সত্যিকারের ভালো মানুষেরা অপেক্ষাকৃত মৃদু হয়
- আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
- প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২০, ০৯:৫২ PM , আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২০, ১০:৫৪ PM
আমি ঢাকা কলেজে শিক্ষক ছিলাম। একদিন কলেজে ক্লাস নিচ্ছি। পেছনের দিকে কিছু শিক্ষার্থী স্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছে- ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই’। তারা লড়াই ছাড়া আর কিছু চায় না। কিন্তু কিছুক্ষণ স্লোগান দেয়ার পরেই তারা রেস্টুরেন্টে গিয়ে চা-সিঙাড়া খেয়ে বাসায় চলে যায়।
আমাদের কলেজের ছাত্রদের কোয়ালিটি তখন এতো ভালো ছিল; ৭৮-৭৯ শতাংশ নম্বর পেয়েও অনেক ছাত্র ভর্তি হতে পারতো না। আমি সবসময় বলতাম, আমাদের ঢাকা কলেজের একটা সেকশনে যত ভালো ছাত্র আছে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ততগুলো ভালো স্টুডেন্ট নেই এবং এটা সত্যি।
এসব ভালো ছাত্ররা আমার সামনে বসে আছে, আমি কথা বলছি এবং তারা নীরবে আমার কথা শুনছে। আর ওদিকে ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই’ স্লোগান দিতে দিতে কিছু ছাত্র বেরিয়ে যাচ্ছে। যারা আমার সামনে বসে বসে ক্লাস শুনছে তাদের থেকে একজন মেধাবী তাচ্ছিল্য করে আমাকে বলে যে দেখেন স্যার! লড়াই করে বাঁচতে চায় তারা। আমি তাদেরকে বললাম দেখো আমি তোমাদেরও চিনি; ওদেরও চিনি।
যদি বুদ্ধির কথা বলতে চাও তাহলে ওদের বুদ্ধি তোমাদের বুদ্ধি চেয়ে অন্তত সাত গুন বেশি। আর সাহসের কথা বললে যে সময় তোমরা কিছু নম্বরের এবং জীবনের একটা নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য আমার সামনে বসে আছ সে সময় তারা আমার পেছনে দিয়ে লড়াই লড়াই বলতে বলতে বেরিয়ে যাচ্ছে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো তোমরা নিজের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারো নাই। কিন্তু তারা তাদের স্বাধীনতা অর্জন করে নিয়েছে। তারা ইচ্ছে মত রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা তাদের ভবিষ্যতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর ফলে কী হবে? তুমিও পাশ করতে করতে এক সময় বিসিএস পরীক্ষা দেবে। বিসিএস দিয়ে তুমি হবে তার সেক্রেটারি আর তোমার সেই বন্ধু হবে তোমার মন্ত্রী। সেদিন তোমাকে বলতে হবে ‘আসসালামুয়ালাইকুম স্যার’!
আমার ধারণা, পৃথিবী শাসিত হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষের দ্বারা। একটা জাতি শাসিত হয় মফস্বলের ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারা। কারণ ঢাকা শহর বা নগর জীবনে দুটো জিনিস থাকে না। একটা হচ্ছে বিস্ময়বোধ। যেমন ধরো গতকাল তোমার বাসার সামনে দিয়ে একজন মন্ত্রী গেলেন। তোমার কিছুই মনে হলো না। আর আমি কিছুদিন আগে শেরপুর যাচ্ছি। হঠাৎ শুনি ‘সরে যাও, সরে যাও’ শব্দ। দেখা গেল গ্রামের রাস্তা দিয়ে একজন প্রতিমন্ত্রী যাচ্ছে। তার সামনে ১২টা গাড়ি পেছনে ১৩টা গাড়ি। মাঝখানের গাড়িতে প্রতিমন্ত্রী পা তুলে বসে আছেন।
গ্রামের একটি ছেলে প্রথম যখন এ দৃশ্য দেখবে তখন সে মন্ত্রী নয়, প্রতিমন্ত্রীই হতে চাইবে। শহর জীবনে এই বিস্ময়বোধ নেই। শহরে শ্রদ্ধা নেই। সফস্বলের মানুষ শ্রদ্ধা, স্বপ্ন দেখতে জানে।
