জাকসুতে ছাত্রশিবিরের অভাবনীয় বিজয়ের রহস্য কী?

এস এম তৌফিকুল ইসলাম
এস এম তৌফিকুল ইসলাম  © টিডিসি সম্পাদিত

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত, যেখানে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত বিস্তৃত। কয়েক দশক ধরে ইসলামী ছাত্রশিবিরের (শিবির) রাজনীতি এখানে নিষিদ্ধ ছিল, যা ১৯৯২ সালে ছাত্রনেতা হাবিবুর রহমান কবিরের হত্যাকাণ্ডের পর থেকে শুরু হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পেছনে ১৯৯২ সালের হাবিবুর রহমান কবির হত্যাকাণ্ড একটি মূল ঘটনা। এর পর থেকে কয়েক দশক ধরে শিবিরকে ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জামায়াত-শিবিরকে কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে, যা তাদের আন্ডারগ্রাউন্ডে পরিচালিত করেছে। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে রাজনৈতিক স্থান উন্মুক্ত হয়েছে। এই পরিবর্তন শিবিরকে প্রকাশ্যে আসার সুযোগ দিয়েছে।

ক্যাম্পাসে শিবিরকে একটি 'ভয়ানক ট্যাগ' হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু ২০২৫ সালের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে শিবির-সমর্থিত 'সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট' ২৫টি পদের মধ্যে ২০টিতে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছে। এই ফলাফল অবিশ্বাস্য মনে হলেও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে শিবিরের সাফল্যের পর এটিকে আর অস্বাভাবিক বলা যায় না।

এই নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়েছে দীর্ঘ ৪৮ ঘণ্টা পর, যা ভোট গণনার অব্যবস্থাপনা এবং অনিয়মের অভিযোগকে আরও জোরালো করেছে। ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলসহ অন্যান্য প্যানেলগুলো নির্বাচন বয়কট করেছে, ব্যালট পেপার, কালি, ভোটার তালিকা এবং পোলিং এজেন্টদের প্রবেশাধিকার নিয়ে অভিযোগ তুলেছে। এছাড়া, বিএনপি-পন্থী শিক্ষকদের পদত্যাগ এবং নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের পদত্যাগের নানা নাটকীয় ঘটনা এই নির্বাচনকে আরও জটিল করে তুলেছে। প্রশ্ন উঠছে, শিবির কীভাবে এত বিপুল সমর্থন আদায় করল?

গণ-অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনা থেকে মাঠপর্যায়ের নেতৃত্বে শিবিরের ভূমিকা তাদের জয়ের একটি প্রধান কারণ। প্রোফাইল লাল করা, এক দফার দাবি, স্লোগান—সবকিছুর মূলে শিবিরের অবদানের ন্যারেটিভ তাদের সমর্থন বাড়িয়েছে। তরুণ প্রজন্ম, যারা স্বাধীনতার পরের রাজনীতি থেকে আগ্রহ হারিয়েছে, ধর্মভিত্তিক দলের প্রতিশ্রুতিতে সুযোগ দেখেছে। জাকসুতে এই ন্যারেটিভ একইভাবে কাজ করেছে।

১. প্রকাশ্য আত্মপ্রকাশ ও কৌশলগত প্যানেল
আওয়ামী লীগের পতনের পর শিবিরের নেতা-কর্মীরা আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে প্রকাশ্যে এসেছে। তারা গত বছরের সেপ্টেম্বরে আত্মপ্রকাশ করেছেন, যা তাদের দৃশ্যমানতা বাড়িয়েছে। জাকসুতে তারা 'সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট' নামে প্যানেল গঠন করে লিবারেল অ্যাপ্রোচ নিয়েছে। ধর্মীয় রাজনীতির পরিবর্তে ব্যক্তিগত ইমেজ এবং ছাত্রদের সংকটকালীন সমর্থনকে সামনে এনেছে। বর্তমান শিক্ষার্থীরা শিবিরের ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তারের রাজনীতি দেখেনি, তারা চবি, রাবি ক্যাম্পাসে শিবিরের ক্ষমতার চর্চা সম্পর্কেও খুব একটা ধারণা রাখে না। ফলে শিবির একটি ক্লিন ইমেজ নিয়ে সামনে এসেছে।

২. নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ
শিবির-সমর্থিত প্যানেল নিজেরাই নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছে, কিন্তু অন্য প্যানেলগুলো বলছে যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতায় তারা নির্বাচন দখল করেছে। ব্যালট ছাপা ও এমআর মেশিন নিয়ে বিতর্ক, জাকসুতে ভোট গণনায় বিলম্ব এবং গণনাকারীদের অসুস্থতার ঘটনা এই সন্দেহকে আরও বাড়িয়েছে।

৩. দরিদ্র ও নারী শিক্ষার্থীদের সমর্থন
কিছু সোশ্যাল পোস্টে উল্লেখ আছে যে শিবির দরিদ্র শিক্ষার্থীদের প্রণোদনা দিয়ে সমর্থন আদায় করেছে। ক্যাম্পাসে নারী শিক্ষার্থীরা ছিল ছাত্রশিবিরের সবচেয়ে বড় সমালোচক, কিন্তু ঢাবির পরে জাবিতেও দেখা গেছে যে নারী শিক্ষার্থীদের সমর্থন শিবিরের পক্ষে গেছে।

৪. সাংগঠনিক শক্তি ও আঞ্চলিক প্রভাব
ঢাকা থেকে ক্যাম্পাসের দূরত্ব বেশি হওয়ার কারণে এবং ছাত্রলীগ প্রার্থী না থাকার কারণে ভোটের সংখ্যায় প্রভাব পড়েছে। তবে ছাত্রশিবির তাদের শতভাগ সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছে। ঢাবি ও জাবিসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাদ্রাসা থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ধর্মীয় দিক থেকে শিবিরকে সুবিধা হয়েছে।

৫. বামপন্থী বিভক্তি ও পুরনো গুপ্ত রাজনীতি
বামপন্থী সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ বিভক্তি এবং ছাত্রদলের বয়কট শিবিরের পথ সুগম করেছে। জাবি ক্যাম্পাস ঢাকা শহরের সন্নিকটে অবস্থিত হলেও চারপাশে দরিদ্র লোকালয় থেকে শিবির বহু বছর ধরে তাদের গুপ্ত রাজনীতি পরিচালনা করেছে।

নতুন বাংলাদেশে, যেখানে গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি উঠেছে শিবিরের উত্থান ইসলামিস্ট চিন্তাধারার প্রভাব নির্দেশ করে। এটি জাতীয় নির্বাচনকে সরাসরি প্রভাবিত নাও করতে পারে, তবে মানসিকভাবে তাদের অনেক চাঙ্গা রাখবে। প্রগতিশীল পরিচয়ধারী অনেক মানুষ এই বিজয়কে হজম করতে পারছেন না, তবে অস্বীকার করার যৌক্তিক কারণ নেই। এটি ছাত্র রাজনীতির নতুন দিক নির্দেশ করে, যেখানে গণ-অভ্যুত্থানের ন্যারেটিভ এবং অনিয়মের অভিযোগ মিলেমিশে একটি জটিল ছবি তৈরি করেছে। জাহাঙ্গীরনগরের এই নির্বাচন শুধু একটি ক্যাম্পাসের গল্প নয়, এটি নতুন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের একটি আয়না।

এস এম তৌফিকুল ইসলাম: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট
যোগাযোগা: smtawfiqulislam@gmail.com

 

 


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!