বন্দী জীবন কি শুধু শিক্ষার্থীদের?

  © প্রতীকী ছবি

২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে মহামারী করোনাভাইরাসের প্রকোপে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বন্ধ ঘোষণা করা হয় সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও। তবে পরবর্তীতে সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দেওয়া হলেও দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি দফায় দফায় বাড়ানো হয়। বর্তমানে এ ছুটি ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। পরবর্তীতে আরো কতদিন এ ছুটি বৃদ্ধি করা হবে তা আপাতত সকলেরই অজানা।

সর্দি-কাশি আর জ্বরের মতোই করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব মানব শরীরে রয়েই যাবে। এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলেও কবে থেকে তার ব্যবহার শুরু সম্ভব বা বাংলাদেশে তা ব্যবহারে আরো কত মাস বা বছর লেগে যেতে পারে তা নিয়ে আমি কিছুটা সন্ধিহান। দীর্ঘ ৮ মাস যাবৎ আমার মতো হাজারো শিক্ষার্থী ঘরে বন্দী হয়ে রয়েছে। বন্দী হয়ে রয়েছে কথাটা একটু ভুল, বন্দী জীবন শুধু আমাদের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেই?

জীবনের তাগিদে আমরা সকলেই বর্তমানে আমাদের নিত্যদিনের সকল কাজ-কর্ম বেশ ভালোভাবেই করে চলেছি। বিয়ে বাড়ি থেকে শুরু করে হাট বাজার দোকানপাট বড় ছোট সকল শপিংমলে আমাদের উপচে পরা ভিড় কিন্তু চোখে পড়ার মতো। এইতো শুরু হয়েছে পৌরসভা পর্যায়ের নির্বাচন। প্রতিদিন হাজারো মানুষের মিছিল সভা, চায়ের দোকানে হরেক আড্ডার ভিড় কম বৈকি না, সাস্থ্যবিধি তো দূর মুখে মাস্ক পর্যন্ত নেই। তবে করোনা কি শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই হানা দিয়েছে? অনেকে বলবে তাদের দায় সরকার নেবে না, কিন্তু দেশের মেরুদন্ড শিক্ষা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার জন্য সরকারের জবাবদিহিতা করতে হবে, একটা বাচ্চাও যদি প্রাণ হারায় তবে কি হবে? আমি এই কথায় পরিপূর্ণ সমর্থন করি। প্রাণের চেয়ে শিক্ষা বড় নয়। কিন্তু আমার মনে এই প্রশ্নেরও কোনো উত্তর মেলে না সত্যিই কি এভাবে কোনো সমাধান হচ্ছে? দীর্ঘ ৮ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় কতো হাজার শিক্ষার্থী ঝরে গেছে তার জরিপ ইউনিসেফ তো দিয়েই দিয়েছে।

শুধু তাই নয় শিক্ষাবিমুখ হয়ে কতো শিশু জীবনের তাগিতে কর্মে নেমেছে, যা শিশুশ্রম এর সামিল। কতো মেধাবী শিক্ষার্থীকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি এই ৮ মাসে, কতজন শিক্ষার্থী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে তার হিসাবটাও একটু করা উচিত। বাংলাদেশ ডিজিটালাইজেশন হলেও এদেশের মানুষ কতটা উন্নত আমরা সবাই জানি। প্রযুক্তির ব্যবহার পুরোপুরি আয়ত্ব করতে আমাদের যে আরো বেশকিছু বছর লেগেই যাবে তাতে সন্দেহ নেই।

কারণ আমাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান কিছুটা নগণ্য। যেখানে জীবন চালানো দায় সেখানে অনলাইনে শিক্ষা ব্যবস্থার বিষয়টা কিছুটা অদ্ভুত বটে। সাথে নেটওয়ার্ক সমস্যা তো রয়েই গেছে। শুধু ডিভাইস থাকলেই তো আর পড়াশুনা হয়না, প্রয়োজন ইন্টারনেট ডাটা। আর বর্তমানে সকল নেটওয়ার্ক অপারেটর যেভাবে ইন্টারনেট ডাটা প্যাকগুলোর মূল্য বৃদ্ধি আর মেয়াদ হ্রাস করেছে তাতে আমার কাছে ১ বাটি মুড়ি ১ মিনিটে খেয়ে শেষ করার মতোই হাস্যকর মনে হয়। যদিও সরকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ডাটা ফ্রি দিতে সক্ষম হয়েছে কিন্তু তাতে আমাদের কোনো উপকার হয়নি।

আমরা প্রাইভেটে পড়া শিক্ষার্থী, আমাদের সেই সুবিধা সরকার কি আর দেবে? দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এ আসন সংখ্যা কম থাকায় ইচ্ছে থাকলেও ভাগ্যের পরিহাসে আমার মতো অনেকেরই পাবলিকে পড়া সম্ভব হয়না। কিন্তু নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার যুদ্ধে আমার মতো অসংখ্য মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা ভর্তি হয় প্রাইভেট বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। মধ্যবিত্ত হওয়ায় অনেকেই টিউশন বা ছোটখাটো পার্টটাইম চাকুরী করে নিজেদের পড়াশুনার খরচ চালায়। কিন্তু দীর্ঘ ৮ মাস বাসায় কর্মহীন বসে থাকায় বেকারত্বের কষ্টটা বেশ ভালই বুঝতে পারছি আমরা।

এদিকে অনলাইনে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রেখে সেশনজটের সমস্যা হয়তো কিছুটা সমাধান হলেও এই শিক্ষা আমাদের ভবিষ্যতে কিরূপ প্রভাব ফেলবে তা সরকারের দৃষ্টিতে আসলে ভালো হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দেশে বেকারের সংখ্যা কম বৈকি না, সেখানে অনলাইনে শিক্ষা দেশের মেরুদন্ড কতটা শক্তিশালী করেছে তা আমার কাছে একটু ভাবাবার মনে হয়। শিক্ষা ক্ষতি ছাড়াও গত মার্চ থেকে ধর্ষণ আর খুনের মতো ঘৃণিত অপরাধ শুধু বেড়েই চলেছে। আত্মহত্যা আর হতাশা করোনার মতোই মহামারীতে রূপ নিতে বেশিদিন নেই হয়তো।

দীর্ঘদিন এই শিক্ষাহীন, কর্মহীন বন্দি জীবনের মুক্তির পথটা কি আর শেষ হবে না? আর কতদিন ? তবে বলতেই হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার মতো পরিবেশ কখনোই তৈরি হবেনা। আসলেই তাই!

লেখক: শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকমী


সর্বশেষ সংবাদ