প্রসঙ্গ মে দিবস

১৩৪ বছর পরও থামেনি শ্রমিকদের কান্না

  © টিডিসি ফটো

প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত শ্রমিকের শ্রম এবং ঘামের বদলৌতে প্রত্যেকটা সভ্যতা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছে এবং পৌঁছেছিল। প্রত্যেক সভ্যতার একই চিত্র- তা হল শ্রমিক শোষণ, নিপীড়ন এবং নিষ্পেষণ। দেশ, সভ্যতা, মালিক পরিবর্তিত হয়েছে এবং শ্রমিকদের উপর শোষণ, নিপীড়ন এবং নিষ্পেষণের ধরণ পরিবর্তিত হয়েছে কিন্ত মাত্রা কমেনি। মালিকদের সুবিধা অনুযায়ী ১০-১৬ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করতে হত শ্রমিকদের। উপায়ন্তর না দেখে, শুধু খেয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে অমানুষিক পরিশ্রম করেছে শ্রমিকেরা। এই অমানুষিক পরিশ্রমের ফলে অকালেই ঝরে পড়েছিল অনেকের প্রাণ নানা জটিল শারীরিক সমস্যায় পতিত হয়ে।

মাঝে মাঝে বিদ্রোহ দানা বাঁধলেও অদৃশ্য শক্তির দুর্দান্ত আঘাতে নিমিষেই পন্ড হয়ে যেত। অবশেষে প্রায় ১০০ বছর ধরে নানা ছোট-বড় ঘটনার জন্ম দিয়ে, ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে ১০-১৬ শ্রম ঘন্টা থেকে কমিয়ে ৮ শ্রম ঘণ্টা করার জন্য শ্রমিকেরা বিক্ষোভে ফেটে পরে। তুমুল আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালালে ৩-১১ জন শহীদ হন এবং অনেকেই আহত হন। সেই থেকেই এই দিনটিকে শ্রমিক দিবস এবং ১৯৮০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

সেই আন্দোলনকে বাস্তবায়ন করতে ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আইএলও এবং শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তৈরি হয় আইএলও কনভেনশন। বাংলাদেশ আইএলও এর একজন সদস্য রাষ্ট্র। কিন্তু হতাশার বিষয় আজও বাংলাদেশে আইএলও কনভেনশন এর নির্দেশনা অনুসারে শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলা যায়। আইএলও এর ১০০ বছর অতিক্রম করেছে কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে এটি হয়েছিল তা উল্লেখযোগ্যভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।

শ্রমিকদের উজ্জীবিত রাখার জন্য বিভিন্ন সময় প্রেষণা তত্ত্ব মঞ্চায়িত হয়েছে যার বেশির ভাগই পশ্চিমা রাষ্ট্রের দেয়া। কিন্তু এখানে অপূর্ণতা হল অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের খাদ্য/ক্ষুধা দফা ব্যতীত প্রেষণা তত্ত্বের অন্য কোন দফাই কাজে আসেনা। ক্ষুধাই একমাত্র দফা বা কারণ, যা শ্রমিকদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে বাধ্য করে। যাদের কাছে পূর্ণিমার চাঁদ সুকান্ত ভট্টাচার্যের জলসানো রুটির মত, তাদের হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম ছাড়া আর কি করার আছে।

বাংলাদেশের পোশাক খাতে কাজ করছে প্রায় ৫০ লাখের মত শ্রমিক। সম্প্রতি লকডাউনে চাকরি হারানোর ভয়ে অনেক পোষাক শ্রমিক পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছে শত শত মাইল। অধিকাংশই শ্রমিকেই বলছে যে, চাকরী বাঁচানোর জন্যই তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ কাজ করেছে। না কেউ দায় স্বীকার করছে, না শ্রমিকেরা ভয়ে কিছু বলছে যে কার ইশারায় তারা এই অনিশ্চয়তার মাঝে আসতে বাধ্য হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হল আধুনিক যুগে এসেও, শ্রমিকদের নেই কোন চাকরীর নিশ্চয়তা এবং অন্যান্য সুবিধা থাকলেও কদাচিৎ।

বাংলাদেশের শ্রমিকেরা প্রত্যেকটা বিভাগে এতটাই অবহেলিত যে মরণঘাতী করোনার সময়েও তাদের ২/৩ মাসের দায়িত্ব নিচ্ছে না তাদের প্রতিষ্ঠান এবং মালিকেরা। শ্রমিকের শ্রম এবং ঘামেই প্রত্যেকটা সেক্টর আজ শেকর থেকে শিখরে পৌছেছে, তৈরি হয়েছে মালিক সম্প্রদায়, তারা এই করোনার দুর্যোগে ভয়াবহভাবে উদাসীন শ্রমিকদের নিরাপত্তা ব্যপারে। যার ফলে, সরকারী ত্রাণ নেওয়ার লাইন দেড় মাসের মাঝেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তারা তোয়াক্কা করছেনা সামাজিক দূরত্ব এবং আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে করোনার ভয়াবহতা। সরকার হিমশিম খাচ্ছে সবার খাবারের ব্যবস্থা করতে গিয়ে। যার ফলে, তৈরি হচ্ছে নানা ধরণের বিপত্তি এবং জনজীবন মারাত্মক হুমকির মুখে। অন্যদিকে বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪.২ মিলিয়ন। প্রায়ই সংবাদ মাধ্যমের প্রচারিত হচ্ছে শিশু শ্রমিকদের নির্যাতনের কাহিনী। নারীরা শ্রমিকেরা তাদের চাকরি ক্ষেত্রে চরমভাবে অবহেলিত, মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতিত এবং বৈষম্যের শিকার। কোন মহল থেকেই নারী ও শিশু শ্রমিকদের রক্ষার জন্য কোন কার্যকর পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছেনা।

শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে গঠিত হয়েছে হরেক রকম এবং নামের ট্রেড ও শ্রমিক ইউনিয়ন। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে তাদের ভূমিকা চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। যে উদ্দেশ্য নিয়ে ১৩৪ বছর আগে ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে আন্দোলন হয়েছিল তা এখনো অবাস্তবায়িত। এখনো শ্রমিকের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসার মত মৌলিক চাহিদা/অধিকার থেকে শ্রমিকেরা বঞ্চিত। ১৩৪ বছর পরেও শ্রমিকদের কান্না থামেনি বরঞ্চ ছলে বলে কৌশলে নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে বলা চলে।

লেখক: সহ-প্রধান গবেষক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর কমিউনিকেশন প্রোগ্রামস (বিসিসিপি)


সর্বশেষ সংবাদ