আহমদ রফিক, একটি ‘আলোচিত প্রতিবেদন’ ও অজানা গল্প

নওশাদ জামিল
নওশাদ জামিল  © টিডিসি সম্পাদিত

প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে কেমন একটা চাঞ্চল্য বোধ করি। কারণটা আর কিছু নয়, অমর একুশে গ্রন্থমেলা। কলেজজীবন থেকেই লেখালেখির সূত্রে প্রতিবছর যেতাম বইমেলায়। প্রথম দিকে বইমেলায় আড্ডা দিতাম বাংলা একাডেমির বহেরাতলায়, লিটলম্যাগ চত্বরে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে তরুণ কবি-লেখকরা আসতেন, মিলিত হতেন বহেরাতলায়। শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় তরুণ বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হতো, আড্ডা হতো প্রাণখোলা। আড্ডা শেষে আমি ঘুরতাম নিজের মতো, একা। এক স্টল থেকে অন্য স্টলে ঘুরে কিনতাম পছন্দের বই।

মোটামুটি এটাই ছিল আমার ফেব্রুয়ারি মাসের নিত্যরুটিন। জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠে যোগদানের পর পাল্টে গেল সেই সূচি। ২০০৯ সালের জুন মাসে আমি কালের কণ্ঠে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করি। তারপর ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। যোগদানের পর নতুন দায়িত্ব পড়ল আমার কাঁধে। প্রতিবছর বইমেলা নিয়ে প্রতিবেদন করতে হতো আমাকে।

২০১২ সালের একদিনও ছিলাম বইমেলায়। ভিড় ঠেলে স্টল থেকে স্টলে ঘুরছি, খবর সংগ্রহ করছি। হঠাৎ ফোন এল ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক ও লেখক আহমদ রফিকের। মনে পড়ে গেল, তার সঙ্গে আমার দেখা করার কথা ছিল, ব্যস্ততায় আর হয়ে ওঠেনি। খানিক ভয়ে ফোন রিসিভ করি। স্নেহমাখা কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘নওশাদ, জরুরি আলাপ আছে। কাল-পরশু বাসায় এসো।’

ভাষাসংগ্রামীদের একটা সংগঠন ছিল, নাম একুশে চেতনা পরিষদ। এখন তা আছে কিনা জানা নেই। জীবিত সব ভাষাসংগ্রামী ও তরুণ ভাষাপ্রেমীরা সেই সংগঠনের সদস্য ছিলেন। আহমদ রফিক ছিলেন আহ্বায়ক। তার উৎসাহে আমি সংগঠনের একজন সদস্য হয়েছিলাম। শুধু সদস্য নয়, আমার ওপর বড় দায়িত্ব, সংগঠনের প্রচার সম্পাদক করা হয়েছিল। তাই মাঝেমধ্যেই ডাক পড়ত তার বাসায়।

আরও পড়নু: যে কারণে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিককে আমরা মনে রাখব

ঠিক পরের দিন সকালেই কড়া নাড়ি তার ইস্কাটনের বাসায়। ড্রয়িং রুমে গল্প করি অনেকক্ষণ। আড্ডার এক ফাঁকে কণ্ঠে গুরুত্ব এনে তিনি বললেন, ‘শহীদ মিনারের কী অবস্থা, জানো কিছু! শহীদ মিনারের জায়গা একটা কুচক্রী মহল দখল করে নিয়েছে। সাধারণ একটা কবর ঘিরে সেখানে গড়ে উঠেছে পীরের মাজার। কথিত মাজারের ওপর গম্বুজ ও পাশে কমপ্লেক্স নির্মাণের পাঁয়তারা করছে ওরা। এটা হলে শহীদ মিনারের সর্বনাশ হয়ে যাবে। তুমি এটা নিয়ে একটা নিউজ করতে পারবে?’

ইস্কাটন থেকে বের হয়ে সেদিন দুপুরেই চলে আসি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। শহীদ মিনারের পেছন দিকটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেট। গেটের পাশেই কয়েকটা চায়ের স্টল। স্টলের বাঁ পাশে অফিস থেকে দেওয়া মোটরসাইকেল পার্ক করি। ফুটপাতের পাশে ভাসমান দোকান। বেঞ্চিতে বসে চায়ের অর্ডার করি।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে দোকানিকে বলি, ‘আচ্ছা মামা, এখানে নাকি একটা মাজার আছে! মাজারটায় কীভাবে যেতে হয়?’
দোকানি বললেন, ‘মেডিকেলের গেট দিয়ে ভেতরে যান। দেখবেন বিশাল মাজার।’