একবার আমাদের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাশের বস্তিতে আগুন লাগে। আগুন যে কি ভয়ংকর জিনিস আমি নিজে চোখে এভাবে কখনো দেখিনি। মুহূর্তের মধ্যে ঝড়ের মত বাতাস এসে পুরো বস্তিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। বস্তি হঠাৎ করেই এক ভয়ংকার জায়গায় পরিণত হয়ে গেল।
তখন আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ক্লাস করছি। তাদের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে। ক্লাসের মধ্যে কিছু বক্তা সব সময় থাকে। আর আমার ধারণা বাংলাদেশের মত এত বক্তা পৃথিবীর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। যেখানে এত নিষ্কর্মা লোক সেখানে এত বক্তা না থেকে পারে না। ক্লাসে কিছু বক্তা থাকে, যারা প্রত্যেক কথায় কথায় লাফ দিয়ে উঠে কথা বলতে চায়। তারা ক্লাসের মধ্যে লাফ দিয়ে উঠে বিরাট বিরাট বক্তৃতা দেয়। তাদের বক্তৃতা সকলকে বিস্মিত করে তোলে।
আমি এতদিন ভাবতাম এরাই হচ্ছে ক্লাসের সবচেয়ে সাহসী, যোদ্ধা। বস্তিতে আগুন লাগার পর তাদের কাউকে দেখা গেল না। তারা পেছন দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। এরা তো ক্লাসের টপার শ্রেণী।
এরপরের শ্রেণী হলো- আমাদের লাইব্রেরীটা ছিল দোতলায়। আমার ধারণা হলো লাইব্রেরীটা বোধহয় পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। তখন আমি বালতি করে পানি এনে লাইব্রেরীর দেয়ালে ছিটাতে থাকি। এরা আমার সঙ্গে যোগ দিল। এসময় তারা ছাড়া আর কারো দেখা পাইনি।
তারপর যখন আগুন নিভে গেল তখন আবার সবাই ফিরে এল। আমরা আবার বসলাম। এখন সে বিরাট বিরাট বক্তারাও ফিরে এলেন। কিন্তু আমি দেখলাম বক্তারা সবাই অক্ষত। মনে হয় প্রমোদ ভ্রমণে বেরিয়ে আবার ফিরে এসেছে। আর আমার সঙ্গে যারা ছিল তারা কিছুটা ক্লান্ত। আর কিছু ছেলে দেখলাম তাদের মুখে কালো দাগ, হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে। জামা-পাঞ্জাবী ছিঁড়ে গেছে। এদের কোনদিন আমি ক্লাসে কথা বলতে দেখি নাই। এরা চোরের মত পেছনে এসে বসে ক্লাস শোনে আবার চোরের মত বেরিয়ে যায়।
আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম তোমাদের এরকম অবস্থা হল কেন? তারা বলে স্যার আমরা আগুন নেভাতে গেছি। এসময় তারা আগুনের মধ্যে ডুকে গিয়েছিল। তখন আমার মনে হল- তাহলে হিরো কারা? যে জিব দিয়ে হিরোইজম করে সে হিরো নাকি যে জীবন দিয়ে হিরোইজম করে সে হিরো? আমরা যখন পরীক্ষায় নম্বর দিতাম তখন কাদের নম্বর বেশি দিতাম? ওই বক্তাদের নম্বর বেশি দিতাম। তাদের খাতা ভালো। আমরা দেখতাম কার মেধা বেশি তাকে আমরা নম্বর দিতাম। কিন্তু সেদিন আমার ভুলটা ভাঙলো। আমার মনে হল যে মেধাবীরাই যে সবসময় শ্রেষ্ঠ সেটা নয়।
বস্তীতে আগুন নেভাতে যেসব ছেলেগুলো গিয়েছিল তাদের কিন্তু কেউ যেতে বলেনি। যখনি তারা আগুন লাগার ঘটনা টের পেয়েছে তখন তাদের ভেতরকার বেদনা থেকে ছুটে গিয়ে তা নেভানোর চেষ্টা করেছে। তাহলে বেটার কারা? আমি তো মনে করি ক্লাসের এই দ্বিতীয় শ্রেণীর ছেলেগুলো।
এরা কোনদিন নেতা হবে না। এরা কোনদিন শ্রেষ্ঠ কিছু হবে না। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এদের উপরেই পৃথিবীর সভ্যতা, অগ্রযাত্রা, সংগ্রাম নির্ভর করে। তখন আমরা পরীক্ষায় নম্বর দেয়ার পদ্ধতি পরিবর্তন করলাম। আমরা মেধার জন্য ৫০ শতাংশ করলাম আর যাদের মধ্যে আত্মোৎসর্গের অনুভূতি-হৃদয় আছে তাদের জন্য করলাম ৫০ শতাংশ। সত্যিকারের বড় মানুষ অপেক্ষাকৃত মৃদু। বাইরের থেকে তাদের ভেতরের বৃহত্তর বোঝা কঠিন।