্চ অর্ধেক শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে ২-৩ দিন ফেস-টু-ফেস এবং বাকী ২-৩ দিন অনলাইনে চক্রকার পদ্ধতিতে ক্লাস করতে পারে। তেমনি গুণগতমান এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সাপেক্ষে শিক্ষকদের জন্য ৪ দিন ফেস-টু-ফেস এবং ১ দিন অনলাইনে কাজ করার অপশন থাকতে পারে। এই পদ্ধতিতে অনেক সময় এবং স্থান বাঁচবে, বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে যেখানে যানজট, ক্লাসরুমের অভাব এবং অন্যান্য অনেক সমস্যা নিত্যদিনের সঙ্গী।
শিক্ষকরা এই সময়টিকে গবেষণা, উদ্ভাবন, ইন্ডাস্ট্রি কলাবোরেশন এর জন্য ব্যবহার করতে পারেন এবং শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে গবেষণায়, বাড়িতে পড়াশোনা অথবা আর্থিক অসুবিধার ক্ষেত্রে খণ্ডকালীন কাজ বা টিউশনি কাজে যুক্ত হতে পারে। যেহেতু উন্নত দেশগুলিতে শিক্ষা ব্যয়বহুল এবং শিক্ষার্থীরা তাদের পিতামাতার উপর নির্ভরশীল নয়, তাই অধিকাংশই তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা নির্বিশেষে ব্লেন্ডেড মোডে পড়াশোনা করার পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজে নিযুক্ত থাকে। আমাদের দেশে প্রতিবছর ১০ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করে এবং রাতারাতি আমাদের ভৌত অবকাঠামো বাড়ানো সম্ভব নয়। ফলে ব্লেন্ডেড পদ্ধতি ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের অনেক ফ্লেক্সিবিলিটি প্রদান করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়াতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫২,৫০০ শিক্ষার্থী রয়েছে যেখানে আমাদের বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে অন্যতম একটি যার প্রায় ৮ গুণের মতো এরিয়া থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ১৬,৫০০। ফলে আমরা ক্রমাগত দেশের সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে অনেকাংশে ব্যর্থ হচ্ছি।
উচ্চশিক্ষা খাতে ফেস-টু-ফেস, অনলাইন বা ব্লেন্ডেড লার্নিংয়ের মান নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি এলএমএস থাকা উচিত। এছাড়া স্মার্টএডু টাইপ প্ল্যাটফর্ম মনিটরিং, ম্যানেজমেন্ট এবং জবাবদিহিতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষার্থীদের ফিডব্যাক এবং শিক্ষকদের জবাবদিহিতা - এই দুটি দিক মূল বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত। সামগ্রিক টিচিং-লার্নিং উন্নত করার জন্যে প্রতিটি কোর্সে শিক্ষার্থীদের মাসিক ফিডব্যাক এবং কার্যকলাপগুলির বিশ্লেষণ এবং অর্থপূর্ণ প্যাটার্ন বের করা জরুরী। এলএমএস-এ কোর্স অর্গানাইজেশন, শিক্ষার্থীদের এনগেজমেন্ট, শিক্ষকদের ইন্টারেকশন, শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দেওয়া, মূল্য সংযোজন, স্ব-বিকাশ, শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া, গবেষণা কার্যক্রম, এবং সামগ্রিকভাবে ৮-১০টি দিক নিয়ে একটি রুব্রিক অনুসরণ করে প্রতিটি শিক্ষক একটি মাসিক প্রতিবেদন ভিডিও প্রেজেন্টেশন আকারে জমা দিতে পারেন। এই পদ্ধতিগুলি মানসম্মত শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে যদি আন্তরিক এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বিবেচনা করা যায়।
ব্লেন্ডেড লার্নিং বাংলাদেশের জন্য এখন আর শুধু বিকল্প নয় বরং একটি প্রয়োজনীয়তা। গত দেড় বছরে আমরা অনেক কিছু শিখেছি, বুঝেছি। এখন আমাদের ডিজিটাল দক্ষতা, শিক্ষাগত উদ্ভাবন, মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শ, বিভিন্ন ধরণের ইন্টারেকশন, এনগেজমেন্ট এবং মূল্যায়ন কৌশল, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, সহায়তা কাঠামো, ডিজিটাল পর্যবেক্ষণ এবং জবাবদিহিতা ইত্যাদির দিকে মনোনিবেশ করতে হবে এবং ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক নীতি এবং চর্চায় সেগুলো যোগ করতে হবে। কোভিড-১৯ এর আবির্ভাবের কারণে আজ আমরা এত দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্লেন্ডেড এবং অনলাইন শিক্ষায় যে উন্নতি করেছি তা অবিশ্বাস্য, যা অন্যথায় ৫-১০ বছর সময় নিতে পারতো। অবশ্যই এটি একটি ইতিবাচক দিক। এখন আমাদের কাজ হল নীতিগুলি অনুশীলনে আনা এবং বৈশ্বিক শিক্ষাব্যাবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক এবং জাতীয়ভাবে সেই অনুশীলনগুলিকে শক্তিশালী করা যাতে ভবিষ্যতে কোনো দুর্যোগকালীন সময়ে আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সবকিছু বন্ধ করে বসে থাকতে না হয়।
লেখক: ড. মো. আকতারুজ্জামান
ব্লেন্ডেড, অনলাইন ও ডিজিটাল এডুকেশন এক্সপার্ট
পরিচালক, ব্লেন্ডেড লার্নিং সেন্টার, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
প্রতিষ্ঠাকালীন বিভাগীয় প্রধান, আইসিটি ও শিক্ষা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি