শিক্ষকদের ওপর দায় না চাপিয়ে শীর্ষপদে নিয়োগের পদ্ধতি বদলাতে হবে

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেন
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেন  © ডয়েচে ভেলে

বাংলা ভাষায় একটা প্রবাদ আছে, যে যায় লংকায়, সে-ই হয় রাবণ। ক্ষমতা হাতে পেলে সেই ক্ষমতার অপব্যবহারে বাঙালি কতটা দক্ষ, এই প্রবাদ মনে করিয়ে দেয় সেই কথাটাই।

ইদানিং সেটা মনে করিয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদ, তথা উপাচার্যের দায়িত্ব পাওয়া ব্যক্তিবর্গ। কোভিড-১৯ অতিমারি, সেই সূত্র ধরে লকডাউন ঘোষণা এবং সেই ঢিলেঢালা লকডাউনকে আক্ষরিক অর্থেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গণ-মানুষের গ্রামযাত্রা নিয়ে ডামাডোলের মধ্যেও পত্রিকার পাতায় জায়গা করে নিচ্ছে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণের নানা কাণ্ডকীর্তি।

কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? উপাচার্য পদে যারা নিয়োগ পাচ্ছেন, তারা তো কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ শিক্ষক। তাদের হাত দিয়ে কেন এমন সব অনিয়মের ঘটনা ঘটছে?

এই প্রশ্নের উত্তর আসলে খুঁজতে হবে খোদ উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়ায়। বাংলাদেশের সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয় জাতীয় সংসদে অনুমোদিত নির্দিষ্ট আইনের ভিত্তিতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে প্রণীত এরকম একটি আইন ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ নামে পরিচিত, যার ভিত্তিতে পরিচালিত হয় ওই সময়ে বিদ্যমান পুরনো চারটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় অর্ধশত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাকিগুলোর পরিচালনার জন্য আছে পৃথক পৃথক আইন।

১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বায়ত্বশাসন দেয়া হয়েছিল, সেই আইন অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী অঙ্গ, তথা সিনেটের মাধ্যমে নির্বাচিত একটি প্যানেল থেকে আচার্য, তথা মহামান্য রাষ্ট্রপতি উপাচার্য নিয়োগ দেন। সিনেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ- শিক্ষক, ছাত্র, শিক্ষাবিদ, সরকার এমনকি সুশীল সমাজেরও প্রতিনিধিত্ব থাকে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, দীর্ঘদিন ধরেই এই প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করা হচ্ছে না। আইনের ফাঁক গলে উপাচার্যদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী; নিয়োগ পাওয়ার পরে তাদের কেউ কেউ সিনেটে নির্বাচনের মাধ্যমে অনেকটা গণভোট স্টাইলে সেটা বৈধ করে নিচ্ছেন, বাকিরা সেটারও তোয়াক্কা করছেন না।

১৯৭৩-এর ওই অধ্যাদেশের বাইরে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে তো এই নামে-মাত্র নির্বাচনের ব্যবস্থাটুকুও নেই। প্রকৃতপক্ষে, সেখানে উপাচার্যসহ শীর্ষপদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময় শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ছাড়া কোনোরকম পূর্বশর্তই নেই, আচার্য যাকে খুশি নিয়োগ দিতে পারেন। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তো বিশেষ করে কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে এই শর্তটিও রাখা হয়নি।

কিন্তু আচার্য নিয়োগটা দেন কী করে? তিনি তো আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সকল শিক্ষককে চেনেন না! আসলে তিনি বেছে নেন সরকারের বেছে নেয়া কিছু নাম থেকে। যত ঝামেলা এই বাছাই প্রক্রিয়া নিয়েই। কেননা, এই বাছাই প্রক্রিয়ার আসলে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। ইদানিং এখানে একটাই বিষয় বিবেচ্য, সরকারের প্রতি, আরো নির্দিষ্ট করে বললে সরকারি দলের প্রতি অন্ধ আনুগত্য।

এই বিবেচনার ভিত্তিতে যিনি উপাচার্য নির্বাচিত হন, স্বাভাবিকভাবেই তার পক্ষে স্বাধীনভাবে, নৈতিক কর্তব্যের আলোকে দায়িত্ব পালন করা কঠিন, কারণ তাকে সরকারি দলকে খুশি রাখতে হয়। এই দলবাজি ছাত্রদের মধ্যে আছে, শিক্ষকদের মধ্যেও আছে, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বিশাল বহরেও আছে। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি আসে এই রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের ভাবনাও, আর সেই ভাবনা থেকে আসে শিক্ষক বা কর্মচারি নিয়োগে রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনার প্রশ্ন, আসে নির্দিষ্ট ছাত্র সংগঠনকে নানা রকম সুবিধা দেয়ার প্রশ্ন। আর বিশেষ সুবিধা যখন দেয়াই হচ্ছে, তখন সেটা শুধুই রাজনৈতিক বিবেচনায় সীমাবদ্ধ থাকছে না, যোগ হচ্ছে আত্মীয়করণ, আঞ্চলিকতাপ্রীতি এমনকি টাকার বিনিময়ে বা অন্য কোনো সুবিধার বিনিময়েও নিয়োগের অভিযোগ উঠে আসছে।

এই সব অভিযোগের ভিত্তিতে এমন একটা ধারণা তৈরি হচ্ছে যে, প্রশাসন পরিচালনায় আসলে শিক্ষকরা যোগ্য নন। সেটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সম্প্রতি একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোষাধ্যক্ষ পদে একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

কিন্তু এটা কি আসলে কোনো সমাধান হতে পারে? উত্তরটা, এক কথায়- না! বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যাই শুধু নয়, যে কোনো সমস্যার সমাধান চাইলে প্রথমে এর ত্রুটিটা কোথায়, খুঁজে বের করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শীর্ষ পদে এই যে দুর্নীতির মহোৎসব, এটা কিন্তু বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এটা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বাস্তবতারই প্রতিফলন, সমাজের প্রতিটি স্তরে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে যে পচন, এটা তারই প্রতিচ্ছবি মাত্র।

এর সমাধান করতে হলে প্রথমে বদল করতে হবে শীর্ষপদে নিয়োগের পদ্ধতিটাকে। অঙুলি হেলনে উঠবেন-বসবেন এমন মেরুদণ্ডহীন, অযোগ্য লোকদের নিয়োগ দিয়ে, তাদের ওপর নানা রকম চাপ সৃষ্টি করার ফলশ্রুতিতেই সৃষ্টি হয়েছে এই পরিস্থিতি। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করে, সেই নীতিমালার ভিত্তিতে যোগ্য লোকদের নিয়োগ দেয়া এবং তাদের নির্ভার কর্মপরিবেশ উপহার দিলেই কেবল পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে।

এই দ্বিতীয় অনুষঙ্গটি প্রথমটির চেয়ে কোনো অংশে কম জরুরি নয়। ইদানিং যে জ্ঞান ও কর্মদক্ষতায় এগিয়ে থাকা নীতিবান শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শীর্ষপদে দেখা যাচ্ছে না, তার কারণ কিন্তু শুধু এ-ই নয় যে তারা নির্দিষ্ট দলের প্রতি বিশ্বস্ত নন। স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ নেই বলে এমন ব্যক্তিরা আসলে দায়িত্ব নিতে আগ্রহীও নন, কারণ, দায়িত্ব পাওয়ার পর সরকার-ছাত্র সংগঠন-শিক্ষক সমিতি, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বহুমুখী চাপ সামলানোর ঝক্কি তারা নিতে আগ্রহী হন না। এই চাপই তো আসলে ‘লংকার সিংহাসনে আসীন' সকলকে রাবণ হয়ে উঠতে বাধ্য করে! নইলে তো তিনি টিকে থাকতেই পারবেন না!

সূত্র: ডয়েচে ভেলে।


সর্বশেষ সংবাদ