বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা
- ড. মিরাজ আহমেদ
- প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৬:৪৬ PM , আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৬:৪৬ PM
অতি পুরনো চর্বিত কিন্তু অমীমাংসিত টপিক হলো সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা। একপক্ষ বলে এটা করলে ছাত্র ছাত্রীদের যাতায়াত ভোগান্তি কমবে, খরচ কমবে এসব কিছু; আরেক পক্ষ বলে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের মান এক না তাই ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ও এক হতে পারবে না। দুই পক্ষেরই এমন সব যুক্তি কেমন যেন হাস্যকর আর খোড়া মনে হয়। তর্কের খাতিরে বলতে ইচ্ছে হয়, যেখানে সারা বাংলাদেশ চালায় তাদের (বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিস এর পরীক্ষা) মোটামুটি এক প্রশ্নে পরীক্ষা হয় সেখানে ভর্তি পরীক্ষা কোন ছাই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বিসিএস এর যে জনপ্রিয়তা তাতে তো ভর্তি পরীক্ষার সময় থেকেই মোটামুটি একরকমের প্রশ্নপত্র হলেই ছাত্র-ছাত্রীরা আগে থেকেই একটা ধারণা লাভ করতে পারতো। যাক সে কথা।
পত্রিকার পাতায় দেখলাম "বড়ো" চার বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকিরা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় যাবে। আচ্ছা উনারা "বড়ো" কোন অর্থে? আয়তনে না ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যায়? নিশ্চয় সেই "বড়ো"টা বড় মনের কিংবা মানের নয়। বড় মানের হলেতো সেটা বিশ্ব রাঙ্কিংয়ে প্রকাশ প্রতিফলিত হতো।
আমার ইউনিভার্সিটির সাথে পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় (দেশী এবং বিদেশি) গুলোর সাথে অনেক ধরনের সহযোগিতা প্রকল্প বিদ্যমান। যেমন ছাত্র ছাত্রী, শিক্ষক, গবেষণা, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইত্যাদি বিষয়ে একে অপরকে সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে। আসলে শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়টাই এমন। এখানে যে যে বড়ো সে তত বেশি সহযোগিতার হাত বাড়ায়। ব্যাপারটা এমন নয় যে আমার অর্জিত জ্ঞান, শিক্ষা, পদ্ধতি, অপরের সাথে শেয়ার করলে সেটা কমে যাবে। তর্কের খাতিরে যদি আমাদের আদি কিছু ইউনিভার্সিটিকে "বড়ো" বলে ধরি, সে অর্থে তাদের পৃথক হবার চিন্তা ভাবনা, এসব কথা বার্তা ভাওতাবাজির শামিল। বরং আদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুনদের কে সাথে নিয়ে ভালো পথ দেখতে পারে। অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটা প্রশ্ন মাথায় আসে, আচ্ছা বড়োদের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া ওকি বড়ো মাপের, তাদের গবেষণা, পড়াশুনার মান, বেতন, সুযোগ সুবিধা সব কিছুই কি বড়ো বড়ো? নাকি "গায়ে মানে না আপনি মোরল" টাইপ কিছু? অথবা "অন্ধের মাঝে কানা সর্দার" !!
ভর্তি পরীক্ষা এবং সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা:
আমার জানা মতে, পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা নাই। অনেকে GMAT, GRE, SAT, CAT এসব বুদ্ধিদীপ্ত পরীক্ষার ফলাফলের মাধ্যমে ভর্তির প্রাধান্য দেয়। আমাদের দেশে যেহেতু বাস্তবতা ভিন্ন সেহেতু হয়ত আমাদের ভর্তি পরীক্ষার ব্যাবস্থা করতে হবে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার কথা আসলে চীন এবং কোরিয়ার কথা চলে আসে। কোরিয়ায় College Scholastic Ability Test or CSAT পরীক্ষার ফলাফল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গ্রহণ করে থাকে। আর চীনের "গাও খাও "তো সারা পৃথিবীর মধ্যেই সবচেয়ে কঠিন ভর্তি পরীক্ষা। শুধু চীনের কথাই যদি ধরি, পৃথিবীর টপ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে নিচের দিকের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় যদি ১৪০ কোটি মানুষের দেশে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে আমরা কেনো নয়। আর যদি রকমের কথা ধরি তাহলে তো ইঞ্জিনিয়ারিং, ফাইনান্স, টেকনোলজি হতে শুরু করে প্রায় সকল বিশেষিত বিশ্ববিদ্যালয় আছে যারা সবাই একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করে থাকে।
ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন:
আসলে এই জায়গাটা নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা নেই অথচ এটাই সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা আমাদের। আমারতো মনে হয়, আমাদের যে ভর্তি পরীক্ষা তাতে করে বিশ্বের অনেক নামকরা জ্ঞানী-বিজ্ঞানীও চান্স না পেতে পারেন। আসলে প্রশ্নগুলো হওয়া উচিত ছিল লজিক্যাল রেজনিং, ইন্টিলেক্তুয়াল এবিলিটি, থিংকিং পসিবিলিটি, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান গভীরতা এসব নিয়ে। সেটার ফল অনুসারে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি তাদের নুনতম মান নির্ধারণ করে দিতে পারে। কিছুটা এইচএসসির রেজাল্ট দিয়ে কলেজে ভর্তির পদ্ধতির মত। তাতে করে একজন ছাত্র-ছাত্রীকে এই জেলা ওই জেলা দৌঁড়াতে হবে না, এক একটা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা আলাদা করে প্রিপারেশন করা লাগবে না। আর কোথায় কোন বিষয়ে ভর্তি হবে এসব করে করে ৫-৬ মাস সময় নষ্ট হবে না। জন্মসাল, রাজধানীর নাম, ব্যাকরণের মারপ্যাঁচ, পাঠ্যবই এর গতানুগতিক ধারা দিয়ে একজনের মেধার কতটুকু বহিঃপ্রকাশ হয় তা আমার জানা নেই। আর সেসব প্রশ্নপত্র দিয়ে ভর্তি হয়ে একটি সার্টিফিকেট পাওয়া যায় যেটা একটা পত্র কাগজ ছাড়া আর কিছুই না।
আবার দেখা যায়, অনেক ছাত্র-ছাত্রী তার নিজের পছন্দের বিষয়ে সুযোগ না পাওয়ায় জোর করে অন্য বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স করে। আখেরে লাভ হয় একটি ডিগ্রী জুটে, তার পরে ২০-৩০ হাজার একটি চাকুরি। কিন্তু তাতে করে কি বিজ্ঞানী, গবেষক হওয়া যায় আর বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল উদ্দেশ্য সাধন হয়?
ভালো একটি আউটপুট পাবার জন্য ভালো ইনপুট দরকার, সাথে একটি ভালো মেশিন। মেশিন ভালো না হলে ইনপুট যতই ভালো হউক ফল ভালো আসবে না, আবার ইনপুট খারাপ হলে মেশিন ভালো হলেও খুব একটা লাভ নেই। ছাত্র-ছাত্রীদের যদি ইনপুট ধরি আর বিশ্ববিদ্যালয় আর শিক্ষকদের কে মেশিন ধরি তাতে আমার মনে হয় আমাদের ইনপুট সিস্টেমই খারাপ, সাথে মেশিনটি ও জং পরা আর নষ্ট।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, গুয়াংডং ইউনিভার্সিটি অফ ফাইনান্স এন্ড ইকোনমিকস