করোনা দুর্যোগকালে যাকাত ম্যানেজমেন্ট
- ডক্টর তুহিন মালিক
- প্রকাশ: ১৬ মে ২০২০, ০১:০৯ PM , আপডেট: ১৬ মে ২০২০, ০১:০৯ PM
(১) এ বছর করোনা দুর্যোগের কারণে শুধু দরিদ্র মানুষই যাকাতের হকদার নয়। বরং ফকির-মিসকিনের লিষ্টে নতুন করে চলে এসেছে অনেক নিম্ন মধ্যবিত্তদেরও নাম। এমনকি অনেক মধ্যবিত্তরা পর্যন্ত নিঃস্ব হয়ে গিয়ে, না পারছে জীবন চালাতে। না পারছে কারো কাছে কিছু চাইতে। আর এদের বেশীর ভাগই আজ যাকাতের হকদার। কাজেই পরিবার বা আত্মীয়ের মধ্যে যাকাতদাতার উপর ফরজ এই দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো। বিত্তশালীদের উপরও ফরজ ২.৫ শতাংশ যাকাত নামক ট্যাক্স আদায়ের। এটা মাইকিং করে নয়, মানুষ জড়ো করে নয়, শাড়ি-লুঙ্গী বিতরণ করে নয়। কিংবা রিলিফের মত করে যাকাত দিয়ে নয়। এটা শো-অফ করার সময় নয়। বরং এটা হঠাৎ নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আল্লাহ কর্তৃক তাদের নির্ধারিত হক পরিশোধের সময়।
(২) দেশের এই ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে ধনীরা পরিপূর্ণভাবে যাকাত আদায় করলে সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। দেশে দারিদ্রতা ও আয় বৈষম্য কমাতে যাকাত হবে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। সরকারের উচিত আসন্ন বাজেটের আগেই যাকাত প্রদানকারীকে কর রেয়াত সুবিধা ঘোষনা করা। সরকারের যাকাত ফান্ডে অপ্রদর্শিত আয়কে বিনাপ্রশ্নে গ্রহণের ঘোষনা দেয়া যেতে পারে। এই যাকাত সরকারি বাজেট ব্যবস্থার রিসোর্স মবিলাইজেশনের উৎস হতে পারে। যা সোস্যাল সেফটি নেট প্রোগ্রাম বাস্তবায়নে ব্যবহার করা যেতে পারে।
(৩) যাকাত কোন রিলিফ বা ত্রাণ নয়, যে আপনি প্রচার-প্রচারনা চালিয়ে আদায় করবেন। আপনি কি আপনার ইনকাম ট্যাক্স কিংবা ভ্যাট, কর, রাজস্ব ইত্যাদি মাইকিং করে আদায় করেন? যাকাতও তেমনি আল্লাহ কর্তৃক আরোপিত একটি ফরজ ট্যাক্স। ইসলামে কালিমায়ে শাহাদাত ও নামাজের পরই যাকাতের স্থান। যাকাত একটি ফরয বিধান। সুতরাং যাকাত ফরজ জেনেও কেউ তা অস্বীকার করলে সে কাফের হয়ে যাবে। আর যে যাকাত প্রদানে কৃপণতা করবে বা পরিমাণের চেয়ে কম দিবে, সে কঠিন শাস্তির উপযুক্ত হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “এবং যারা সোনা ও রূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে, আর তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদের বেদনাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা গরম করা হবে, অতঃপর তা দ্বারা তাদের কপালে, পার্শ্বে এবং পিঠে সেঁক দেয়া হবে। (আর বলা হবে) ‘এটা তা-ই যা তোমরা নিজদের জন্য জমা করে রেখেছিল। সুতরাং তোমরা যা জমা করেছিলে তার স্বাদ উপভোগ কর” (সূরা তওবা: ৩৪-৩৫)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: “আল্লাহ যাকে সম্পদ দান করেছেন, অতঃপর সে তার যাকাত প্রদান করল না, কিয়ামতের দিন তার জন্য বিষধর সাপ সৃষ্টি করা হবে। যার দুটি চোঁয়াল থাকবে, যা দ্বারা সে তাকে কিয়ামতের দিন পেঁছিয়ে ধরবে। অতঃপর তার দু’চোয়াল পাকড়ে বলবে: আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার সঞ্চিত ধন”। [বুখারি: ৮৪০৩]
(৪) যাকাতই বিশ্বের সর্বপ্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যাকাত আদায়ের ফলে সম্পদ আবর্তিত হয়।আপাতদৃষ্টিতে যাকাত দিলে সম্পদ কমে যায় বলে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা বেড়ে যায়। যেমন- যাকাত গরীবের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ফলে বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি পায়। যা যোগান বৃদ্ধিতে চাপ প্রয়োগ করে। যোগান বাড়াতে প্রয়োজন হয় বিনিয়োগ বাড়ানোর। গড়ে উঠে নতুন কারখানা। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। বেকারত্ব হ্রাস পায়। বিনিয়োগ বাড়ালে মুনাফা বৃদ্ধি পায়। কাজেই সম্পদও বৃদ্ধি পায়। ফলে যাকাতও বেড়ে যায়। এভাবেই পুরো অর্থনীতিকে চালিয়ে নিয়ে যায় যাকাত।
(৫) অন্যদিকে হারাম সম্পদে কখনও যাকাত আসে না। হারাম সম্পদ দিয়ে যাকাত আদায়ও করা যায় না। যাকাত তো হলো হালাল সম্পদের কেবল ২.৫ শতাংশ। আর হারাম সম্পদ তো পুরো ১০০ শতাংশই দান করে দেয়াটা ওয়াজিব। কারণ এ সম্পদের মালিক ব্যক্তি নয়। কাজেই সুদ, ঘুষ, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, বিদেশে অর্থ পাচার , কালো টাকা, অন্যায়ভাবে দখলকৃত সম্পত্তি ইত্যাদি সর্ব প্রকার হারাম সম্পদ তাৎক্ষণিকভাবে সওয়াবের নিয়ত ছাড়া দান করে দায়মুক্ত হতে হবে। সরকারেরও উচিত জনগণের এই হকের টাকা লুটেরাদের কাছ থেকে আদায় করে করোনা সংকটে অর্থের যোগান দেয়া। অর্থনীতির এই মহাসংকট কালে গত ১০ বছরে বিদেশে পাচারকৃত ৯ লক্ষ কোটি টাকা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। যা আমাদের দুই বছরের রাষ্ট্রীয় বাজেটের সমপরিমাণ অর্থের কাছাকাছি।
(৬) এই রমজানে সবাই কত কষ্ট করে রোজা রাখছি। নামাজ পড়ছি। কিন্তু নামাজ রোজার মত ফরজ বিধান যাকাত কি পরিপূর্ণভাবে আদায় করছি? বাংলাদেশে যে পরিমান বিত্তশালী আছেন, তারা যদি পরিপূর্ণভাবে যাকাত আদায় করেন। তাহলে করোনা মহামারীর সময়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে কোন অর্থনৈতিক বিপর্যয় হবার কথা নয়। যাদের উপর যাকাত ফরজ, তারা কি জাতির এই দুঃসময়েও নিজেদের সম্পদ আগলে রাখবেন? যাকাত দুনিয়ার ট্যাক্স নয় যে ফাঁকিঝুঁকি দিয়ে রক্ষা পাওয়া যাবে। এটা আল্লাহর নির্ধারিত ফরজ ট্যাক্স। গরীবের হক। ফাঁকি দিয়ে রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়।
লেখক: ডক্টর তুহিন মালিক
আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