কথামতো শহীদ মিনার ঘেঁষে ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকি। শহীদ মিনারের গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে সেই মাজার। নানা শ্রেণির মানুষের আনাগোনা সেখানে। ঘুরে ঘুরে দেখি, শহীদ মিনারের পাদদেশেই সীমানা প্রাচীর দিচ্ছে মাজার কমিটি। অবস্থা দেখে চঞ্চল হয়ে ওঠে সাংবাদিক মন। কিন্তু কাউকেই কিছু বলি না। প্রথম দিন শুধুই পর্যবেক্ষণ করি।

সেদিন ঘোরাঘুরি শেষে বিকেলে ফিরে আসি বইমেলা কভার করতে। বইমেলা থেকে ফোন করি আহমদ রফিককে। কথিত মাজারের সর্বশেষ অবস্থার কথা বলি তাকে। তিনি বলেন, ‘দেখে তো, কিছু করতে পারো কিনা। যদি সম্ভব হয়, তোমাদের পত্রিকায় একটা নিউজ করতে পারবে?’

আহমদ রফিক প্রিয় মানুষ, গুরুজন। তাকে হ্যাঁ-সূচক জবাব দিয়ে বলি, ‘অবশ্যই পারব। আশা করি, কিছু একটা করতে পারব।’

পরের দিন দুপুরে আবারও যাই শহীদ মিনার এলাকায়। পরিচয় গোপন রেখে মাজার সম্পর্কে স্থানীয়দের কাছে তথ্য জানতে চাই। পাই পরস্পরবিরোধী তথ্য। পরের দিন ইতিহাসবিদ ও প্রাবন্ধিক-গবেষক মুনতাসীর মামুন স্যারকে ফোন করি। তার কাছে পাই চমকপ্রদ কিছু তথ্য। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ-সম্পর্কিত কিছু বইও সংগ্রহ করি।

ভেতরে ভেতরে শুরু হয় প্রতিবেদন লেখার প্রস্তুতি। আহমদ রফিক সাহায্য করেন খুব। শহীদ মিনার সম্পর্কে নানা তথ্য দেন তিনি। অন্যান্য উৎস থেকেও তথ্য সংগ্রহ করি। দু-একদিন বিরতি দিয়ে আবারও যাই শহীদ মিনার এলাকায়। এবার মাজার কমিটির সদস্যদের কাছে সরাসরি তথ্য জানতে চাই। মাজার কমিটির লোকজন সাংবাদিক বুঝতে পেরে আমাকে নানাভাবে হুমকি দেয় ও পত্রিকায় কিছু লিখতে কড়া ভাষায় নিষেধ করে।

হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি একুশে ফেব্রুয়ারির বিশেষ প্রতিবেদন হিসেবে নিউজ জমা দিই অফিসে। ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি কালের কণ্ঠে লিড নিউজ হিসেবে ছবিসহ প্রতিবেদনটি ছাপা হয়। সঙ্গে প্রকাশিত হয় আহমদ রফিকের একটি মন্তব্য প্রতিবেদনও। ‘বেড়ে উঠছে কথিত মাজার/হুমকিতে শহীদ মিনার’ শিরোনামে প্রতিবেদনে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক কয়েকজন শিক্ষার্থীর বরাত দিয়ে বলা হয়, ‘এখানে কখনো কোনো মাজার ছিল না। ছিল সাধারণ একটা কবর।’

প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয় ঢাকা মেডিকেলের কিছু সাবেক শিক্ষার্থীর অভিমত। তারা জানান, কবরটি মেডিকেল কলেজের কোনো এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর। পরে সেই কবরটিকে ঘিরে নব্বইয়ের দশকে এবং ২০০০ সালের দিকে ধীরে ধীরে মাজার গড়ে তোলে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। তারা দখল করে নেয় ২০ কাঠা জমি।

প্রতিবেদনে আরও লেখা হয়, ‘কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আশপাশের চার একর জমি থেকে দখল নেওয়া হয় ওই ২০ কাঠা জায়গা। এরই মধ্যে দখলকৃত জায়গায় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্থাপনা। মাজার ব্যবসায়ীরা কথিত পীরের কবরের ওপর গম্বুজ ও কবরের পাশে কমপ্লেক্স নির্মাণের পাঁয়তারা করছে। ফলে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিস্মারক ও বাঙালি চেতনার প্রতীক, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।’

কালের কণ্ঠে প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় প্রতিবেদনটি। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সুরক্ষাসহ আশপাশের সব অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দেওয়ার দাবি জানান।

পরের দিন কালের কণ্ঠের এই প্রতিবেদন সংযুক্ত করে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশের সব অবৈধ স্থাপনা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উচ্ছেদ করার আদেশ দেন। একই সঙ্গে উচ্চ আদালত শহীদ মিনারের জমি রক্ষায় কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। সংস্কৃতিসচিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণের প্রশাসক, গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান স্থপতি, নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল ডিভিশন), ঢাকার জেলা প্রশাসক ও শাহবাগ থানার ওসিকে ১২ দিনের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

প্রতিবেদন প্রকাশের পর দেশের সব প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া সংবাদটি ফলাও করে প্রচার করে। বিভিন্ন টেলিভিশনে টক শো, পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়। কালের কণ্ঠের এই প্রতিবেদন নিয়ে আহমদ রফিক, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন একাধিক কলাম লেখেন। কথাসাহিত্যিক নাসরীন জাহান লিখেছেন একটি আকর্ষণীয় ছোটগল্প। এ ছাড়াও প্রকাশিত হয় বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও নিবন্ধ। মনে পড়ে তখন আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ছুটে এসেছিল কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল। অনেকের কাছ থেকেও পেয়েছি নানা প্রশংসা ও উৎসাহ।

এ কথা বলা জরুরি যে, আহমদ রফিকের উৎসাহেই সেদিন অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি লিখেছিলাম। তিনি শুধু উৎকৃষ্ট লেখক ও গবেষকই ছিলেন না, ছিলেন সফল সংগঠকও। ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন সরাসরি, পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও শহীদ মিনারের সুরক্ষার জন্য লেখালেখি করেছেন। শহীদ মিনারের বেহাল দশা দেখে তিনি আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘প্রতিবছর শহীদ দিবস (২১ ফেব্রুয়ারি) উপলক্ষে শহীদ মিনারের পরিমার্জনা যেন নিয়ম রক্ষা করে। অন্য সময়ে এখানে চলে সম্ভাব্য সব ধরনের অনাচার। রাতে মাদক ও গাঁজার আসরও জমজমাট হয়ে ওঠে। তাছাড়া নানা প্রাণীর আশ্রয় ও বিশ্রামস্থল হয়ে উঠেছে শহীদ মিনারের চত্বর। কেউ দেখার নেই, কেউ বাধা দেওয়ার নেই।’

কালের কণ্ঠে সংবাদ প্রকাশের পর প্রশাসনের টনক নড়ে। আমার ওই নিউজের পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য আদালত রায় দেন এবং সেটি পালনের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেন। আশার কথা, আদালতের রায় যথাযথভাবে পালন করা হয়। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ত্বরিত উদ্যোগে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই রায় কার্যকর করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট মো. আল-আমিনের নির্দেশে শুরু হয় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে চলে অভিযান।

পরের দিন কালের কণ্ঠে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ‘অবারিত হলো প্রাণের শহীদ মিনার’। আমার সেই নিউজের প্রেক্ষিতে অবৈধ দখল থেকে রক্ষা পায় বাঙালি চেতনার সূতিকাগার, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। সাংবাদিক জীবনে এটি এক স্মরণীয় ঘটনা।

আহমদ রফিকের জন্যই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অবৈধ দখল থেকে রক্ষা পেয়েছিল এবং লেখা হয়েছিল আমার ওই আলোচিত প্রতিবেদন। এ কথা অনেকেরই অজানা। সদ্য প্রয়াত হয়েছেন ভাষাসংগ্রামী, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ আহমদ রফিক। সারাজীবন তিনি মানুষের জন্য ভালো কিছু করার চেষ্টা করেছেন; মৃত্যুর পরও তার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তিনি তার মরদেহ ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ ও গবেষণার জন্য দান করেছেন।

ব্যক্তিজীবনে আমি অসংখ্য মানুষকে কাছ থেকে দেখেছি, জ্ঞানী-গুণী মানুষের সংস্পর্শে থেকেছি। নিঃসন্দেহে বলতে পারি, আহমদ রফিক ছিলেন আলাদা। তার সাদামাটা জীবন, অনাড়ম্বর ব্যক্তিত্ব এবং মানুষের জন্য কাজ করার অবিরাম প্রচেষ্টা তাকে এক অনন্য মহীরুহে পরিণত করেছিল।

অত্যন্ত জোরালো ভাষায় বলি, ভবিষ্যতে যারা ভাষা আন্দোলন কিংবা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণা করবেন, নিঃসন্দেহে তাদের পথের দিশারী হয়ে উঠবেন আহমদ রফিক। কালের স্রোতে তিনি স্মরিত হবেন তার বিপুল কর্মভাণ্ডারের জন্যই। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস হোক বা রবীন্দ্র-চর্চার জগৎ—যেখানেই নতুন প্রজন্ম অনুসন্ধান করবে, সেখানেই তার লেখা হয়ে উঠবে অবলম্বন। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

নওশাদ জামিল: কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক


সর্বশেষ সংবাদ