কোভিড-১৯ রোগের ফলে সৃষ্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার স্থিতিকালের গুরুত্ব

  © টিডিসি ফটো

যখন বহিরাগত এন্টিজেন; যেমন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া মানবদেহে প্রবেশ করে, দেহের লিম্ফোসাইটস নামক রোগ প্রতিরোধী ইমিউন কোষগুলো "এন্টিবডি" তৈরির মাধ্যমে সাড়া দেয় এবং এন্টিজেনের সাথে লড়াই করে। "এন্টিবডি" হচ্ছে প্রোটিন। এই এন্টিবডিগুলো দেহকে অতিরিক্ত সংক্রমণের থেকে রক্ষার চেষ্টা করে। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, একজন সুস্থ মানুষ এন্টিজেন দ্বারা আক্রান্তের সময় প্রতি দিনে দশ লক্ষ এন্ডিবডি তৈরি করতে পারে এবং এই এন্টিবডিগুলো এন্টিজেনের সাথে কার্যকরভাবে লড়াই করে।

নভেল করোনাভাইরাস (SARS-Cov2) একটি আরএনএ ভাইরাস; তার জেনেটিক বস্তু আরএনএ (RNA) দিয়ে তৈরি। মানুষের দেহ যখন কোন নতুন ধরণের ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়, তা মোকাবিলায় দেহের এন্টিবডিগুলোর সক্রিয় সাড়া দিতে কয়েকদিন সময় লাগে (সূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞান সম্পর্কিত ওয়েব সাইট লাইভ সায়েন্স)। সংক্রমক ভাইরাস মারাত্মক হলে, এই সময়ে সংক্রমণ দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং মাঝে মাঝে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতির পূর্বে তীব্র সংক্রমণে মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টাইম নিউজ পেপার প্রদত্ত তথ্য মতে, চীনের দক্ষিণ-পূর্বভাগের শেনচেন শহরে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়া আরোগ্যলাভকারী ২৬২ জনের মধ্যে ৩৮ জনের দেহে পরবর্তীতে কোভিড-১৯ পজিটিভ সনাক্ত হয়েছিল। উল্লেখিত ৩৮ জনের সকলেই কোভিড-১৯ রোগের লক্ষণবিহীন (asymptomatic) ছিলেন। চীনের উহান শহরে (যেখানে বৈশ্বিক মহামারি আরম্ভ হয়েছিল) টেস্ট করে আরোগ্যলাভকারী চারজন স্বাস্থ্য কর্মীর কোভিড-১৯ পজিটিভ সনাক্ত হয়েছিল। একইভাবে, শেনচেন শহরের পুনরায় কোভিড-১৯ পজিটিভদের মত তারাও লক্ষণবিহীন (asymptomatic) ছিলেন। তবে, উভয়ক্ষেত্রেই কোভিড-১৯ পজিটিভদের পরিবারের সদস্যরা সংক্রমিত হয় নাই।

ইতোমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় ২৬০ জনের অধিক কোভিড-১৯ রোগ থেকে আরোগ্যলাভকারী ব্যক্তিগণের পজিটিভ করোনাভাইরাস টেস্ট পাওয়ায় শঙ্কার কারণ ছিল যে, নভেল করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে পুনঃসক্রিয় হতে বা একাধিক বার সংক্রমণ ঘটাতে পারে। কিন্তু সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি বলেছেন, এমনটি ঘটার সম্ভাবনা নেই।

