রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : সমাজ বিনির্মাণের ইতিবৃত্ত

 রেজওয়ানুল আলম রিজভী
রেজওয়ানুল আলম রিজভী  © টিডিসি ফটো

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, 'দেশ ভালো হয় যদি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হয়'। ১৯২১ সালে অবিভক্ত ভারতের ঢাকা শহরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৩২ বছর পর রাজশাহী শহরে এই বাংলার দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

কিন্তু মাঝের এই তিন দশকে ভারতের রাজনৈতিক পরিক্রমায় সবচেয়ে আলোড়িত ঘটনাটি যুক্ত হয়, যার নাম 'দেশভাগ'। ফলে স্যার মাইকেল স্যাডলারের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয় দু'টির কর্তৃপক্ষীয় পটভূমি, সামাজিক উপযোগিতা ও প্রতিষ্ঠাকালীন প্রেক্ষাপট কখনই এক ছিলো না। ব্রিটিশ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রূপদান করতে চাইলেও স্যাডলার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সেটি সায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবেই রূপলাভে সক্ষম হয়। উপরন্তু ব্রিটিশ সরকারের আনুকুল্যে সেটি তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে আধুনিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি হিসেবেই গণ্য হয়। ফলশ্রুতিতে অল্পদিনের মধ্যেই তৎকালীন পূর্ব বাংলা অঞ্চলের উচ্চশিক্ষা খাতে প্রসারের ধারায় এদেশে একটি মধ্যবিত্ত সমাজ তৈরি হয়। তখনকার সময়ে ব্রিটিশ কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার মধ্যেও একটি স্বতন্ত্র, শিক্ষিত, উদারনৈতিক এবং জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী তৈরি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্পর্শে এসে। পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিকভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং দর্শন চিন্তায় এই গোষ্ঠীর মধ্যে বৈশ্বিক চেতনার জন্ম তথা সম্প্রসারণ প্রতিফলিত হতে থাকে। তৎকালীন কুলীন বংশজাত গোষ্ঠী ছাড়াও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে অগ্রসর মানুষেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অচিরেই নিজেদের আপন সত্ত্বার বিকাশের মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগান।

উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি জাতির মনস্তত্ত্ব নির্মাণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যুগপৎ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ২৬ বছর পর সমগ্র ভারতজুড়ে জাতিগত পরিচয়ের মানদন্ডে মুখ্য হয়ে ওঠে ধর্মবিশ্বাস। অনেকে মনে করেন যে, ব্রিটিশ সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চূড়ান্তভাবে ভারত ছেড়ে যেতে বাধ্য হওয়ায় ভারতের ভবিষ্যত অকল্যাণের জন্যে কৃত্রিমভাবে হিন্দু-মুসলমান পরিচয়ে বিভক্ত হওয়ার সূক্ষ্ম উপাদান ভারতীয়দের মধ্যে সঞ্চার করেছিল। অনেকে আবার মনে করেন, প্রাচীন থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত চলমান বিভিন্ন শাসক বংশের দখলদারি মনোভাব দীর্ঘ পথ মাড়িয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের জন্ম দিয়েছিল। এই তত্ত্বদ্বয়কে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, সত্য বা অর্ধসত্য যা-ই হোক, ভারত বিভাজন বা দেশভাগ অনিবার্য হয়ে পড়ে তৎকালীন বাস্তবতায়। অনেকগুলো জাতিগত রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার পর ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাঝের মাঝামাঝি ভাগ হয়ে যায় ভারতীয় উপমহাদেশ।

এই অস্থির সময়ে উপমহাদেশের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা, চাহিদা, প্রত্যাশা, চেতনা, প্রতিক্রিয়া সবকিছুতে পরিবর্তন আসে। অধিকাংশ মানুষ রাজনীতির দোলাচলে পড়ে দেশভাগেই সমস্যার সমাধান দেখতে থাকে। ফলে মানুষের মধ্যকার জাতিগত পরিচিতি, চেতনাগত অবস্থান, নৃতাত্ত্বিক বিশ্বাস এবং সার্বিক মূল্যবোধে সংশয়ী পরিবর্তন আসে। তেমনি একটি অস্পষ্ট, ধোঁয়াশাপূর্ণ সময়ের মধ্য দিয়ে বাংলা অঞ্চলের পূর্বভাগ, তথা বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ড পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায়। ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতের সাথে তুলনায় দেখা যায়, স্বাধীন পাকিস্তানের সামাজিক বিশ্বাস ও মূল্যবোধের স্থানগুলি সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে পরিচালিত হতে শুরু করে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, প্রসাশন সজ্জা সর্বত্র এক ধরণের কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব, উদারপন্থার অনুপস্থিতি এবং অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে অনেকাংশে চাপিয়ে দেওয়া মনোভাব ক্রমশ প্রকাশ্য হতে থাকে৷ কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার এবং নেতৃবৃন্দ সহ বুদ্ধিজীবী শিক্ষাবিদগণ প্রথমেই ১৯৪৭ সালের শেষদিকে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বাংলা অঞ্চলের মানুষের মনে ক্ষত তৈরি করে ফেলেন।

সেই ক্ষত রচনা যখন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ'র মতো নেতার হাত দিয়েই আনুষ্ঠানিকভাবে তৈরি হয় ১৯৪৮ সালে, তখন বাংলা ভাষাভাষী সকলেই খুবই আহত হয়। ক্ষত আছড়ে পড়ে রাজপথে, তারপর ধারাহিকতায় ১৯৫২ সালের ফাল্গুন মাসটি পূর্ব বাংলা অঞ্চলকে নতুনভাবে দীক্ষা দিয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই পাঁচ বছরের পাকিস্তান পরিক্রমায় বাংলাদেশের তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং সামগ্রিক কেন্দ্রে নিজেকে পাকাপোক্তভাবে অধিষ্ঠিত করে ফেলতে সক্ষম হয়। বিশেষ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এবং ভাষা আন্দোলনে আবারও বিশ্ববিদ্যালয়টি পূর্ব বাংলার মানুষের চেতনা, বিশ্বাস এবং প্রতিবাদের স্বতন্ত্র শিক্ষালয় এবং পীঠস্থান হিসেবে প্রতিফলিত আবির্ভাবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় এদেশকে পথ দেখাচ্ছে এমনটি বুঝতে পারে কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত সকল শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ। ফলত, ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীরা পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর অংশে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। তারা এই দাবিতে আন্দোলনও শুরু করে। মূলত ভাষা আন্দোলনের পূর্বেই বিভিন্ন জনসম্পৃক্ত আন্দোলনে রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি শুরু হয়। ধীরে ধীরে তা জোরালো হয়ে উঠতে থাকে।

রাজশাহী শহরের সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাজশাহী কলেজ ক্যাম্পাসে সমবেত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। এরপর উত্তরাঞ্চলের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কমিটি করা হয়, ভুবনমোহন পার্কে জনসভাও অনুষ্ঠিত হয়। উত্তরাঞ্চলের রাজনীতিবিদ এবং আইন পরিষদ সদস্য মাদার বখশের প্রকাশ্য ঘোষণায় রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অবধারিত হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৫০ সাল থেকে শুরু করে ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্নভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অব্যাহত ছিল। অবশেষে উত্তরবঙ্গকে পৃথক প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতির আন্দোলনের ঝুঁকি এড়াতে পূর্ব পাকিস্তানের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩২ বছর বয়সে অবিভক্ত পাকিস্তানি আমলে এই অঞ্চলের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে 'রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই। প্রথম উপাচার্য নিযুক্ত হন অধ্যাপক ইতরাত হোসেন জুবেরী। প্রথম ক্লাস অনুষ্ঠিত হয় রাজশাহী কলেজে। দপ্তর ও উপাচার্যের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে পদ্মাপাড়ের বড় কুঠি ভবনটি। চিকিৎসাকেন্দ্র, পাঠাগার স্থাপিত হয়। ১৯৫৮ সাল থেকে বর্তমান ক্যাম্পাস নির্মাণ শুরু হয়, ১৯৬৪ সালের মধ্যে সকল দপ্তর, শ্রেণিকক্ষ, আবাসিক ও অনাবাসিক ভবন মূল ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয়। উত্তরবঙ্গের এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার ১৫ বছরের মধ্যে রাজনীতির হাওয়া আবারও গরম হয়ে ওঠে৷ পাকিস্তানের সাথে বাংলা অঞ্চলের যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ হওয়ার পরিবর্তে কণ্টকাকীর্ণ হয়ে ওঠে। যে ক্ষত ১৯৫২ সালে তৈরি হয়েছিল, সেটি ক্রমশ পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের প্রতি বাঙালিদের আস্থার সংকটে পরিণত হয়৷ সায়ত্তশাসন এবং স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা শুরু হয়েছিল ১৯৪৯ সালে, মুসলিম লীগ ভেঙে আওয়ামী লীগ গঠনের মধ্য দিয়ে। মধ্যবর্তী বছরগুলোতে সামরিক শাসক এবং বেসামরিক শাসক উভয়ের কাছ থেকে বিমাতা সুলভ বৈষম্য পাওয়ার পর বাংলা অঞ্চলের ছাত্ররা আবারও বুঝতে পারে, ব্রিটিশ শাসন অবসানই চূড়ান্ত মুক্তি এনে দিতে পারেনি। বিশেষ করে অস্ত্র প্রয়োগ করে আন্দোলন ও দাবি নির্বাপনের চেষ্টা সচেতন মানুষেরা ভালো ভাবে নেয়নি। স্বাধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবার মঞ্চে আবির্ভূত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্ববিদ্যালয় যে কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, মনস্তত্ত্ব এবং আদর্শ নির্মাণের মন্দির, তার প্রমাণ দিতে শুরু করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জাতীয় ইস্যুগুলোতে সরব থাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের ভয় পেতো পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেই ভয়েরই প্রতিফলন দেখা যায় ক্যাম্পাসের সামনে গুলি চালানোর ঘটনা থেকে। ছাত্ররা সহপাঠীদের প্রতি অত্যাচারের নিন্দা জানাতে সরব মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসের সামনে অবস্থান নিয়েছিল। মিছিলটি যেনো সহিংস না হয়ে ওঠে, সেজন্য তৎকালীন প্রক্টর, সহযোগী অধ্যাপক শামসুজ্জোহা ছাত্রদের সাথেই ছিলেন। তিনি ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে উচ্চতর ডিগ্রিধারী একজন একাডেমিক স্কলারও ছিলেন।

ছাত্রদেরকে সেনাবাহিনীর হাত থেকে নিরাপদ রাখার প্রত্যয় তিনি দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেছিলেন ১৭ ফেব্রুয়ারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সভায়। সে ঘোষণার মাত্র একদিন পরে ছাত্রদের নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত থাকা অবস্থায় সেনাবাহিনীর গুলিতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন, অনতিকাল পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ক্যাম্পাসের সামনে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা শিক্ষাঙ্গন। শুরু হয় সামরিক শাসনের প্রকাশ্য বিরোধিতা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের এই অংশটি আমাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্বরূপ ও আদর্শগত দিকগুলো স্পষ্ট করে তোলে৷ পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজস্বতা, স্বাধিকার এবং প্রতিবাদ করার স্বাধীনতার প্রশ্নে সরাসরি দেশের সামরিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে।

গণ-অভ্যুত্থানের ওই উত্তাল সময়টিতে শামসুজ্জোহা ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম শহীদ শিক্ষক তথা বুদ্ধিজীবী। তাঁর মৃত্যু অনেকটা অনুপ্রেরণার মত এই অঞ্চল এবং এই বিশ্ববিদ্যালয় ছাপিয়ে সমগ্র দেশের শিক্ষাঙ্গনে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনকে বেগবান করে। সেই বছরের ২৫ মার্চ তীব্র আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের ১১ বছরের শাসনামলের অবসান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে সমগ্র পূর্ববঙ্গের একটি অন্যতম ভিত্তিভূমিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়। পাকিস্তান আমলে এই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জ্যেষ্ঠতার বিচারে শুধু নয়, সংগ্রামের ইতিহাস বিচারে অগ্রগণ্য হয়ে আছে৷ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মচারীদের তালিকা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মুক্তিযুদ্ধের নীরব সাক্ষী ৭৫৩ একরের এই শিক্ষাঙ্গনটি। ক্যাম্পাসের তৎকালীন প্রতিটি ছাত্র হল ছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্যাতনের বীভৎসতার নীরব সাক্ষী। ক্যাম্পাসের বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের স্বজন হারানোর বেদনা এবং শোকের প্রতীক হয়ে। বাংলাদেশের জন্মলগ্নের সাক্ষী এই বিশ্ববিদ্যালয়টি আজকে তার ৬৮ বছর পূর্ণ করেছে। পৌঢ়ত্বে মানুষ যেমন স্থিতধী হয়, তেমনি জ্ঞানে-গুণে সমৃদ্ধ হয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও ঠিক তেমনভাবেই নীরবে বাংলাদেশের কল্যাণে, বাংলাদেশের মানুষের জ্ঞানের পরিধি বিস্তারে, মানুষের মনস্তত্ত্বকে বৈশ্বিকভাবে সমৃদ্ধ করার আয়োজনে একজন লাজুক অথচ সাহসী সেনাপতির মত কাজ করে চলেছে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশের ইতিহাসে, সমাজতত্ত্বে, সাহিত্যে, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে এবং বিজ্ঞান-গবেষণায় বিপুল অবদান রেখে চলেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। শুধুমাত্র কৃতী বা বিখ্যাত ছাত্রদের তালিকা দিয়ে সেই অবদানকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত সমাজ তৈরি করেছিল, তেমনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশকে স্বাধিকারের পথ দেখিয়েছে, সমাজ-জীবনে প্রতিবাদী ও সাহসী মানুষ তৈরি করে অবদান রেখেছে। এদেশের মানুষের চেতনাগত বিকাশে, মুক্তবুদ্ধির চর্চায়, বহুমুখী আঙ্গিকে ভাবনায়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক জীবনমান উন্নয়নে সর্বোপরি ইতিহাস পরিক্রমায় নীরবে অবিচ্ছেদ্য অংশীজনের মতো ভূমিকায় বরাবরই থেকেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর, ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত 'বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর' এর দেখভাল এবং নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। আবার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সংগ্রশালা, 'শহীদ স্মৃতি সংগ্রশালা' স্থাপিত হয়ে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাই বাংলাদেশের আত্মার আত্মীয়, ইতিহাসের অংশ, বাংলাদেশি সভ্যতার অন্যতম রূপকার। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়ে অধ্যয়ন করা, এটির সামাজিক উপযোগিতা এবং বিশাল অবদান নিয়ে প্রচারণা বাংলাদেশেরই সুপ্ত স্বত্তা নিয়ে পড়াশোনার শামিল৷ রাজশাহী শহরটি দেশের প্রান্তিক এলাকা হওয়ায় আধুনিক সময়ে এসে বিকেন্দ্রীকরণের অভাবে বাংলাদেশ সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়টির বিষয়ে উদাসীন-অসচেতন থাকে। এটি প্রকারান্তরে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং যুগপৎ সংগ্রামের প্রতিই উদাসীনতা প্রদর্শনের শামিল। যে বিশ্ববিদ্যালয় নীরব সাধকের মত প্রায় সাতটি দশকজুড়ে বাংলাদেশকে এত উপহার-উপঢৌকন দিয়ে গেলো, বাংলাদেশের জন্য আত্মস্বার্থ বিসর্জন এবং ত্যাগস্বীকার করলো, সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি নিঃসন্দেহে আরো আলোচনা, আরো অধ্যয়ন, আরো মনোযোগ, আরো পরিচর্যার দাবি রাখে।

সাম্প্রতিক সময়ে চলমান উপাচার্য-শূণ্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, নিয়োগ সংক্রান্ত বেশ কয়েক বছর যাবৎ চলমান জটিলতা, অসততা এবং অনৈতিক স্বজনপোষণের অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার পরিবেশকে যেমন ব্যাহত করছে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ম্লান করে তুলেছে। এই অনভিপ্রেত ঘটনা এবং দৃষ্টান্তগুলোর অবসান হোক৷ অতীতের গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্তগুলো পুনর্স্থাপিত হোক৷ বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলাদেশের মধ্যে বিশ্বমানের একটি অধ্যয়নস্থলে পরিণত হোক। বিশ্ববিদ্যালয়টির ৬৮ বছর পূর্তি ও ৬৯ বছরে পদার্পণে একজন বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে এটি আমার প্রত্যাশা।

লেখক-

শিক্ষার্থী                                                                                                                                  শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence