‘দু’পায়ের শিকল ভাঙ্গতে চাইলে আমি হয়ে যাই উশৃংখল মেয়ে’
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২১, ০৩:৩৫ PM , আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২১, ০৪:০১ PM
আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ঘরে-বাইরে সবখানেই এখনো চলছে নারীদের যুদ্ধ। কখনও চেনা মানুষের বিরুদ্ধে আবার কখনও অচেনা মানুষদের বিরুদ্ধে। আজ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা পাল্টালেও তা পর্যাপ্ত নয়। নারীরা অনেক সময় শিক্ষা বা কর্মসংস্থানে অবহেলার শিকার হচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী নারীদের অগ্রগতি, প্রতিবন্ধকতা এবং প্রত্যাশা নিয়ে মতামত দিয়েছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের প্রতিনিধি শাহাদাত বিপ্লব...
আনিকা তাসনিম সুপ্তি (৩য় বর্ষ) লোকপ্রশাসন বিভাগ
সমাজে প্রচলিত জীবনব্যবস্থা সেই আদিকাল থেকেই নারীদের শেখায় সহনশীলতা ও নম্রতা, অপরদিকে পুরুষদের কর্তৃত্ববাদিতা শেখায় যা এই একুশ শতকেও চলমান আছে। ফলে আমরা নারীরা অন্যায়কে মাথা পেতে নিতে বাধ্য হচ্ছি এবং প্রকাশ্যে হোক কিংবা গোপনে, আমরা নারীরা স্বাধীন দেশের পরাধীন নাগরিক হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। এখন এমন এক সময় চলছে যেখানে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নারীকে শিক্ষার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, স্বাধীন চিন্তাভাবনা, মতপ্রকাশের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পর নারীকে টেনে হিচঁড়ে সেই পুরোনো দাসত্বের জায়গায়ই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সবচেয়ে দুঃখজনক এটিই যে নারী স্বাধীনতা আজও অজ্ঞতায় ঘেরা। নারী স্বাধীনতা যে কি তা উপলব্ধি করার মানুষের বড় অভাব। একজন নারীর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে গভীর দৃষ্টিতে চিন্তা করলে পরিষ্কারভাবে উঠে আসবে নারীর জীবন কতটা ভয়াবহ। এই ভয়াবহতার পেছনে যে কেবল পুরুষ সমাজ দায়ী তা নয়, বরং নারী ও পুরুষ সমানভাবে দায়ী। আধুনিকতার ইতিবাচক অর্থ করতে হবে, নারীদের শুধু মেয়ে নয় মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে জানতে হবে। তা একমাত্র সম্ভব মন-মানসিকতার পরিবর্তনেই। সমাজের যা কিছু খারাপ, যা কিছু প্রথাবিরুদ্ধ, যা কিছু অন্যায় তা শুধু নারী নয়, নারী ও পুরুষ প্রত্যেকের জন্যই অন্যায়- এই ধারণাই নারীদের প্রতি মনোভাব পরিবর্তনে সাহায্য করতে পারে। স্বাধীনচেতা এবং স্বনির্ভর মেয়ে মানেই আধুনিকতার নেতিবাচক বহিঃপ্রকাশ এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
সাবরিনা আলম, ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগ
মমতাময়ী, তেজস্বী, কঠোর, প্রণয়ী, অর্ধাঙ্গীনী, কত বিশেষণে বিশেষায়িত একটি শব্দ ‘নারী’। এই শব্দটির সাথে যে শব্দটি খুব সহজেই একাত্বতা প্রকাশ করে সেটি হলো ‘পারি’। আমরা নারী, আমরা পারি। কাজী নজরুল যেমন বলেছেন "মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর এক হাতে রণতুর্য।"
তেমনিভাবে নারী একদিকে প্রেম আর ভালোবাসা দিয়ে অন্দরমহলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে অপরদিকে ঘাত-প্রতিঘাত উপেক্ষা করে বাইরের জগতে সমৃদ্ধি আনয়ন করে। একবিংশ শাতাব্দীতে এসেও নারী অগ্রযাত্রার পথ সুগম নয়।সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এপথে বড় বাধা। ঘরে এবং বাইরে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এখন সময়ের দাবী। নারী দিবসে আমার প্রত্যাশা, অধিকার কিংবা মর্যাদার দিক থেকে নারীদের কারো সাথে তুলনা করা নিষ্প্রয়োজন। নারী তার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। নারী পুরুষের সমান অধিকার চাই না। নারীরা প্রাপ্য সম্মান নিশ্চিত করতে চায়। ঘরে বাইরে নিরাপত্তা চায়। নারীর কণ্ঠ এবং মননে ধ্বনিত হোক "আমরা নারী সবই পারি, নইকো মোরা ক্রীতদাস।"
তানজিনা আক্তার, নৃবিজ্ঞান বিভাগ
সমাজে নারী মানেই একটা সীমাবদ্ধতার নাম। উদ্যোক্তা আমার কাছে এক স্বপ্নের নাম। আর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ কখনোই সহজ ছিল না। তার উপর আমি একজন নারী। নারীর সাথে যখন উদ্যোক্তা শব্দটা আসে তখন ব্যবসা বলাটাই যেন কিছু মানুষের আনন্দের খোরাক হয়ে ওঠে। বেশী দূরে নয় প্রথম প্রতিবন্ধকতা হলো আমার প্রিয় মানুষ গুলো। বাবার ইচ্ছে বিসিএস এর জন্য পড়াশোনা করো, আর মায়ের ভাবনা মেয়ে হয়ে জন্ম হয় ভালো ছেলে দেখে বিয়ে করে সংসারি হওয়ার জন্য। উদ্যোক্তা এসব আামর জন্য নয় করণ আমি একজন মেয়ে। আর পাড়ার মানুষ বাবাকে দেখলেই বলতে শুরু করে, শুনলাম মেয়েকে দিয়ে নাকি ব্যবসা শুরু করেছেন, ভার্সিটিতে পড়ে এসব করবে?
কি দরকার এত পড়াশোনার যদি ব্যবসাই করে। তারা ভাবে উদ্যোক্তা হতে পড়াশোনা লাগে না।
আর কেউ কেউ তো আবাক হয়, যখন বলি উদ্যোক্তা হওয়া আমার স্বপ্ন। কেউ যেনো বিশ্বাসই করতে পারে না নারী হয়ে উদ্যোক্তা হওয়া যায়।
তখন ভাবি আমার স্বপ্ন দেখাটা ভুল ছিল নাকি মেয়ে হয়ে জন্মানোটা। আমার দু’পায়ের শিকল ভাঙ্গতে চাইলে আমি হয়ে যাই সমাজের উশৃংখল মেয়ে। শুধু এখানেই শেষ নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন পণ্যের ছবি দেখে মানুষ আমার দাম জানতে চায় তখন মনে হয় ভুলটা এখানেই, আমি মেয়ে। আর মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের অর্থের প্রতিবন্ধকতার গল্প তো সমাজের মানুষের চিরচেনা। এই প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে আমারা ছুটে চলতে চাই আমাদের স্বপ্নর পথে। যদিও এই বাঁধায় হারিয়ে যায় অনেক সৃজনশীল মেধা।