৩০ এপ্রিল, ২০২০ তারিখে এক নিউজ ব্রিফিংয়ে সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হসপিটালের ডাক্তার ড. ওহ মিয়ং-ডন বলেন, বরং, যে পলিমারেজ চেইন রিয়েকশন (পিসিআর) পদ্ধতিটি করোনাভাইরাস সনাক্তে ব্যবহৃত হয়, তা সংক্রামক (সক্রিয়) ভাইরাস এবং "মৃত" ("dead") ভাইরাসের ছোট টুকরাগুলোর (fragments) জেনেটিক বস্তুর (আরএনএ/ডিএনএ) মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে না। "মৃত" ("dead") ভাইরাসের ছোট টুকরাগুলো আরোগ্য লাভের পর মানুষের দেহে অনেক সময়কাল থাকে (তথ্য সূত্রঃ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম "দ্য কোরিয়া হেরাল্ড" ও যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান ভিত্তিক ওয়েব সাইট "লাইভ সায়েন্স")।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির বায়োলজি এন্ড নিউরাল সায়েন্স এর প্রফেসর ক্যারল রেইস বলেন, যদিও কেউ করোনাভাইরাস থেকে আরোগ্য লাভ করেন এবং সংক্রামক ভাইরাস না থাকলেও, দেহে থেকে যাওয়া ভাইরাল আরএনএ এর ছোট নিস্ক্রিয় (inactive) টুকরাগুলো পজিটিভ টেস্ট দেয়। মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাসকে পরাজিত করলে, মৃত কোষগুলির সমস্ত খন্ড বিখন্ড আবর্জনা (জেনেটিক বস্তু সহ) দেহ থেকে পরিস্কার হতে সময় প্রয়োজন (তথ্য সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান ভিত্তিক ওয়েব সাইট "লাইভ সায়েন্স")। দ্য কোরিয়া সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিন কোরিয়ার যে সকল আরোগ্যলাভকারীর দেহে পুনঃপরীক্ষায় কোভিড-১৯ পজিটিভ পাওয়া গিয়েছিল, তাঁদের দ্বারা ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা নাই (তথ্য সূত্রঃ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম "দ্য কোরিয়া হেরাল্ড")।

বিশ্বখ্যাত ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, SARS-CoV-1, MERS-CoV ও কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-CoV-2 এবং মানুষের জন্য ক্ষতিকর অন্য দুইটি করোনাভাইরাস HCoV-OC43 ও HCoV-HKU1 বিটা করোনাভাইরাস জেনাসের অন্তর্ভুক্ত। বিটা করোনাভাইরাস, HCoV-OC43 ও HCoV-HKU1 এর সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট নির্দিষ্ট এন্ডিবডির ফলে গঠিত দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা চল্লিশ সপ্তাহ টেকসই থাকে (তথ্য সূত্রঃ এপিডিমিয়োলজি এন্ড ইনফেকশন জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ); অন্যদিকে, ইমারজিং ইংফেক্সাস ডিজিজেস জার্নাল এ প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের ফলাফল অনুযায়ী, ২০০২-২০০৩ সালে সংগঠিত মহামারির জন্য দায়ী করোনাভাইরাস SARS-CoV-1 এর সংক্রমণের ফলে মানবদেহে সৃষ্ট নির্দিস্ট এন্ডিবডি উক্ত ভাইরাসের ক্ষেত্রে গড়ে দুই বছর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রেখেছিল।

সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) জানিয়েছে, ‘কোভিড-১৯ এর মানুষের দেহে রোগ প্রতিরোধ রেসপন্স/সাড়ার স্থিতিকাল এখন পর্যন্ত অজানা।’ সিডিসি ব্যাখ্যা করেন, Middle East respiratory syndrome-CoV/MERS-CoV সংক্রমণ আরোগ্যলাভকারী ব্যক্তিকে শীগগির পুনঃসংক্রমিত করে নাই, কিন্তু কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে একই রোগ প্রতিরোধ সুরক্ষা (immune protection) দেখা যাবে কিনা তা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। ১৪ এপ্রিল ২০২০ তারিখে বিশ্বখ্যাত ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, ২০২৫ সাল পর্যন্ত কোভিড-১৯ রোগের প্রাদুর্ভাব চূড়ান্তভাবে (crucially) নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট ভাইরাসের কারণে মানবদেহে সৃষ্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার স্থিতিকালের উপর।

যদি কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-CoV-2 মানবদেহে HCoV-OC43 ও HCoV-HKU1 করোনাভাইরাস দুইটির মত স্বল্প সময়ের (৪০ সপ্তাহ) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে তবে প্রতি বছর কোভিড-১৯ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে এবং SARS-CoV-1 করোনাভাইরাসের মত দীর্ঘতর সময় (দুই বছর) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে তবে দ্বিবার্ষিক ভাবে (দুই বছরে একবার) কোভিড-১৯ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে। অধিকিন্তু, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার সময়কাল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার স্থিতিকালের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