দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে ইসলামের বিধান

এদেশের বাজারে দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি খুবই সাধারণ দৃশ্য। সুযোগ পেলেই এক শ্রেণীর মুনাফাখোর ব্যবসায়ী নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মূল্য বৃদ্ধি করে থাকেন। বাংলাদেশ বোধহয় বিশ্বের একমাত্র মুসলিম দেশ যেখানে রমজান মাস এলেই নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যায়। সেসময় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করা হয়। রমজান মাস ছাড়াও প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য হয় আকাশচুম্বী, আর পেঁয়াজের ঝাঁজে ভোক্তারা হন  আক্রান্ত। এ বছর পেঁয়াজের দাম যেন লাগামহীন ঘোড়ার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সরকার নির্বিকার, জনগণ ক্ষুব্ধ। তারপরও যেন দেখার  কেউ নেই।

এই প্রথম বাংলাদেশে পেঁয়াজের কেজি ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েছে। গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ থেকে পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে উঠে। ভারত ২৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে।  এরপর ধাপে ধাপে পেঁয়াজের দাম উঠানামা করে। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে রাজধানী ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ প্রায় ৫০ থেকে ৬০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কেজি দরে। সকালেও কোনো কোনো বাজারে দাম ছিল ১৮০ টাকা। কোনো কোনো খুচরা বাজারে দাম ২২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে।

পেঁয়াজের দাম বাড়লেও অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশে মোট পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২২-২৫ লাখ মেট্রিক টন। তবে দেশে প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। সব মিলে আমাদের ঘাটতি প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। আমদানি করে ঘাটতি পূরণ সম্ভব। আমদানির পরেও এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীর গুদামজাত, কালোবাজারীদের দৌরাত্ম্যের কারণে পেঁয়াজের এই লাগামহীন মূল্য। অনেকে পেঁয়াজের পেছনে না ছুটে বিকল্প মসলার ব্যবস্থা করছেন।

আল্লাহ তায়ালা ব্যবসাকে হালাল করেছেন। কিন্তু কিছু কার্যকলাপের কারণে সেই ব্যবসার মুনাফা কখনো সখনো হারামে পরিণত হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্ব গতি সাধারণ মানুষের জীবন নাকাল করে তোলে। দ্রব্য মূ‌ল্যের আচমকা বৃদ্ধির কিছু কারণ রয়েছে, যেমন ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, মধ্যস্বত্বভোগীদের অতিরিক্ত মুনাফার লালসা। এছাড়াও কিছু কারণ রয়েছে,  যেমন- আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া, শুল্ক বৃদ্ধি করা, বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং তদারকির ক্ষেত্রে সরকারের অমনোযোগিতা ও ব্যর্থতা, শিল্প মালিক, উদ্যোক্তা, উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি ইত্যাদি কারণে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। 

ইসলামী শরিয়তের বিধান হচ্ছে, সরকার পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দেবে না। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, 'রাসুল (সা.) এর যুগে একবার দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেল। লোকেরা বলল, "ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি আমাদের জন্য দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিন। রাসুল (সা.) বললেন, মূলত আল্লাহ তায়ালাই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকারী, রিজিক সঙ্কীর্ণকর্তা, প্রশস্তকর্তা ও রিজিকদাতা। আমি আমার রবের সঙ্গে এভাবে সাক্ষাতের আশা রাখি যে, তোমাদের কারো যেন আমার বিরুদ্ধে রক্ত বা সম্পদ, কোনো বিষয়ে কোনোরূপ দাবি না থাকে।" (তিরমিজি, ১/২৪৫, আবু দাউদ)। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার মূল্য নিয়ন্ত্রণে মূল নির্ধারণ করে দিতে পারেন। তবে তা সব সময় না। কিছুদিনের জন্য এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। মধ্যযুগে দিল্লি সুলতান আলাউদ্দিন খলজীর মূল্যনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এক্ষেত্রে হতে পারে মাইলফলক।

ইসলামে খাদ্য মজুদ করার ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। হযরত মা'মার ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে ফাজালা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছি, 'পাপাচারী ছাড়া অন্য কেউ মজুদদারি করে না' (তিরমিজি)। অন্য হাদিসে আছে, 'যে ব্যক্তি ৪০ রাত পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য মজুদ রাখে, আল্লাহর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক থাকে না। মজুদদার ও অধিক মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে হাদীসে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে এদেরকে পাপী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পণ্যদ্রব্য আটক করে অধিক মূল্যে বিক্রয়কারী অবশ্যই পাপী’ (মিশকাত)।

অত্যধিক মুনাফা লাভের আশায় পণ্যদ্রব্য মজুদ করা, সরিয়ে রাখা, অতিরিক্ত পণ্য ধ্বংস করা শরিয়ত গর্হিত কাজ। এই মর্মে রাসূলুল্লাহ (স.) ভীতি প্রদর্শন করে বলেছেন, ‘কেউ যদি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকিয়ে রাখে, তবে আল্লাহ তাআলা তার উপর মহামারী ও দারিদ্র্যতা চাপিয়ে দেন’ (ইবনে মাজা, বায়হাকী) । নবী করিম (স) আরো বলেছেন, ‘মজুদদার খুবই নিকৃষ্টতম ব্যক্তি; যদি জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পায় তাহলে চিন্তিত হয়ে পড়ে, আর যদি মূল্য বেড়ে যায় তাহলে আনন্দিত হয়।’ (মিশকাত

দালালী বা মধ্যস্বত্বভোগী হয়ে দ্রব্যের দাম বাড়ানোর জন্য হাদিসে কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে তাবরানি শরিফে বর্ণিত রয়েছে, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, 'যে ব্যক্তি মূল্য বৃদ্ধির অসদুদ্দেশ্যে মুসলমানদের লেনদেনে হস্তক্ষেপ করে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাকে আগুনের হাড়ে বসিয়ে শাস্তি দেবেন' (তাবরানি, ৮/২১০)। বাজারে পণ্য সামগ্রী সংকটের বিরুদ্ধে ইসলাম সতর্ক করেছে, মহানবী (স) আরো ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি বাজারে পণ্যের অভাবের সময় পণ্য মজুদ করে রাখে সে বড় পাপী’ (মুসলিম)। পণ্যসামগ্রী মজুদ করে দাম বৃদ্ধি অথবা অধিক মুনাফা করাও ইসলামে নিষিদ্ধ। হাদীস শরিফে মজুদদারকে নিকৃষ্ট, অভিশপ্ত বলে অভিহিত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, ‘আমদানিকারক রিজিকপ্রাপ্ত হয়, আর মজুদদার হয় অভিশপ্ত।’ আরো বলা হয়েছে, ‘বিভ্রান্ত লোকই শুধু মজুদদারী করে’ (ইবনে মাজা)।

দ্রব্যসামগ্রীর দাম নাগালে রাখা ও সুষ্ঠু বাজার তদারকিতে ইসলামী বিধান অনুসরণ ফলদায়ক হতে পারে। দূর হতে পারে সাধারণ মানুষের চরম ভোগান্তি। ব্যবসা হোক মানুষের কল্যাণের অভিপ্রায়ে। মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি জঘন্যতম অপরাধ। এতে ব্যবসায়ীদের প্রতি মানুষের অভিশাপ বর্ষিত হয়ে থাকে।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক

 


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence